ভারতীয় সংবিধানের চুয়াল্লিশতম ধারায় নিয়ামক নীতিসমূহের তালিকায় রয়েছে এই কথাগুলি যে ভারতীয় রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে ভারত জুড়ে একই দেওয়ানি বিধির প্রচলন করতে। সংবিধানকে প্রাপ্য সম্মান কখনোই না দিয়েও অনেক দিন ধরেই আর এস এস এই ধারাটির রূপায়ণের দাবি তুলে শোরগোল করে চলেছে। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ধারাটিকে তার প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে হিন্দুরাষ্ট্রের সামগ্রিক বিভাজনমূলক পরিকল্পনার সঙ্গে তাকে যুক্ত করা। বিশেষত নির্বাচনের আগে এই ধারাকে তারা প্রচারের হাতিয়ার বানায়।

 

বর্তমানে গুজরাট এবং হিমাচলপ্রদেশে নির্বাচনকে পাখির চোখ করেই প্রচারে তারা বলছে জিতে এলে রাজ্যে সমান দেওয়ানি বিধি চালু করবেই, যদিও কোনো রাজ্য এটা আলাদাভাবে করতে পারে না। আর সম্ভবত ২০২৪ র লোকসভা নির্বাচনের কথা মনে রেখে সম্প্রতি বিজেপি সাংসদ সুশীলকুমার মোদির নেতৃত্বে সংসদের আইনসংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিতে সমস্ত পারিবারিক আইন নিয়ে পর্যালোচনার এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর এই ঘোষণা করে সারাদেশ থেকে এবিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার জন্য সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র একুশ দিন।

 

সংবিধানের ঐ পরিচ্ছেদে স্কুলশিক্ষাকে সার্বজনীন করার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কথা রয়েছে, রয়েছে পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীগুলির প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে তাদের আর্থিক বিকাশের কথা এবং জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের প্রসঙ্গ। সবকিছু বাদ দিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের আগ্রহ এই অশুভ ইঙ্গিত বহন করে যে এক্ষেত্রে এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারিবারিক আইনগুলিকে আদর্শহিসাবে তুলে ধরে ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক আইনে’র ধ্বজা তোলারই চেষ্টা করা হবে। যাতে সংবিধানে ভারতীয় জনগণের সামাজিক বহুত্বকে যে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তার বিনাশ ঘটানো যায়।

 

কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী যদি এ পর্যালোচনার উদ্দেশ্য হয় সমস্ত পারিবারিক আইনগুলিকে বিধিবদ্ধ রূপ দেওয়া তাহলে এর প্রয়োগ হবে মূলত মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ষষ্ঠ শিডিউলের অন্তর্ভুক্ত আদিবাসী এলাকার ক্ষেত্রে। মোটামুটি সব ধর্মের পারিবারিক আইনেই বিবাহ, সম্পত্তি ও অভিভাবকত্বের প্রসঙ্গে নারীর প্রতি নানাধরনের অবিচার ঘটে। শুধু বিধিবদ্ধ করলেই তার সুরাহা হবে না। হিন্দু পারিবারিক আইনেও এমন অসাম্য ও রক্ষণশীলতার কমতি নেই। তার আদলে কোনো অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিশ্চয়ই সংবিধানের উদ্দেশ্যের পরিপূরণ করবে না।

বস্তুত চুয়াল্লিশের ধারাটি এমন বলছে না যে পারিবারিক আইনগুলিকে নাকচ করে সেখানে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে হবে। কারণ কোনো গণতান্ত্রিক সংবিধানই একথা বলতে পারে না যে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির মতামত না নিয়ে, গোষ্ঠীর ভিতর ব্যাপক আলোচনার পরিসর তৈরি না করে রাষ্ট্র কোনো অভিন্ন পারিবারিক আচরণবিধি তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবে। বরং আমরা অনেক আগে থেকেই দেখছি যে ভারতীয় আইনব্যবস্থায় বহুবিধ পারিবারিক আইনের পাশাপাশিই কিছু কিছু জনমুখী আইন প্রণীত হয়েছে যা জাতিধর্মনির্বিশেষে অভিন্নভাবে প্রযোজ্য।

 

এর মধ্যে পড়ছে বিশেষ বিবাহ আইন, যৌতুক নিবারণ আইন, বাল্যবিবাহনিরোধক আইন বা গার্হস্থ্য হিংসা থেকে নিরাপত্তার আইন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ ধারাটিও ভরণপোষণের প্রসঙ্গে সকল নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রেও আইনজ্ঞদের তা প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে যদিও বিগত আশির দশকে কট্টরপন্থীদের কাছে নতিস্বীকার করে রাজীব গান্ধির সরকার জোরজার করে আলাদা মুসলিম মহিলা আইন প্রণয়ন করেছিল।

 

আগামী দিনে ‘পারিবারিক সম্মানে’র নামে তরুণ দম্পতির বিরুদ্ধে অপরাধের মোকাবিলা করতে বা বিবাহোত্তর সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার জারি করতে নারী-আন্দোলনের  দাবি মেনে আইন প্রণীত হলে সেগুলিও হবে জাতিধর্মনির্বিশেষে প্রযোজ্য। তার জন্য পারিবারিক আইনের পর্যালোচনা দরকার হবে না। আবার পারিবারিক আইনের যে কোনো পরিবর্তনের জন্যও আবশ্যিক সেই সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে কী দাবি উঠছে, নারী-আন্দোলন কী দিশা দেখাচ্ছে তার হদিশ।

এমন কোনো সদুদ্দেশ্য যদি পারিবারিক আইন সংস্কারের সরকারি প্রস্তাবের পিছনে থাকত তাহলে তা নিয়ে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে এবং মেয়েদের আইনি অধিকার নিয়ে যাঁরা লড়াই করেন তাঁদের সঙ্গে নানাস্তরে আরো সময় নিয়ে পর্যালোচনা করে তবেই তা নিয়ে এগোনো হত। বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমরা বরং এর উল্টোপথেই বিজেপি-আর এস এস সরকারকে হাঁটতে দেখেছি। এমনকী এই সরকার ইতিপূর্বে ২১তম আইন কমিশনের কাছে যখন সাধারণ দেওয়ানি বিধি নিয়ে পরামর্শ চায় তখন তাঁদের মন্তব্য ছিল, ‘বিষয়টি জরুরিও নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়’।আইন কমিশনের এই পরামর্শ তারা এখন সরাসরিই অগ্রাহ্য করছে।

পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে তাদের অবদান কী? মুসলিম নারীদের এবং সমগ্র নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক মৌখিক তালাকপ্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করল। কিন্তু আমরা দেখলাম এমন অবস্থার শিকার মেয়েদের সুরক্ষা ও ভরণপোষণ আইনত সুনিশ্চিত করার বদলে সরকার ব্যস্ত হয়ে উঠল সাম্প্রদায়িক অভিসন্ধি নিয়ে মুসলিম পুরুষদের জেলে পাঠানোর আইন তৈরি করতে। আরো সম্প্রতি বিজেপি-পরিচালিত কর্নাটক সরকার হঠাৎ কলেজে হিজাব পরা বন্ধ করে মুসলিম ছাত্রীদের একাংশকে শিক্ষাজগৎ থেকেই বহিষ্কার করল।

 

উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ভিন্নধর্মের তরুণতরুণীর মধ্যে বিবাহে বাগড়া দেবার জন্য ‘লাভ জিহাদে’র মিথ্যে ধুয়ো তুলে ধর্মান্তরণ-বিরোধী অধ্যাদেশ বা আইন চালু হল।

বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ নথিভুক্ত করার আগে একমাস নোটিস দেবার নিয়মটি জাতিধর্মনিরপেক্ষ বিবাহের ক্ষেত্রে বিপদ তৈরি করতে পারে। তা রদ করার জন্য নারী আন্দোলন থেকে যে দাবি উঠছে তাতে কর্ণপাত করছে না সরকার। কারণ স্বনির্বাচনে পারিবারিক হস্তক্ষেপের সুযোগ পুরোই রেখে দিতে চায় তারা। সদ্যোবিবাহিত তরুণতরুণীর ওপর পারিবারিক সম্মানের নামে সংঘটিত অপরাধ, এমনকী খুনজখম বলপূর্বক আটকে রাখার দায়ে অভিযুক্ত পরিবার ও খাপ পঞ্চায়েতগুলি যাতে উপযুক্ত শাস্তি পায় তার জন্য ২০০৫ সাল থেকে বলা হচ্ছে একটি সামগ্রিক আইনের কথা। আইনের খশড়াটি যে দীর্ঘদিন সরকারি দপ্তরে পড়ে আছে সেবিষয়ে অন্ধ ও বধির হবার ভাণ করছে তারা।

সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মেয়েরাও পায় না সন্তানের অভিভাবকত্ব, পায় না বিবাহের পরে অর্জিত সম্পত্তিতে যৌথ অধিকার। বহুবার অনেক নারী-সংগঠন এইসব দাবি তুলেছে। শাসক তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। ২০০৫ সালে হিন্দু পারিবারিক আইনে যে সংশোধনীটি বিবাহিত কন্যাদের পৈতৃক ভূসম্পত্তিতে সমান অধিকার সুনিশ্চিত করেছিল উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড প্রভৃতি বিজেপি-শাসিত রাজ্যে তার রূপায়ণ আটকে রাখা হয়েছে রাজ্যভিত্তিক কিছু আইনের অজুহাত তুলে। সুতরাং এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে হিন্দু মেয়েদের সমানাধিকার নিয়ে তারা চিন্তিত।

আমাদের আশে পাশে এমন মানুষও আছেন যাঁরা মনে করেনঃ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হলেই বা আমার কী? আমি তো মুসলিম নই। এতে যদি মুসলিমদের একাধিক বিবাহ বন্ধ হয় তাহলে আপত্তির কী? পুরুষের বহুবিবাহের অধিকার স্ত্রীর পক্ষে অসম্মানজনক তাতে সন্দেহ নেই। প্রথাটি বন্ধ হওয়াই দরকার। বস্তুত আমাদের দেশে মুসলিমদের মধ্যে এর প্রচলন বর্তমানে খুবই কম। মুশকিল হল আইনত বহুবিবাহ রদ হলেই যে স্ত্রীর সতীত্বের দায়ের বিপরীতে পুরুষের বহুগমনের অধিকার নাকচ হয়ে যায় না এদেশের হিন্দুসমাজ আজও তার অজস্র প্রমাণ বহন করছে। হিন্দুদের এক স্ত্রীকে স্বচ্ছন্দে পরিত্যাগ করে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে ঘরবাঁধার ঘটনা মুসলিমদের বহুবিবাহের উদাহরণের চাইতে সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে কম হবে না। হিন্দুপরিবারে দ্বিতীয় মেয়েটি পায় না স্ত্রীর আইনসঙ্গত অধিকারও। মুসলিমসমাজের আইনি গলদের দিকে নজর ঘুরিয়ে আসলে চাপা দেওয়া হচ্ছে এই বাস্তবকে যে, যেকোনো ধর্মীয় আইনের মধ্যেই মেয়েদের ন্যূনতা স্বীকৃত, তার অধিকার সীমাবদ্ধ। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক ঘৃণা চাগিয়ে তোলা, জাতিধর্মনির্বিশেষে পরিবারের মধ্যে মেয়েদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা নয়। এই অধিকারপ্রতিষ্ঠায় পরিবার ও সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। শাসকের মুখে অভিন্ন দেওয়ানি আইনের জিগির সেই দায়িত্ব থেকে আমাদের রেহাই দিতে চাইছে। বিনিময়ে

আমাদের বানাতে চাইছে এক ভয়ংকররকম দ্বিধাবিভক্ত সমাজের বশংবদ করসেবক। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে এই কি আমরা চাই?