ব্যতিক্রমী শিক্ষামন্ত্রী ভৃত্যবোস ব্যতিক্রমী শিক্ষকদের হয়ে সওয়াল করেছেন। জর্জ অরওয়েল “পশু খামারে” দাবী করেছেন, সব পশু সমান। আবাস যোজনায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ ব্যতিক্রমী অট্টালিকাবাসীর নাম। সঙ্গীতা চক্রবর্তী কেষ্টঠাকুর মন্ডলের বর্বরোচিত আক্রমণের এফআইআর করেছিলেন। ব্যতিক্রমী পুলিশ শিবঠাকুর মন্ডলের অভিযোগে কেষ্টঠাকুরকে গ্রেপ্তার করল। পশু খামারে আরো ছিল, কোনো পশু কাপড় পরিধান করবে না। ফলে কোনো ব্যতিক্রমী শিশু বলে উঠবে না, রাজা তোমার পোশাক কোথায় ?

ব্যতিক্রমী জেলবাসীরা মুক্ত আকাশের নিচে থাকা মানুষদের আগামী বছর ভাল থাকতে বলছেন! বোমা ফেটে বাড়ির শিশু মরলে ব্যতিক্রমী শাসকের অনুগামী বাপমা বলে বাজী উৎসবে ভাল আছে। দমকলে নিয়োগে ব্যতিক্রমী তালিকা বাতিল। আবাসের দূর্নীতিতে ভরতপুরে শাসকদের পঞ্চায়েতের ব্যতিক্রমী গণপদত্যাগ। কিন্তু পশুখামারে আরো লেখা আছে, কোনো পশু কোনো পশুকে হত্যা করবে না। তাহলে কি আমাদের ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী চিটফান্ড, নারদের ব্যতিক্রমী তদন্তের মত সব ধামা চাপা দিয়ে দেবেন?

পশুদের নেতা নেপোলিয়ান জিরো টলারেন্স, এবং পশুদের স্বার্থে বৈভবময় জীবন কাটাতে শুরু করলেন। কার্নিভাল থেকে ক্যারল, ফিল্মফেয়ার থেকে বুকফেয়ার, হেলিভ্রমণ থেকে লঞ্চচালনের স্ফূর্তি। পশুদের সেবা দেবার মালিক দরকার। একটা সেনাপতি দরকার যে চাবুক মারবে। বুদ্ধিজীবী সোজা হয়ে দাঁড়ালে ব্যতিক্রমী পুলিশ ধরবে। কারণ জর্জ অরওয়াল বলেছেন, দু পেয়েরা শত্রু। চোর্কুনাল থেকে স্কোয়ার ফুট সেন ব্যতিক্রমী উন্নয়নের কথা বলে যাবেন। পশু খামারকে দুপেয়ে শূণ্য দূর্নীতির আখড়া বানাতে হবে।

মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি খোঁজা কোন দিন শেষ হবার নয়, বিশেষতঃ আমীর ওমরাহদের। স্বর্গসুখ-সন্ধানী জনজাতি ভলগা থেকে গঙ্গায় পৌঁছেছে। কৃষক, কারিগর, মেষ পালকদের গোষ্ঠীতে টিঁকতে অনুসরণে বাধ্য। ব্রাক্ষ্ণণ্যবাদ থেকে ঐস্লামিক তরবারি হয়ে ব্রিটিশ কামানের তোপের মুখে খড়কুটো জীবন। ওরা টুসু পরবে কিংবা ঋতু পরিবর্তনের এজমালি গানে মুখে কুলুপ এঁটে জন্ম জন্মান্তরে বেঁচে থাকতে চায়। কোনো দানবী সিঙ্গুরে টাটা কারখানা গিলে ব্যতিক্রমী দূর্নীতির মলত্যাগ করলেন, এত শত বোঝে না।

ব্যতিক্রমী দিদি নন, উগান্ডার ইদি আমিন দাদা বিপুল আকাঙ্খায় নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অশিক্ষিত রাঁধুনী থেকে সোয়া ছ’ফুটের ১৩০ কেজির ইদি দেশের প্রেসিডেন্টের তখতে। দুর্ভাগ্যবশতঃ প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মিল্টন ওবেতের মত শিক্ষিত ও সমভোগে বিশ্বাসী স্বাধীনতা সংগ্রামী ইদি আমিনের উথ্থানে সহায়ক ছিলেন। দিদি হোক বা ইদি, এঁরা দরিদ্র মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। ইংরাজ আমলে প্রশাসন, ব্যবসা, ব্যাঙ্কিং ছিল ভারত, পাকিস্তান সহ এশিয় বংশদ্ভুতদের নিয়ন্ত্রণাধীন।

১৯৭২ সালে তিন মাসের মধ্যে সমস্ত এশীয়বাসীদের এক কাপড়ে দেশ ছাড়া করেন ইদি আমিন দাদা। উগান্ডার অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেছিল। সবে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়েছে। পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তুর ঢল। কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ বহু দেশ ভিটাহীন এশিয়দের পুনর্বাসনের ব্যবস্হা করে। উগান্ডা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়। ভোগলিপ্সা বাড়ে ইদি আমিনের। কথিত আছে নারী সম্ভোগের পর তাদের কষিয়ে রান্না করে খেয়ে ফেলতেন। কিন্তু ব্যতিক্রমী উন্নয়ননীর জনসমর্থনে ভাটা পড়েনি।

হিটলারের যেমন ছিলেন মুসোলিনি, দিদির প্রকৃত বন্ধু মোদী, তেমন ইদি আমিনের সহায়ক ছিলেন মরু বেদুঈন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গদ্দাফি। ছাত্রাবস্হায় মিশরের প্রেসিডেন্ট গামেল আবদেল নেসারের ভক্ত ছিলেন। নেসার ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা পাবার পর ভারতের মত সোভিয়েত মদতে মিশরকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গদ্দাফি তেল ও ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণ করে জনতার চোখের মণি হয়েছিলেন। কিছু দিনেই ব্যতিক্রমী স্বৈরশাসনের দাঁত ও নখে ৪২ বছর শোষণ।

লিবিয়ার মন্ত্রী আমলারা ছিলেন কেবল চেয়ারে বসা পুতুল। কখন ও কীভাবে যে দেশের ভাগ্যের চাকা ব্যতিক্রমী শাসক একক হাতে ঘুরিয়ে দেবেন তা কেউ অনুমান করতে পারত না। প্রশাসনের একমাত্র কাজ ছিল গদ্দাফির ইবাদত করা। পরিবারের লোকরা বিপুল ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে উঠেছে। এই ব্যতিক্রমী শাসক কি জনসমর্থন হারিয়েছিলেন? ইতিহাস বলে, জনগন ক্ষমতার পূজারী। সুশীল, নাকি দুঃশীল বিচার্য নয়। সুশীলদের ভাগে বেশী পড়ে বলে মীরজাফররা সুশীলদের থেকেই উঠে আসে।

বড়ছেলে অলিম্পিক অ্যাসোশিয়েশন, মেজোছেলে ফুটবল ফেডারেশন, সেজো চিত্রকর হলেও চিকিৎসা ছিল ব্যবসা ক্ষেত্র ইত্যাদি। মেয়ে আয়েশা সাদ্দাম হোসেনের উকিল হয়ে মামলা লড়েছেন। ইদি আমিন ছিলেন জাতীয় বক্সিং চাম্পিয়ান, মুয়াম্মার গদ্দাফি জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য। হুইল চেয়ারে বসেও খেলতে পারেন স্বৈরাচারীরা। ২০০৩ সালে সাদ্দামের পতনে সানগ্লাস পরা কালারফুল গদ্দাফি নিয়ন্ত্রিত হবার চেষ্টা করলেও খেলা হাতের বাইরে চলে গেল। তারপর হাইড্রেন থেকে বার করে নৃশংস হত্যা।

উগ্র জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টির সাদ্দাম হোসেনও নাকি গামেল আবদেল নেসারের অনুসারী ছিলেন। দলের নেতা কাসিমের হত্যাকারী ও কারাদন্ড সাজাপ্রাপ্ত সাদ্দামকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আল-বাকর সাদ্দামকেই ডেপুটি নির্বাচিত করেন। সেখান থেকে একটি ধাপ উঠে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল সাদ্দামের বাঁ হাতের খেলা। প্রায় ২২বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সাদ্দামের পুত্র উদয়ের নামকরণ করেন ইন্দিরা গান্ধী। ইরান তথা কাতার আক্রমণ তো পরের ইতিহাস। আর আছে উদয়দের হারেমের উদ্দীপক চিত্র।

যে মার্কিন শক্তি আল-বাকরকে ক্ষমতাচ্যুত করে সাদ্দাম হুসেনকে প্রধানমন্ত্রীর কর্সিতে আসীন করে, সেই মার্কিনি বিচারসভায় ২০০৬ সালে সাদ্দামকে ফাঁসীর ফান্দায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ঐস্লামিক দুনিয়া বিশেষ করে সুন্নি সম্প্রদায় এখনও তাঁকে বীরের সম্মান দেয়, কিন্তু সাদ্দাম ও তাঁর বিলাসী বংশধররা যে কতটা ভোগ ও সম্ভোগপ্রিয় ছিল তা ঐতিহাসিক সত্য। তাঁর মৃত্যুতে বহু লোক আনন্দ করেছে, বহু লোক কেঁদেছে। যাঁরা আনন্দ করেছে, আগের দিন পর্যন্ত ইরাকের উন্নয়নের প্রশংসায় মুখরে বাধ্য ছিল।

সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতায় এসে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। বিরোধীদের মুখে সেলোটেপ লাগিয়ে দেবার মত। কারান্তরালে তাঁদের মৃত্যু হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের চেয়ে কম ছিল না। যে কারাগারে সাদ্দাম বহু বিরোধীকে ফাঁসিতে লটকে ছিলেন, সেখানেই তাঁর চিরনিদ্রার স্ক্রিপ্ট লেখা হচ্ছিল গোপনে। তিনি নিজের রক্ত দিয়ে একটি আস্ত কোর-আন লিখেছিলেন। অবশ্যই জনমোহিনী প্রকল্প হাজির করেছিলেন, শোষণের রক্তগঙ্গা গোপন রেখে। ফলতঃ শেষ অবধি ইরাকের কোনও ফায়দা হয়নি।

স্বৈরাচারী শাসকরা চিরকাল তাঁদের সংস্কৃতি দখলীকৃত জমিতে স্হাপিত করার প্রয়াস করে। মূল বিষয় আপনার ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি কতটা সবল ছিল, তার উপর নির্ভর করে প্রতিরোধ। একদা খ্রীষ্ট ধর্মালম্বী ইউরোপিয়ানরা প্রায় পুরো বিশ্ব শাসন করেও ইসলামের তুলনায় ধর্ম বিস্তার তুলনায় কম ছিল। আবার মুসলিম অটোমেন সাম্রাজ্য সমগ্র মধ্য এশিয়া, আফ্রিকার উপকুল, তুরষ্ক, তথা স্পেন পর্তুগালে ৭০০ বছর রাজত্ব কায়েম করার পরেও স্পেন পর্তুগালে খ্রিষ্টধর্ম স্বমহিমায় ধর্ম ফিরেছে ঐতিহ্যের নিরিখে।

স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক পরিবারবাদ দূর্নীতিকেই ব্যতিক্রমী মুখোশের আড়ালে নীতিতে পরিবর্তিত করতে চাইবে। ইতিহাস জাতিকে সেই দুর্গম কয়েদখানা থেকে মুক্তির আলোক রেখার সন্ধান দেবে। মাসোহারী হায়নাদের এড়িয়ে আবার নীতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই প্রমাণ হবে একদা বাঙালী নীতিনিষ্ঠ ছিল। কাজটা কঠিন। মীরজাফর, ঘসেটি বেগম, জগৎশেঠ, রায়দূর্লভ, ঊঁমিচাঁদদের ক্ষমতার আস্ফালনের পেছেনে আমরা কয়জন ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশের বলিদান দিতে পারব ভাবুন।

এমন একটা সময় ছিল, যখন উগান্ডাবাসী ইদি আমিন দাদা, লিবিয়ার অধিবাসী মুয়াম্মার গদ্দাফি বা ইরাকের জনগন সাদ্দাম হুসেনের উন্নয়নের পর আর কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। সুশীল, মিডিয়া, প্রশাসন, বিচারব্যবস্হা, সেনা-পুলিশ সব স্বৈরতন্ত্রের হাতের পুতুল। এঁদের বংশধররা সেই রাজত্বকালে উপভোগের চুড়ান্ত সীমায় পৌঁছালেও পরে ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেননি। তাঁদেরকে সেনাপতি বানিয়ে চাটুকাররা ফায়দা হাসিল করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। সেই সেনাপতিদের ভবিষ্যৎ সুখকর নয়।

এদের হাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবে, গ্যাবনের আলি বঙগো ওডিম্বা, নাইজিরিয়ার মুহাম্মুদু বুহারি, ক্যামেরুনের পল বিয়া, সুদানের অল-বশির, রোয়ান্ডার বস্কো বা কামবান্ডা, কঙ্গোর লুবাঙ্গা, লাইবেরিরার টেয়লর, মৃত্যু সরণীতে ক্ষমতা আগলে রেখেছেন। এই ব্যতিক্রমী সরকারের সমস্যা কেবল আপনার নয়। ঈশ্বর বলে কেউ থাকলে তিনি দেবদূতের বদলে মানুষের ভুল চাহিদায় যমদূত পাঠাতে বেশী আগ্রহী। অশিক্ষিতদের সমস্যা, আয়না দেখতে শেখেননি।

কম্প্যুটারে আমরা যদি কিছু সন্ধান করি, তাহলে কিছুটা সময় লাগে। কিন্তু যদি আগে অনুসন্ধান করি, তাহলে তা System Global Areaএ সন্ধানী তথ্য মজুত থাকার ফলে খুব দ্রুত retrieve হয়। আমাদের আজকের সমস্যা মানবেতিহাস আগেও পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সেখানে সমস্যার সমাধান আছে। সেই আয়নায় আমাদের বর্তমানকে বিচার করতে হবে। ব্যতিক্রমী বিশ্ববঙ্গ সরকারের আগে ইদি আমিন দাদা থেকে মুয়াম্মার গদ্দাফি, সাদ্দাম হুসেনের ইতিহাস লেখা আছে। আছে মুসোলিনী-হিটলারের কথা।

মানুষ এঁদের ব্যতিক্রমী হবার সুযোগ দিয়েছে। ভিতরের পশুত্ব না থাকলে ব্যতিক্রমী হওয়া যায় না। শুধু এটুকু গুণ আছে ওঁদের। জ্যোতি বসু দাঁড়িয়ে থেকে সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে উদ্বোধন করিয়েছিলেন নন্দন পেক্ষাগৃহ। এইটুকু ব্যতিক্রমী হবার ঔদার্যও এঁদের নেই। ইতিহাস কালি ও কলম নিয়ে বসে আছে। সেখানে আপনার কথাও লেখা হবে, লেখা থাকবে আপনার প্রতিবাদের ভাষা। ঠাকুমার ঝুলির সেই রাক্ষসীর প্রাণ ভোমরা হ্রদের তলায় কালো ভ্রমরের ভিতর। জন-সাধারণ এক কোপে কাটবেই।

লেখকের ব্যক্তিগত মতামত