বিপন্নতাকে বন্দনা করেছেন , ক্যামেলিয়ার বন থেকে সন্ত্রস্ত গৃহযুদ্ধের সড়কে তার অবাধ ভ্রমন । তাঁর কবিতায়,নাটকে এক সুন্দরের মায়াজাল , বুঁদ করে যাওয়া হাতছানি । আশ্চর্য এক কুহক । সমকালীন কাব্যে তাঁর স্থান একেবারে প্রথম সারিতেই।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।

স্পেনের উদার বামপন্থী কবি, নাট্যকার ও মঞ্চনির্দেশক। জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ জুন স্পেনের সানাডা শহরের কাছে। বালক লোরকা শুরু থেকেই অন্যরকম। প্রাণশূন্য বস্তুর সঙ্গেও কথা বলত সে, যেন ওই বস্তুর প্রাণ আছে, সে তার কথা বুঝতে পেরে তার সঙ্গে কথা বলছে। তাঁর সংগীতের হাতেখড়ি ঐ সময়েই। কিশোর বয়সে কবিতা লেখা শুরু। স্থানীয় ফুয়েন্তে ভাক্যুয়েরসের স্থানীয় কাফেতে কবিতাগুলো পড়া হতো। দর্শন ও আইন পড়ার জন্য তরুণ বয়সে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও হঠাৎই আইন বাদ দিয়ে শিল্প-সাহিত্য ও মঞ্চ নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। ১৯১৯-এ  গেলেন মাদ্রিদ। ওটাই তখন স্পেনের তাবৎ শৈল্পিক আন্দোলনের কেন্দ্র। মাদ্রিদে মঞ্চ নিয়ে মতে উঠলেন। জনসমক্ষে কবিতাও পড়তেন। সে সময় একদল দারুণ রোমান্টিক আলোকিত মানুষ একসাথে ছিলেন মাদ্রিদে। সেই মানুষগুলোকে একসাথে ডাকা হত  ‘জেনেরাসিওন দেল টুয়েন্টি সেভেন’ নামে । কে নেই সেখানে – সালভাদোর দালির মতন আঁকিয়ে; বুনুয়েলের মতন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও রাফায়েল আলবারটির মতন কবি। এদের মধ্যে সালভাদোর দালির সাথে তাঁর ছিল গভীর বন্ধুত্ব। বিংশ শতকে শিল্পকলা ও সাহিত্যে বিশ্ব তোলপাড় করা এই দুই স্প্যানিশ প্রতিভার কিংবদন্তি বন্ধুত্ব এখনো শিল্প-সাহিত্য বোদ্ধাদের উজ্জীবিত-অনুপ্রাণিত করে। আর লোরকা নিজেই  ছিলেন সেই ‘২৭ এর জেনেরেশনের’ এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র !

১৯২০ সালে প্রথম মঞ্চায়ন করলেন তারই লেখা ‘দ্য বাটারফ্লাইস ইভিল স্পেল’ নাটকটি। নাটকটি ছিল বহুল প্রশংসিত। ১৯২১-এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয়। এর আগে বিভিন্ন লিটল ম্যাগ-এ লেখা ছাপা হতো।  ১৯২৮ সালে বের হলো লোরকার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ; ‘দ্য জিপসি ব্যালাড।’ এটিই সমগ্র স্পেনজুড়ে লোরকাকে কাব্যখ্যাতি এনে দিল। স্পেনের মানুষের কাছে লোরকা হয়ে গেলেন ‘জিপসি কবি’।

লোরকার কবিতায় আমরা পাই দক্ষিণ স্পেনের কথা, আন্দালুসিয়ার কথা, জিপসিদের কথা, বিপ্লবের কথা, গ্রানাদার কথা, আর সিভিল ওয়ারের কথা । বেশ কিছু কবিতাই রুপকার্থে লেখা, পড়লে মনে হবে প্রকৃতি নিয়ে লেখা বা প্রেম নিয়ে কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যায় তার মধ্যে অনেক ক্ষত। স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের বিরুদ্ধে লোরকা, পাবলো পিকাসো আরও অন্যান্য সহশিল্পীরা প্রতিবাদে পথে নামেন। স্বৈরাচারী জেনারেল ফ্রাঙ্কো বাহিনীর চরম শত্রুতে পরিনত হন তিনি।  

তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘La Guitarra’এ তিনি তুলে ধরেছিলেন ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী শাসনকালের বীভৎস দিক যখন দেশ জুড়ে একের পর এক তরতাজা যুবকের প্রাণ ঝরছিল, আর তাই গীটারের শব্দও কান্নার মত লাগছিল তাঁর –

‘গীটারের বিষাদ মূর্চ্ছনা শুরু হল,
ঊষার পেয়ালাকে খানখান করে ভেঙে দিয়ে
গীটারের বিষাদ মূর্চ্ছনা শুরু হল,
চুপ করে থাকা আজ অর্থহীন,
নিস্তব্ধতা একেবারে অসম্ভব’’।


১৯৩৬ সালের জুলাইয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরুর দিকে তিনি মাদ্রিদ থেকে গ্রানাদায় পারিবারিক বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। স্পেনের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি তখন চরমে। লোরকা জানতেন, তাঁর উদারবাদী বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উদীয়মান উগ্র দক্ষিনপন্থীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ১৮ অগাস্ট, তার ভগ্নিপতি, গ্রানাদার বামপন্থী মেয়র মানুয়েল ফের্নান্দেস-মন্তেসিনোসকে গুলি করে মারা হয়। এর পরদিনই ১৯ আগস্ট ফ্যাসিবাদীরা তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ গুম করে ফেলে। আজও তাঁর মৃতদেহের হদিস পাওয়া যায়নি। ‘ব্লাড ওয়েডিং’, ‘ইয়েরমা’, ‘দ্য হাউস অব বারনারদা আলবা’র মতো কালজয়ী নাটকের স্রষ্টা লোরকার মৃত্যুকালে বয়স ছিল মাত্র ৩৮ বছর।

পাবলো নেরুদা তাঁর আত্মজীবনীতে, লোরকা সম্বন্ধে  স্মৃতিচারণ করেছেন – “আমি দেখেছি, স্পেনের এক মিলিয়ন মানুষ মৃত। এক মিলিয়ন নির্বাসিত। মনে হচ্ছিলো মনুষ্য জাতির বিবেক থেকে একটা রক্তাপ্লুত কাঁটা কোনদিন তুলে ফেলা যাবে না। আমার জন্য এর শুরু ১৯৩৬ এর ১৯ অগাস্ট। আমার কবিতাকে-বদলে-দেয়া স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ, আমার জন্য শুরু হয়েছিলো একজন কবির অন্তর্ধান দিয়ে। আহা, কি কবি !   ফেদেরিকো লোরকা ছিলো বাঁধন–ছেঁড়া, এক চুম্বক-স্পন্দন যুগ-যুগের গণসংস্কৃতির স্পেনের চূড়ামণি। আরব-আন্দালুসিয়ার শিকড় থেকে থেকে জ্বলে উঠেছিলো, জুঁই ফুলের সুগন্ধে ভরিয়ে দিয়েছিলো স্প্যানিশ স্টেজ, হায় ! যা আজকাল চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত’’।

ফেদেরিকো লোরকাকে শুধু গুলি করা হয় নি, তাকে হত্যা  করা হয়েছিলো।