মহিলা আবার শ্রমিক কিসের? হয় বিনা পয়সার বেগার খাটবে, অসম্মানে, অবহেলায় অথবা গতর খাটিয়ে পয়সা দেওয়ার জায়গা হলে মনে করিয়ে দেওয়া হবে, “এবিলিটি” কম। তা শারীরিক পরিশ্রম হোক বা মানসিক। প্রথম ক্ষেত্রের একটা চমৎকার উদাহরণ দেখেছিলাম নোটবন্দীর সময়ে। মিম আর জোক্স এ ইনবক্স আর সোস্যাল মিডিয়া ভরে গেছিল। “বরের পকেট মেরে জমানো, পাঁচশ টাকা গুলো কি করে ভাঙাবে!” হি হি আর হো হো করে কত “সচেতন” লোকজনও তা শেয়ার করেছে৷ কথা হল – বরের পকেট “মারতে” হয় কেন! যারা পরোক্ষভাবে সামাজিক অর্থনৈতিকচক্রের সাথে জড়িত হয়ে দিনের পর দিন ভূতের খাটুনি খেটে মরছেন, যার হাফ ডে নেই, সবেতন ছুটি নেই, মেডিকেল লিভ নেই, যিনি সব রকম শরীর খারাপেও হাঁড়ি ঠেলে যেতে বাধ্য, কথায় কথায় পয়সা না রোজগারের ঠোনা শুনে আর মুখ নামিয়ে লোককে “কিছু কাজ করিনা, হাউসওয়াইফ” বলার ফাঁকে একজন “হোম-মেকার” হেরে যান, হেরে যান সেই মানুষটা যিনি হাড়িটা চড়ান বলে কেউ কেউ পেটে ভাত দিয়ে অফিসে, স্কুলে যেতে পারে।
তাঁকে পয়সা “চুরি” করতে হয়, আর তা নিয়ে আমরা রসিকতা করি অনায়াসে! অনেকের মত – “সব কিছু নিয়ে অত ভাবার কি আছে৷ এগুলো নিছক মজার ছলে বলা!” মজা করা যায় সব কিছু নিয়ে! মানুষের দুর্বলতার ফোঁড়াকে খুঁচিয়ে ঘা করে মজা করা যায় না। সব হারানো কাঁটাতার পেরোনো মানুষকে ডেকে হাসতে হাসতে তার পিঠের দাগ দেখতে চাওয়াকে মজা বললে, গায়ের রং কালো বলে আত্মহত্যার কথা ভাবছে যে মেয়েটি তাকে “আলকাতরা” নাম দেওয়াকে মজা বললে দুনিয়া থেকে এমন মজা-তামাশা লোপ পাওয়ার কথাও বলতে হবে সোচ্চারে!
আর “এবিলিটি” র কথা বললে উঠে আসে তেভাগা আন্দোলনের কথা। তার অনান্য দাবীগুলোর মধ্যে একটা ছিল পুরুষ কৃষকের সামান সময় খাটলে চাষের কাজে একজন মহিলা কৃষককেও সেই একই পরিমাণ টাকা বেতন দিতে হবে, কারণ শারীরিক ক্ষমতা কম এই অজুহাতে তখন মেয়েদের এইক্ষেত্রে একই বেতন দেওয়া হত না৷ আর, মজার কথা হল, ‘মেয়েমানুষ’-এর প্রশ্নে অনেকক্ষেত্রেই কিন্তু শ্রেণী ঐক্য লক্ষ্য করা যায়! যেমন – একটা বিখ্যাত শ্যাম্পুর কম্পানি কম পয়সার শ্রমিক খুঁজতে গিয়ে পৌছায় মধ্য এশিয়ার তেহেরানের দক্ষিণ অঞ্চলে। সেখানে কারখানার অফিসে কাজ করা হাই প্রোফাইল কর্পোরেট মহিলা অফিসারদের একই যুক্তিতে বেতন কম দেওয়া হত। পরে তা সংশোধন হয়। অথচ নির্দিষ্ট পেশাভিত্তিক দক্ষতা অনুযায়ী কিন্তু মেয়েদেরই খোঁজ চলে। যেমন – হাতেবোনা কুরুশের কাজের কম্পানি, নার্সিং এর কাজ, মেশিনে ফ্রোজেন চিকেন কাটার কম্পানি (আঙুল সরু হয় বলে মেশিনের নীচ থেকে মাংসের টুকরো বার করতে সুবিধা হয়), বিড়ি বাঁধাই এর কাজ (আঙুল সরু হয় বলে), জড়ি-রেশম সুতোর কাজ, চা পাতা তোলার কাজ (একই কারণে) নিংড়ে নেয় তাদের শ্রমশক্তি।
চিকেন কাটার এমন এক ইউরোপীয় কম্পানি সেখানকার কসাইখানায় মহিলা শ্রমিকদের কাজ করার সময় প্রায় দশ ঘন্টা ডায়পার পরে কাজ করতে বাধ্য করত, কারণ ওই মাংস কাটার মেশিন একবার চালু হয়ে গেলে আর বন্ধ করা যায় না। তাই মানুষের রেচন ত্যাগের অধিকার টুকুও কেড়ে নেওয়া যায়। পরে সেখানকার বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলন করে একাজ বন্ধ করে ৷ মালদা মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে এখনো মুনসিরা ধমকে চমকে মহিলা শ্রমিকদের (এমনকি গুরুতর অসুস্থ হলেও) দিয়ে জোর করে কম পয়সায় বিড়ি বাঁধিয়ে নেয় নানা ছলছুতোয়।
অথচ আন্তর্জাতিক নারি দিবস নিয়ে হইহই করে প্রসাধনী কম্পানিতে ৫০% ছাড়ের ফাঁকে হারিয়ে যায় “শ্রমজীবী” শব্দটা। তার ফলে বারো মাসই তো নারীদিবস অথবা মেয়েরা সমান হলে আলাদা করে ইউনিয়ন, কনভেনশন, বাসে সিট, চাকরির পদের দরকার কি এইসব উদ্ভট অগভীর চিন্তার জন্ম হয়। শ্রমজীবী শব্দ উঠে যাওয়ার কল্যাণে শুধু ওমেন’স ডে তে তাই থাকে না কোন গর্ভবতী মহিলার সবেতন ছুটির দাবী, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি জানানোর জন্য আলাদা সেলের দাবী, সম কাজে সম বেতনের দাবী, নিজের শরীরের ওপর নিজের সম্পূর্ণ অধিকারের দাবি, চাকরি ক্ষেত্রে পৃথক শৌচাগারের দাবী ইত্যাদি

তাই এক্ষেত্রে অতিসচেতন থাকতে হবে আমাদের। “শিশু” আর “শ্রমিক” শব্দ দুটো মধ্যে যেমন আপ্রাণ দূরত্ব বজায় রাখব, ঠিক তেমনই “শ্রমজীবী” শব্দটার থেকে “মহিলা” শব্দটার দূরত্ব বাড়াতে দেব না।