“সেদিন ওদিক থেকে বক্তৃতা দিলেন শ্রী শংকর দাস ব্যানার্জি তিনি আমাদের বললেন যে আমরা নাকি রাইটার্স বিল্ডিং ক্যাপচার করবো বলেছি। আমরা বলেছিলাম রাইটার্স বিল্ডিং যাব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙবো, দলে দলে ১৪৪ ধারা ভাঙবো, একজন দুজন করে নয়, হাজার হাজার লোক ১৪৪ ধারা ভাঙবো, রাইটার্স বিল্ডিং ক্যাপচার করব একথা বলিনি। এখানে এইভাবে মিথ্যা কথা সাজানো হয়েছে যাতে করে তারা এই দমননীতি চালাতে পারেন। এই কথা আবার বলতে হচ্ছে, এ কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে, ৩১ তারিখে পুলিশের গায়ে আঁচড়ও পড়েনি, আঁচড় না লাগলেও ১৪ হাজার কনস্টেবল সমস্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছন থেকে। সামনে থেকে, চারপাশ থেকে, এবং লাঠিপেটা করলো লোকের উপর। এবং ছাত্রদের উপর ১লা তারিখে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে। এখানে এমন চমৎকার ঘটনা ঘটে গেল যে পুলিশ কতকগুলি কেস, মামলা শুরু করল এবং অমর বসু প্রভৃতি কয়েকজন কে সেই লক্ষ্যে আটকে রাখবার চেষ্টা করল এই বলে যে পুলিশের উপর এরা আক্রমণ করেছে। এইভাবে ওয়েলিংটন স্কোয়ার এর সামনে ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে দুইটি মামলা সাজাবার চেষ্টা করলেন সে দুইটি মামলাই ভেস্তে গেল। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট কিছু দেওয়া হয়নি অথচ বারবার পুলিশের কাস্টডিতে রাখা হচ্ছে এবং জিজ্ঞাসা করলেই বলা হয় যে ইনভেস্টিগেশন শেষ হয়নি। এমনকি চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে এই দুইটি মামলার ডায়েরি পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। তিনি বললেন যে বারবার আপনার এড্রেস নিচ্ছেন অথচ এর ডায়রী পর্যন্ত নেই কোনো মামলা এদের বিরুদ্ধে নেই এই জন্য এদের ছেড়ে দিলাম। দুইটি ক্ষেত্রেই এই জিনিস দেখতে পেলাম। ৩১ তারিখে এবং ১লা তারিখে মিথ্যা মামলা করা হলো এবং তারপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হল।


এই জিনিস আমরা দেখলাম এবং এরপর আমরা দেখেছি আগেও এসব ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখলাম পণ্ডিত নেহেরু তাদের পার্টি মিটিংয়ে কংগ্রেস নেতা হিসেবে বলেছিলেন যে পশ্চিমবাংলায় যা হয়েছে তাতে পশ্চিমবাংলা কলঙ্কিত হয়েছে ভারত বর্ষ কলঙ্কিত হয়েছে এবং তার কন্যা ও বলেছিলেন গণতন্ত্রের বিপদ, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিপদ। একথা তিনি বলেছিলেন। আমরা ভাবলাম কেরলে যে অভিজ্ঞতা রয়েছে তার পর অন্তত তিনি এখানেও গণঅভ্যুত্থান দেখতে পাবেন। এখানে দু-দুটো জেনারেল স্ট্রাইক, স্টেট ওয়াইস সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়ে গেল, কোথাও কি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখতে পেলেন না? এমন শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট কি কোথাও দেখেছেন? কিন্তু সে জিনিস তো হল না, পন্ডিত নেহরু সেদিকে তো নজর দিলেন না, তিনি এখানে গণঅভ্যুত্থান দেখলেন না, কেরোলি তিনি গণঅভ্যুত্থান দেখলেন। আরো তিনি বললেন যে অ্যাসেমব্লির ভিতর পবিত্র জায়গা, এখানে বিধানসভায় যে জুতো ছোড়াছুড়ি হয়েছে সেসব কথাও তিনি বললেন। আমি সেখানে বলতে চাই এটা সত্য কথা, যে গণতন্ত্রের বিপদ আমরা ওদের দেখেছি পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির বিপদ আমরাও দেখছি – কিন্তু সেটা কি শুধু এত দিনের মধ্যে অ্যাসেম্বলির ভিতরে যে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার বেলাই খাটে? তা নয়। এইযে প্রবিত্র জায়গা এটা কি শুধু অ্যাসেমব্লির ভিতর! পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি কি আমরা যখন বাইরে যাব কিংবা মাঠে-ময়দানে যাব সেইখানে, মাতৃভূমির আর কোন স্থানে কি পবিত্র জায়গা নেই? তিনি কি আর কোন জায়গা পবিত্র বলে জানেন না, শুধু কি অ্যাসেম্বলির হাউজের ভিতরে পবিত্র জায়গা বলে পন্ডিত নেহরু ঠিক করেছেন? পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি কি বাইরে থাকবে না – শুধু  কি এর ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে? এটাই কি তিনি ঠিক করেছেন? কারণ এর একটু মুশকিল আছে। কারণ বাইরে কি হচ্ছে। এমনই পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি যে আমি নাকি লিডার অফ অপজিশন এমনই লিডার অফ অপজিশন যে আমার নামই হচ্ছে প্রথম লিস্ট – এর মধ্যে যাকে বিনা বিচারে আটক করতে হবে। আমার বাড়িতে ভোরবেলায় পুলিশ চলে গেল বাড়ি সার্চ করবার জন্য। বিনা বিচারে আটক করা – এটাই কি পর্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি?”

“এ কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে যে, ৩১ তারিখ পুলিশের গায়ে একটিও আঁচড়ও পড়েনি। তা সত্ত্বেও ১৪ হাজার কনস্টেবল ঝাঁপিয়ে পড়ল পিছন থেকে, সামনে থেকে, চারপাশ থেকে। লাঠিপেটা করলো লোকের উপর। ১ তারিখে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ছাত্রদের উপর।… এই যে ঘটনা হলো, পন্ডিত নেহরু এত কথা বললেন কিন্তু কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ করতে পারলেন না! ৪১ জন মারা গেলেন সরকারি হিসাবে, আমাদের মতে ৮০ জন – তিন-চার দিনের মধ্যে মারা গেলেন, বলি, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি তখন কোথায় ছিল?”

১৯৫৯সালের ৩১শে আগস্ট খাদ্যর দাবীতে কলকাতায় জমায়েত হওয়া মানুষের উপরে নির্বিচারে লাঠিপেটা করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ভয়াবহ  হত্যালীলা চালিয়েছিল ।এই গনহত্যার বিরুদ্ধে ২৮শে সেপ্টেম্বর বিধানসভায় বিধান চন্দ্র রায়ের কংগ্রেস  সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিরোধী দলনেতা কমরেড জ্যোতিবসু এই ঐতিহাসিক ভাষনটি দেন।

১৯৪৩সালে বাংলায় যে মন্বন্তর হয় সম্বন্ধে ৪৫ সালে উডহেড কমিশনের যে রিপোর্ট  প্রকাশিত হয় তা থেকে জানা গিয়েছিল যে- “১৯৪৩ সালে কৃত্রিম কারণে চালের দাম বাড়িয়ে মুনাফাখোররা দেড়শো কোটি টাকা বাড়িত লাভ করেছিল। কোন সন্দেহ নেই যে সরকারী যোগসাজশেই এই ঘটনা সম্ভব হয়েছিল“।


দেশ স্বাধীন হলেও অসাধু ব্যবসায়ী ,কালোবাজারি ,মুনাফাখোররা  রয়ে গেছিল আগের মতই। তাদের মুনাফার লালসার শিকার হতে থাকে এই বাংলার মানুষ। বাড়তে থাকে খাদ্য সঙ্কট।

১৯৫৯ সালে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন পরিচালনা করে বামপন্থীদল ও সংগঠন সমূহ।  ‘মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠন করে এই আন্দোলন গোড়ে তোলা হয়। ৩রা ফেব্রুয়ারি বিধানসভায় দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় প্রথম পর্যায়। ১৫ই জুন জেলায় জেলায় কংগ্রেস সরকারের খাদ্যনীতির প্রতিবাদে কলকাতায় প্রথম কেন্দ্রীয় সমাবেশ হয়। তেমনই জেলায় জেলায় চলতে থাকে বিক্ষোভ সমাবেশ। ২৫শে জুন পালিত হয় রাজ্য ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল।

৩১ অগস্ট, ১৯৫৯, হাজারে হাজারে মানুষ  দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটির ব্যানারে জমায়েত হলেন কলকাতায়।রাজভবনের মুখে  পুলিশ মিছিল আটকায়।প্রথমে পঞ্চাশ  জনকে গ্রেফতার করার পরেই পুলিশ  লাঠিচার্জ  আর টিয়ার গ্যাস  চার্জ আরম্ভ করে।বেপরোয়া লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস  থামল না। ভারতের ইতিহাসে এমন নৃশংস পুলিশি হামলা খুব কমই ঘটেছে। সরকারি মতে মারা গেলেন আশি জন, বেসরকারি মতে আরও অনেক বেশি।

ঘটনার প্রতিবাদে ১ সেপ্টেম্বর রাজ্য জুড়ে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। ধর্মঘটী ছাত্রদের ওপর পুলিশের বেপরোয়া গুলিচালনায় মৃত্যু হয় ৮ ছাত্রের। আহত হন ৭৭ জন।
রাজ্যে ৩ সেপ্টেম্বর ফের ডাক দেওয়া হয় সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের। সেদিনও গুলি চলে বিভিন্ন স্থানে। মৃত্যু হয় ১২ জনের। আহত হন ১৭২ জন।

এর পরের চার-পাঁচ দিন কলকাতার দখল নিলেন সাধারণ মানুষ। অসংখ্যবার গুলি চলল, লোক মরল, কিন্তু রাজপথ ছাড়ল না ক্ষিপ্ত জনতা৷  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইট মেরে পুলিশকে তাড়িয়ে দিল ছাত্রছাত্রীরা। একদিনে তিরিশ জায়গায় গুলি চলল৷  ৭৫ বছরের চুনীলাল দত্ত, ১৪ বছরের সরোজ দাঁ মরল গুলিতে। শিবপুরের ১৮ বছরের ছেলে হারাধন পাল তেল মেখে পুকুরে নামার সময় গুলি খেয়ে মরল। তার মা ছুটে এসে জাপটে ধরলেন লাশ। পুলিশ লাশশুদ্ধ মাকে টেনে নিয়ে গেল থানায়। রাতে শ্মশানে একসঙ্গে পুড়ল আরও সতেরোটা লাশ।
এই নারকীয় ঘটনার বিভৎস রূপ সেদিন (২৮\০৯\৫৯)বিধানসভায় তুলে ধরেন কমরেড জ্যোতি বসু তিনি বলেন–“অনেকে বলে থাকেন, এবং ডাক্তার ঘোষ ও বলছেন, আরো আলোচনা করলে পারতেন। ডাক্তার ঘোষ জানেন যে, এ নিয়ে আমরা ছয় মাস ধরে আলোচনা করেছি – এই অ্যাসেম্বলিতে বহু আলোচনা করেছি। তারা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বারে বারে তা ভঙ্গ করেছেন। তারা কন্ট্রোল অর্ডার করলেন – সব ফাঁকির কথা, সব মিথ্যা কথা বলেন, – ছয় মাস যেতে না যেতে আরতদার, বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে সব চাল চলে গেল – তারা কন্ট্রোল অর্ডার ডিফাই করতে আরম্ভ করলো যখন তখন আপনারা কন্ট্রোল তুলে দিলেন। এখানে কেন্দ্রীয় অফিসার এসেছেন, কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। দেবেন বাবু যে কথা বলেছেন, খাদ্য উপদেষ্টা কমিটিতে বারেবারে আপনারা আমাদের অপমান করেছেন – আপনারা কখনো আমাদের কনফিডেন্সে নেন নি। আমরা অনেক রকম সাজেশন করেছি, আপনারা কর্নপাত করেননি।আরএখানে মেয়েদের উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে, গুলি করে মারা হয়েছে এখন তো পন্ডিত নেহেরু তার কন্যা কিছু বলছেন না। আমি মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার রায় কে জিজ্ঞাসা করছি তিনি তার কি জবাব দেবেন। ডাক্তার রায় এবং কালিপদ মুখার্জী কন্ট্রোল রুমে বসে অর্ডার দিলেন ছাত্রদের লাঠিপেটা করো। আপনারা চরম অপরাধী। যদি আপনারা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির এতই ভক্ত হন তাহলে একটা পাবলিক এনকোয়ারি করছেন না কেন? আজকে মানুষ আপনাদের ধিক্কার দিচ্ছে। মানুষ যা শরীরে কতটুকু রক্ত আছে আপনাদের কখনো ক্ষমা করবেন না। আমাদের মধ্যে একটা প্রাচীর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, যাদের রক্তে বাংলাদেশের মাটি রাঙা হয়েছে, তাদের আমরা ভুলতে পারি না, তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্য আছে।”
হ্যাঁ সেদিন কমিউনিস্ট পার্টি কর্তব্য পালন করেছিলেন এই বুভুক্ষু মানুষ গুলির প্রতি ।লাঠি গুলি মৃত্যু সব কিছু উপেক্ষা করে খাদ্যের দাবীতে সংগঠিত করেছিল দুর্বার আন্দোলন ।

১৯৫৯পর ৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুনরায় শুরু হয় খাদ্য আন্দোলন। এই সাত বছরে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল।বিভাজিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি।গড়ে উঠেছে সংশোধনবাদীদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)।মৃত্যু হয়েছে বিধান চন্দ্র রায়ের কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এবং খাদ্য মন্ত্রী দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন প্রফুল্ল চন্দ্র সেন।অন্যদিকে পরপর দুটো(চিন -ভারতএবং পাকিস্তান -ভারত) যুদ্ধের কারনে গোটা দেশের মতো বাংলাতে ও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছিল অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি।বাংলার কংগ্রেস সরকারের খাদ্যনীতির কারনেই বৃদ্ধি পেয়েছিল চোরাকারবার ।সরকারের লেভী নীতির সুযোগ নিয়ে চালকল মালিকেরা তা ফাঁকি দেয়।অন্য দিকে সেই সময় কমে গেছিল ধান সহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদনের হার(এই উৎপাদন কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল বড় জমির মালিকদের জমি বেনামে অনাবাদী করে রেখে দেওয়া)।
আন্তঃজেলা আমদানি-রপ্তানির ওপর সরকারি বিধিনিষেধের ফলে কেরোসিনের ছদ্ম ঘাটতি দেখা গিয়েছিল, যার জন্য ছাত্রসমাজের পড়াশোনার এবং গৃহকর্মেরও অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল। তাই খাদ্য ও কেরোসিনের দাবিতেই আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।আর দাবীগুলির  সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনৈতিক বন্দি মুক্তির দাবি।জনগণের চরম দুর্দশা নিরসনে কংগ্রেস সরকার যে কতটা  ভাবলেশহীন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিধানসভায় ওই সরকারের খাদ্যনীতি ঘোষণার মাধ্যমে। যেখানে জনগণের সমস্যা সমাধানের বদলে জনগণকেই দোষী করা হয় এই খাদ্য সঙ্কটের জন্য । প্রফুল্লচন্দ্র সেন ১৯৬৫ সালের ২৯ নভেম্বর ৬৬ সালের খাদ্যনীতি ঘোষণা করলেন। মাননীয় মুখ্যন্ত্রী বিধানসভায় খাদ্যনীতি ঘোষণার সময়  বলেন—  “সংকটজনক অবস্থায় আমরা যদি পেট ভরে খাই তবে চাল পাব কোথায়? তাই বলছি খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। পেট ভরে খাবার জন্যই তো খাদ্যে এত ঘাটতি হচ্ছে। সুতরাং কাঁচকলা খেতে হবে বৈ কি? জার্মানি, আয়ারল্যাণ্ডেও তো বিকল্প খাদ্য ব্যবস্থা আছে। পশ্চিমবঙ্গে ২ লক্ষ টন আলু উৎপাদন হয়েছে। প্রয়োজনে রেশনে আলু দেবার ব্যবস্থা করব”।
     বাংলার মানুষ সেদিন সরকারের কাঁচকলা খাওয়ার উপদেশ মেনে নেননি তারা নিজেদের হক আদায়ের জন্য আন্দোলনের রাস্তায় নামেন নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি।
 উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে নদীয়া আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। এই আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীরা।
১৭ই ফেব্রুয়ারি স্বরুপনগর থানা এলাকার তেঁতুলিয়াতে ছাত্ররা খাদ্যর দাবিতে মিছিল নিয়ে বিডিও অফিসের দিকে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নুরুল ইসলাম নামের ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্র। ৬৬-র খাদ্য আন্দোলনের প্রথম শহীদ নুরুলের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজ্যে। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলা।আন্দোলন এক জঙ্গি রূপ ধারণ করে গড়ে ওঠে ছাত্র-সংগ্রাম কমিটি।
ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ঠিক করে ২২শে ফেব্রুয়ারি বাংলা জুড়ে ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি নেওয়া হবে।ছাত্রদের আন্দোলনের এই জঙ্গি মেজাজ দেখে সরকার সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ২১শে থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভীতসন্ত্রস্ত সরকার বন্ধ করে দেয় কলকাতা এবং তার পাশের জেলা গুলির স্কুল কলেজ। কিন্ত এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেও সরকার ছাত্র ধর্মঘট রুখতে পারেনি অন্যান্য জেলা গুলিতে সফলতার সঙ্গেই ছাত্র ধর্মঘট হয়।


       ক্রমশ এই আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকেন সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ ।আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সরকারের দমন পীড়ন।এই সময় ছাত্র ফেডারেশনের নেতারা (যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড বিমান বসু)আত্মগোপন করে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপনে  আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন।এই রকম আত্মগোপন অবস্থায় এক গোপন সভায় ছাত্র নেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে আগামী সাতদিন তারা জঙ্গি আন্দোলন কর্মসূচি নেবে ৪টা মার্চ ছাত্র ধর্মঘট হবে বিক্ষোভ হবে ,আর পুলিশ যদি বাধা দেয় প্রতিরোধ ও হবে। মার্চ মাসের ১থেকে ৩তারিখ পর্যন্ত সারা রাজ্যে ছাত্ররা পুলিশের সঙ্গে প্রতিদিন সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

৪টা মার্চ কৃষ্ণনগরে ছাত্রদের মিছিলের উপরে পুলিশ গুলি চালালে শহীদ হন আনন্দ হাইত ।আনন্দ হাইতের মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র শুরু হয়ে যায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের খন্ড যুদ্ধ। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ছাত্ররা পাল্টা ব্যারিকেড গড়ে দখল নেয় রাজপথের।গ্রেফতার,নীপিড়ন,সান্ধ্য আইন ১৪৪ ধারা কোন কিছুই ছাত্র আন্দোলনের এই উত্তাল তরঙ্গকে বাধা দিতে সক্ষম হয়না।


শহীদ আনন্দ হাইতের মৃতদেহ নিয়ে কয়েক হাজার মানুষের জমায়েত ঘেরাও করে থানা।সশস্ত্র পুলিশের সামনে কয়েক জন ছাত্র জামা খুলে বলেন পুলিশের কর্ডন ভেঙে সামনে এসে বলে চালাও গুলি।বড় কর্তাদের গুলি চালানোর আদেশ পেয়েও সশস্ত্র বাহিনী নামিয়ে রাখে তাদের বন্দুক। পিছু হটে সরকারের বাহিনী গোটা কৃষ্ণনগর শহরের দখল নেয় সংগ্রামী জনতা।জনতার ক্ষোভের আগুনে ভস্মীভূত হয় সরকারি সম্পত্তি।
গোটা রাজ্যে জুড়ে আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।বন্ধ হয়ে যায় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের নির্দেশে ।সরকার আন্দোলন দমন করতে আরও কঠোর হলে ১০মার্চ থেকে পরপর তিনদিন চব্বিশ ঘণ্টার বাংলা বনধ হয়।স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলার জনজীবন। সেদিন কংগ্রেস সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি বামেদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলন দমন করা।অবশেষে সরকার বাম নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয় এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে খাদ্য সরবরাহের আবেদন জানান।


    ইতিমধ্যেই কমরেড জ্যোতিবসুকে জেল থেকে মুক্তি দেয় সরকার। আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে সরকার ঘোষনা করে রাজনৈতিক বন্দীসহ খাদ্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত বন্দীদের মুক্ত করা হবে,গ্রেফতারী পরোয়ানা তুলে নেওয়া হবে এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য মাথা পিছু আড়াই ছটাক আনুমানিক একশো গ্রাম রেশন বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
সরকারের সিদ্ধান্ত মতো সমস্ত স্তরের রাজনৈতিক বন্দিরা মুক্তি পায়।জয় হয় গণ আন্দোলনের।

আন্দোলনের পথে পুলিশের গুলি শহীদের মৃত্যু ,জেল ,সরকারের অত্যাচার সবই ছিল কিন্ত সেদিন এই সব কিছুর মোকাবিলা করেই কমিউনিস্ট পার্টির  নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল দুর্বার আন্দোলন। যেই আন্দোলন পরবর্তী সময় বাংলায় যুক্তফ্রন্ট  সরকার কে ক্ষমতায় আনে ।এই আন্দোলন বাংলার সংগ্ৰামী জনতার নয়নের মনিতে পরিনত করেছিল  কমিউনিস্ট  পার্টিকে যা এক দশক বাদে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।

বিপ্লব ব্যানার্জী