অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে স্বাধীনতার ৭৫ বৎসরে পা মেলাতে চলেছি। ১৯৪৭ সালের ২২ শে জুলাই “তেরঙ্গা ” আমাদের জাতীয় পতাকা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আর একদিন পরেই দেশের সর্বত্র “জাতীয় পতাকা” উত্তোলিত হবে। এই জাতীয় পতাকাকে রক্ষা করা সহ দেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কে অটুট রেখে যে আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিল তাকেও রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে কমিউনিস্টরা লড়াইয়ে নেমেছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা যে অবদান রেখে গেছেন, সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে, RSS পরিচালিত বি জে পি সরকার আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিতে চাইছে।

কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখে গেছেন, যে আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে সেই স্বাধীনতাকে বর্তমান প্রজন্মের কমিউনিস্টদের যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে।
নিন্দুকেরা, বিকৃতমনা লেখক লেখিকাসহ, ভূস্বামী ও বুর্জোয়া ইতিহাসবিদরা স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা খাটো করে দেখে এবং মাঝে মধ্যে অস্বীকারও করে। যাঁরা এই সব কথা বলেন তাঁদের উদ্দেশ্যে আমার কয়েকটা প্রশ্ন—————-
** স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা যদি সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ না করত, তাহলে পার্টি গঠন হবার পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির উপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের লাগাতার আক্রমন, নিপীড়ন, দমনপীড়ন এবং কমিউনিস্টনেতৃত্বদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় জেরবার করে দেওয়া হয়েছিল……কেন ?
** জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে (১৯২১ সালে) কমিউনিস্টরাই পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবেন ???
** তেরঙ্গা ওড়াতে গিয়েই ১৬ বছরের কিশোর হরকিষান সিং সুরজিৎ বৃটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। কমিউনিস্ট বিপ্লবী বলেই কি তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল? নাম জিজ্ঞাসা করায় সুরজিৎ বলেন “তার নাম লন্ডতোড় সিং।” সেদিনের সেই ১৬ বছরের কিশোর হরকিষান সিং সুরজিৎ পরবর্তীতে সি পি আই (এম) এর সাধারণ সম্পাদক হন।১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ঔপনিবেশিক দেশ গুলোতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই যেমন জোরদার হয়েছে তেমনই শ্রমিক কৃষকের লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়েছে। এই দ্বিমুখী লড়াই কমিউনিস্ট হাতে চলে যাচ্ছে দেখে, আমাদের দেশের ভূস্বামী ও বুর্জোয়ারা তাদের বিপদ বুঝে তাদের দোসর সংবাদপত্রকে ব্যবহার করল,”কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কুৎসা করা, ষড়যন্ত্র করা ।” বৃটিশ বড়লাট ব্যাপকভাবে কুৎসা শুরু করলেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এবং ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে বৃটিশ বড়লাট লর্ড আরউইন আইনসভায় তার ভাষনে বলেন, “কমিউনিস্ট মতবাদের উদ্বেগজনক প্রসারলাভ দুশ্চিন্তার কারন হয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে।” এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে কমিউনিস্টরা ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে নড়িযে দিতে পেরেছিল। লর্ড আরউইন এও হুমকি দিল যে, সরকার এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঠিক এর পরেই জাতীয় কংগ্রেসের মুখপত্র “বম্বে ক্রনিকল পত্রিকা” লিখেছিল —“আকাশে বাতাসে এখন সমাজতন্ত্রের কথা। বিগত মাসগুলিতে ভারতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সম্মেলনে বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকদের সম্মেলন গুলিতে সমাজতন্ত্রের মূলনীতি গুলি প্রচার করা হয়েছিলো।”
এই পত্রিকার বক্তব্যই প্রমাণ করে – স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল এবং নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ চলে আসছে দেখে দমনপীরন শুরু হল। ১৯২০ -১৯২৯ সালের মধ্যে মীরাট কানপুর, পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে প্রথম সারির কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার শুরু হল। ১৯৩৪ সালে বোম্বাইতে ওয়ার্কার লীগ পরিচালিত সংগঠনগুলিকেই বেআইনি বলে ঘোষণা করা হল। ঠিক ঐ সময়েই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তার কর্মপন্থা ঘোষনা করলেন ভারতীয় জনগণের কাছে –” ভারতীয় জনসাধারণের দাসত্ব বন্ধনের উচ্ছেদ ঘটাতে হলে এবং যে দারিদ্র্যের কবলে শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকেরা নিষ্পেষিত, তা থেকে তাদের মুক্ত করতে হলে দেশের স্বাধীনতা অর্জন, এবং যা মধ্যযুগ থেকে এ যাবৎ জিইয়ে রাখা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে দিতে ও সমগ্র ভূখণ্ডকে যাবতীয় মধ্যযুগীয় আবর্জনা থেকে উদ্ধার করতে সমর্থ, সেই কৃষিবিপ্লবের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরা একান্তভাবে আবশ্যক। ব্রিটিশ পুঁজি ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক কৃষিবিপ্লবকেই হতে হবে ভারতে সেই বৈপ্লবিক মুক্তি অর্জনের ভিত্তি।” জাতীয় কংগ্রেস ও অন্যান্য দলগুলো জমি মজুরি শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবেনি। কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর সাথে শ্রমিক কৃষকের লড়াইকে যখন তীব্র করতে চেয়েছে তখনই নিকৃষ্টতম দমনপীড়নের রাস্তা ব্রিটিশরা বেছে নিয়েছে।নৌবিদ্রোহ ,সূতাকলে চটকলে ধর্মঘট ব্রিটিশ রাজের ভীত নড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পটভূমিতে দেশ স্বাধীন হল। রেখে গেল শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব,কৃষকের হাহাকার। এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা শ্রমিক কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে যেমন লড়াই করছি তেমনই ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব বি জে পি ধ্বংস করতে চাইছে। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন আমাদের দেশের মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টরা যে গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে সেই ভূমিকা আজকের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের দ্বিতীয়বার অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই যেমন লড়তে হবে তেমনই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই চলতেই থাকবে। সংসদীয় রাজনীতিতে দ্বিমুখী লড়াই করেই আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতেই হবে।
তাং -১৩৷৮৷২২
[তথ্য সংগৃহীত ]
স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর শহীদদের জানাই লাল সেলাম।