
“…এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত!…”
একান্ত প্রেমের কবিতায় অসম্ভব এই শব্দমালার রচনা হলেও- ৭৫ বছর আগের মধ্যরাতে হয়তো এই মাধুরীতেই সুনীল নিশিযাপন করেছে ভারতবর্ষের সর্বসাধারণ। উন্মত্ত হয়েছে স্বাধীনতার তাপে। জ্বলেছে, পুড়েছে, নগ্ন হয়েছে সাদাত মান্টোর ‘খুলে দাও’ গল্পে, জাপটে ধরেছে সম্ভাবনার প্রত্যাশাকে, সত্যি হয়েছে লাখো আত্মবলিদাকারীর স্বপ্নের প্রথম পদক্ষেপ।
দেশ জুড়ে স্বাধীনতার প্রথম সংগ্রাম
১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহ চলাকালীন এক ব্রিটিশ ধারাবিবরক এডওয়ার্ড লাও লিখেছিলেন- “…রাজপুত-ব্রাহ্মণ-মুসলমান-হিন্দু-এরা সবাই যদি একসাথে স্বাধীনতার সংগ্রামে নামে তবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই…।”
এই বিশ্লেষণ অক্ষরে অক্ষরে অনুভব করেছে এবং মান্যতা দিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। চরম লুঠ, অবশিল্পায়ন, ভারতবর্ষের অর্থনীতিকে তছনছ করে দেওয়া আর এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পথে নামা মানুষের জমায়েতকে ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে ছত্রখান করার প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে সংগ্রামী মানুষকে দমন করা- এক বাক্যে এই আমাদের পরাধীনতার ইতিহাস। আর পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে কার্ল মার্কসের ভাষায় ১৮৫৭ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নেতৃত্ব হিসেবে গ্রহণ করে সেদিন ব্রিটিশের বুকে কাঁপন ধরিয়েছেন ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাই ধেকে তাঁতিয়া টোপী সকলেই। সেই সময় থেকেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল ব্রিটিশের প্রধান অস্ত্র। মহাবিদ্রোহের আগুনের আঁচ পেয়ে ভারতে অবসান হল কোম্পানি রাজের। ক্ষমতা গেল সরাসরি ইংল্যান্ডের রানীর হাতে।
“বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,
পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক…”
মহাবিদ্রোহ দমন করলেও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম তিলে তিলে গড়ে উঠতে থাকল গোটা ভারতবর্ষজুড়ে। ১৮৮৫ সালে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের উদ্যোগে গড়ে ওঠা জাতীয় কংগ্রেসে একে একে জড়ো হলেন স্বাধীনতাকাঙ্খী সমস্ত মানুষ। আয়তনে স্বল্প হলেও ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশুনা করা দেশবাসীর মননে জাতীয়তাবাদের আদর্শ দানা বাঁধল ধীরে ধীরে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনই সেই সময়ে বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র সহ অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। যার ভরকেন্দ্র ছিল অবিভক্ত বাংলা। ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতা ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠল ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র। বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী এই লড়াই দমন করতে আবারও ধর্মীয় বিভাজনকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হল। ১৯০৫ সালে কুখ্যাত ‘বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব’ আনল ব্রিটিশরা। বাংলা ভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে পথে নামল বাংলার জনসাধারণ। ১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫ তারিখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্প্রীতির লক্ষ্যে বাংলাব্যাপী রাখীবন্ধন উৎসব পালন করলেন। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে দুর্জয় প্রতিরোধ গড়ে তুলল বাংলা। আন্দোলনের চাপে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব খারিজ করলেও ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর কলকাতা থেকে দেশের রাজধানী স্থানান্তরিত করা হল। রাজধানীর অলিন্দে এই চাপ সামলাতে পারল না ব্রিটিশরা।
“…ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজো রোমাঞ্চকর;…”
সতীশ চন্দ্র বসু, জ্যোতিন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে উঠল ‘অনুশীলন সমিতি’। ১৯০৬’তে গড়ে উঠল ‘যুগান্তর গোষ্ঠী’। ব্রিটিশের অত্যাচারে জর্জরিত দেশে আত্মপ্রকাশ ঘটল বিপ্লববাদী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। মোদী-মমতার রাজত্বে যাঁদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া হয়, ভারতের সেই বীর সন্তানদের তেজে কাঁপতে শুরু করল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অক্ষয় হয়ে থাকল মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি। এ বাগানবাড়ি ব্রিটিশের তাঁবেদার জমিদারদের আমোদশালা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। এ বাড়িতে বোমা বানিয়েছেন হেমচন্দ্র কানুনগো। অনুব্রত মন্ডলের বোমা নয়, এ বোমা ক্ষুদিরামের! এ বোমা প্রফুল্ল চাকীর! এ বোমা বারীন ঘোষের। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা ও দুই মেমসাহেবকে হত্যা করার জন্য মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাঁসিকাঠে ঝুললেন ক্ষুদিরাম বসু। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই আত্মহত্যা করলেন আরেক বীর সন্তান প্রফুল্ল চাকী। অনুশীলন সমিতি-যুগান্তর গোষ্ঠীর বিপ্লবী কার্যকলাপ চলতেই থাকল। হাজার চেষ্টাতেও থামানো গেল না ‘বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা’। ১৯১৫ সালের বালেশ্বরে পাঁচটা জার্মান পিস্তলের বিরুদ্ধে চারিদিকে রাইফেলধারীদের ৭৫ মিনিটের যুদ্ধে ব্রিটিশ টের পেয়েছিল এই বিপ্লবীদের তেজ। শহীদ হয়েছিলেন বাঘাযতীন। কিন্তু, নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে। এরপর, ১৯১৯’এর ১৩ই এপ্রিল এক নারকীয় বীভৎসতার রূপ দেখল গোটা পৃথিবী। পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দানে চারিদিক থেকে ঘিরে বর্বরের মতো গুলি চালানো হল নিরস্ত্র সমবেত মানুষের ওপর৷ জেনারের ডায়ারের নির্দেশে মুহুর্তের মধ্যে মৃত্যু হল ৩৭৯ জন মানুষের। আহত হলেন প্রায় ১২০০। প্রতিবাদস্বরূপ “নাইট” উপাধি ত্যাগ করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
“যেখানে যত ঘটে অনিষ্টি,
সকলের মূলে কমিউনিস্ট।”
অনুপম খের আমাদের দেশপ্রেমের পাঠ পড়ান। জ্ঞান দেন সাধ্বী প্রজ্ঞা। উত্তেজনায় টানটান চিত্রনাট্যে আমাদের দেশপ্রেমের ক্লাস নেন অক্ষয় কুমার। কমিউনিস্টরা নাকি ‘দেশদ্রোহী’! কমিউনিস্টরা রাশিয়া অথবা চীনের দালাল! কিন্তু, মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে কী ভূমিকা কমিউনিস্টদের? ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদেে বিরোধিতা ও মানবমুক্তির লড়াইয়ে ব্রতী কমিউনিস্টরা। ১৯২১ সালেই জাতীয় কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে এ দেশের মাটিতে সর্বপ্রথম ‘পূর্ণ স্বরাজ’এর দাবি তোলেন কমিউনিস্টরা। ওই অধিবেশনে এই প্রস্তাব রাখেন কমিউনিস্ট নেতা মৌলানা হসরত মোহানী এবং স্বামী কুমারানন্দ। ব্রিটিশ শাসকরা ভীত হয়ে বারবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কমিউনিস্ট পার্টিকে। একের পর এক মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে। পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা(১৯২২), কানপুর বলশেভিক মামলা(১৯২৪), লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯২৮), মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা(১৯২৯)- এইরকম বহু মামলায় জেলবন্দী করে রাখা হয় মুজফ্ফর আহমেদ, পি সি জোশী, সওকত ওসমানী সহ বহু কমিউনিস্ট নেতাকে। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কমিউনিস্টরা জবানবন্দী দেন- “ব্রিটিশকে উৎখাত করে ভারতকে তার থেকে পৃথক করা কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কাজ নয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য এটি একটি মহান কর্তব্য। এই প্রচেষ্টার জন্য কমিউনিস্টরা গর্বিত।” এই প্রচেষ্টা করেই দেশকে স্বাধীন করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন কমিউনিস্টরা। কারাবরণ করেছেন ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, ই কে নায়নার, এ কে গোপালন, বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রভাস রায়, সরোজ মুখার্জি সহ অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতা।
কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সাথে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ক্ষতবিক্ষত করার কাজ চলতে থাকল অন্যভাবেও। লেখা হল- “সারফারোসি কি তামান্না আব হামারে দিল মে হে, দেখতে হে জোর কিতনা বাজু-এহ কাতিল মে হে…” পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশসহ উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে স্বাধীনতার প্রবল আহ্বানে গলা মেলালো তরুণ প্রজন্ম। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকুল্লা খানদের নেতৃত্বে গড়ে উঠল হিন্দুস্তান রিপাবলিক সোশ্যালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বোমা নিক্ষেপ করলেন ভগৎ সিং-বটুকেশ্বর দত্তের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীরা। দেশ জুড়ে শোনা গেলো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’এর অমোঘ আহ্বান। ভগৎ সিং বললেন-“বধিরকে শোনানোর জন্যই এই বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে।” ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ লাহোর সেন্ট্রাল জেলে ভগৎ সিংকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশ সরকার। জেলবন্দী অবস্থায় তাঁর পাঠ্য শেষ বইটির নাম “রাষ্ট্র ও বিপ্লব”, রচয়িতা কমরেড লেনিন।
“দিগন্তে দিগন্তে তাই ধ্বনিত গর্জন/ তুমি চাও শোণিতের স্বাদ-/ যে স্বাদ জেনেছে স্তালিনগ্রাদ…” ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল। এক কৃশকায় বাঙালী বিপ্লবীর আগুনখেকো জীবনের কল্লোলে যেন ধূলিসাৎ হল প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশ। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহের সূচনা হল চট্টগ্রামে। দখল করা হল অস্ত্রাগার। বিচ্ছিন্ন করা হল রেলপথ থেকে টেলিগ্রামের লাইন। এক রাতের জন্য হলেও স্বাধীনতা ঘোষণা হল চট্টগ্রামে। পরবর্তীতে জালালাবাদের যুদ্ধেও দীর্ঘক্ষণ মরণপণ সংগ্রাম চালালেন বিপ্লবীরা। চট্টগ্রামের ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির এই বিষ্ময়কর কর্মকান্ড আজও ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের কাছে শিক্ষণীয়। গণেশ ঘোষ, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সহ অসংখ্য বিপ্লবীদের পদচারণায় কেঁপে উঠল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। যাঁরা নির্বাসিত হয়েছিলেন সেলুলার জেলে, কালাপাণি থেকে ফিরে এ দলের প্রায় সকলেই যোগ দিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।
অন্যদিকে, ১৯৩৮ সালে কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টদের সমর্থনে গান্ধীজির বিরুদ্ধে থেকেও জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীনতার পথ নিয়ে গান্ধীজির সঙ্গে মতান্তরের কারণে নেতাজী ১৯৩৯ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক দল গঠন করেন। সেই সময়তেই তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ও সোশ্যালিস্ট দলগুলিকে নিয়ে গড়ে তোলেন “বাম সমন্বয়”। নেতাজীই ছিলেন এই মঞ্চের আহ্বায়ক। খুব সম্ভবত, বাংলার মাটিতে এটিই প্রথম বামপন্থী ফ্রন্টের ধারণার আত্মপ্রকাশ। এমনকী নেতাজীর ‘গ্রেট এসকেপ’এ যারা সবচাইতে বেশি সহযোগিতা করেন, তারা সকলেই কমিউনিস্ট। নেতাজীর এই দেশত্যাগেও অর্থ ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে সাহায্য করেন কমিউনিস্ট নেতা স্নেহাংশুকান্ত আচার্য।
মীরজাফরদের ধর্ম একটাই- গদ্দার!!
আজ যারা ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে জাতীয় পতাকা দিতে বলছেন, তারা ঠিক কী বলেছিলেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট? আরএসএসের মুখপত্র ‘দ্য অর্গানাইজার’এ লেখা হল- ‘বরাত জোরে যে সব লোকেরা ক্ষমতায় এসেছে, তারা আমাদের হাতে তেরঙা ধরিয়ে দিলেও হিন্দুরা কখনই একে সম্মান করবে না এবং মেনে নেবে না। তিন সংখ্যাটা এমনিতেই অশুভ। তিন রঙের পতাকা অবশ্যই অত্যন্ত খারাপ মানসিক প্রভাব ফেলবে এবং দেমের পক্ষে ক্ষতিকর।’ আরএসএসের এই বক্তব্য শুধু অবৈজ্ঞানিক প্রলাপ নয়, এই কথা একমাত্র ‘অসভ্য ও বর্বর’রাই বলতে পারে। ১৯৪০’এ জিন্না মুসলিম লীগে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পৃথক পাকিস্তানের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তার তিন বছর আগে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের পক্ষে সওয়াল করেন বিনায়ক সাভারকর। এই দ্বিজাতি তত্ত্বে আজও বিশ্বাস করে আরএসএস। এ কারণেই যোগী আদিত্যনাথ ভাষণে বলেন- “হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতি সম্পূর্ণ পৃথক, এরা কখনই একত্রে সহাবস্থান করতে পারে না।” আরএসএস স্বাধীনতা সংগ্রামে গদ্দারি ছাড়া আর কোনো ভূমিকা পালন করেনি। বিনায়ক সাভারকর জেলবন্দী হওয়ার পর ব্রিটিশকে মোট ছয়বার ক্ষমাভিক্ষা করে চিঠি লেখেন। তার একটা চিঠির শেষে লেখেন- ”I beg to remain, Sir, Your most obedient servant.” স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে গদ্দারি করেছেন বাংলার মুসলিম লীগ-হিন্দু মহাসভা জোট সরকারের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন ইউনিয়ক জ্যাকের পতাকাকে স্যালুট করতে অস্বীকার করায় ধরিত্রী গাঙ্গুলি ও উমাপদ মজুমদার নামের বিদ্যাসাগর কলেজের দুই ছাত্রকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেন শ্যামাপ্রসাদ। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে ব্রিটিশ গর্ভনরকে চিঠি লিখে আশ্বস্ত করেন যে তার সরকার বিদ্রোহ দমনে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। স্বাধীন ভারতের সংবিধানের মূল মর্মবস্তুকেই অস্বীকার করে বিশ্বাসঘাতকদের এই সংগঠন। ব্রিটিশের অনুচরবৃত্তি করাটাই এদের স্বাধীনতা সংগ্রামে একমাত্র ভূমিকা।
“বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে,
তোমার স্বদেশ লুঠ হয়ে যায় প্রতি দিন প্রতি রাতে”
স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দেশের মানুষের সবচাইতে বড় আকাঙ্খা কী? দেশের কোটি কোটি মানুষের অভুক্ত দিন দেখার জন্য প্রাণ দিয়েছেন সহস্র দেশপ্রেমিক? দেশের কাঠামোর মূল ভিত্তি- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ধ্বংস করা হচ্ছে কোন আচ্ছেদিনের স্বার্থে? আজ দেশের সবচাইতে ধনী দশভাগের কাছে দেশের মোট সম্পত্তির ৭৭ভাগ কুক্ষিগত। আজ দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, দুর্নীতির যন্ত্রণায় ভারতবর্ষ ক্লিষ্ট। প্রত্যেক বছর প্রায় ৬ কোটি মানুষ ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা খরচ চালাতে গিয়ে দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাচ্ছেন। দেশের প্রায় সাড়ে ৩ কোটি শিশু স্কুলে যেতে পারে না আর্থিক অনটনে। আজ গণতন্ত্র ভুলুন্ঠিত। গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে একটি রাজ্যের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার। খুন হচ্ছেন, গ্রেফতার হচ্ছেন সত্য উদঘাটনকারী সাংবাদিকরা। এদিকে আম্বানিদের হাতেই রয়েছে কুড়িটির ওপর বড় বড় চ্যানেল। কার সম্পত্তি কত বাড়বে-এই নিয়ে প্রতিযোগিতা চলছে আম্বানি ও আদানির মধ্যে। কন্যার বিবাহে ৭২৪ কোটি টাকার মোচ্ছব করছে আম্বানিরা। নিমন্ত্রিত থাকেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। গরিব মানুষকে খাদের কিনারায় পাঠিয়ে, ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করার কাজ চলছে প্রতিনিয়ত। এই চেহারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবিরোধী৷ দেশের সংবিধানেরও বিরুদ্ধে। কর্পোরেট-হিন্দুত্ব-দুর্নীতি এই ত্রিমুখী আঁতাতকে ধ্বংস করাই এ দেশের মানুষের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের মূল দাবি।