প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করে সদ্য সদ্য সম্পন্ন হয়েছে নয়াদিল্লীতে আয়োজিত রাজসূয় যজ্ঞ জি-২০ সম্মেলন। এই আয়োজনে এই দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রাপ্তি কী ? আর এস এস ও তাদের অজস্র ডালপালা, যার মধ্যে বিজেপি-ও পড়ে, অর্থাৎ সংঘ পরিবার ধুয়ো তুলেছে “ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে” আর ‘দেশগুরু’ নরেন্দ্র মোদী এই সুবাদে হয়ে গেলেন ‘বিশ্বগুরু’! লাগাও তালিয়া!

    এই জি-২০ শীর্ষ বৈঠকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনে চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্পের পাল্টা হিসাবে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ভারত-ইউরোপ পণ্য করিডর প্রশ্নে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে। যাতে অংশগ্রহণ করবে ভারত,সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, জর্ডন, ইস্রায়েল ও গ্রিস। আর এই করিডরে অবস্থিত প্রায় সবকটি বন্দরেরই মালিক মোদীর প্রিয় পাত্র আদানির মালিকানাধীন ‘আদানি পোর্ট ‘।

আর এস এস-বি জে পি খোয়াব দেখতে শুরু করেছে এখন আর কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন নয়, দুনিয়ার অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকা শক্তি ভারতও বটে! তাই ওদের ভাবনায় মোদী এখন ‘বিশ্বগুরু’তে উন্নীত। আর আদানি দেশের বাণিজ্য দূত। তিনি মাল্টি বিলিওনিয়ার কর্পোরেট মালিক হলেও ‘দেশীয়’ তো ! আর এখন ‘দেশীয় প্রযুক্তি’, ‘দেশীয় উদ্যোগ’-এর হিড়িক চলছে! ওদের কে বোঝাবে যে, চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্পে ইতিমধ্যে ৬০টি দেশ যুক্ত। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি।অথচ তাদের দেশনেতাদের ‘বিশ্বগুরু’ অভিধার প্রয়োজন পড়েনি। সুতরাং ‘বলো,বলো,বলো সবে/ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’

        এখন দেখা যাক, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবের কতটা মিল। উক্ত অঙ্গীকার ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তা দিলেও ‘ বিশ্বগুরু’র দেশে তাঁর দল ও দলীয় নেতারা ধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে বেড়ান, তিনি নীরব থাকেন। সব ধর্ম ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সম্মান করার কথা বলা হলেও মোদীর ভারতে সব বৈচিত্র্য নির্মূল করে ‘হিন্দুত্ব’র দাপট চলে। এই হিন্দুত্ব’র পরিধির মধ্যে শূদ্র, পতিত, দলিতদের স্থান নেই। মণিপুর, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, মধ্যপ্রদেশ তার সাম্প্রতিক নিদর্শন। মণিপুরে আদিবাসী ও উপজাতি মানুষদের বর্বর হত্যাকান্ড ও মহিলাদের প্রতি  নির্লজ্জ অবমাননার ঘটনায় প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার চিত্র সারা দেশ ও দুনিয়াকে হতবাক করে দিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের একজন আদিবাসী মানুষের মুখে এক বিজেপি নেতার প্রস্রাব করার ঘটনা প্রকাশ্যে এলে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী অপর এক আদিবাসী মানুষের পা ধোওয়ানোর ছবি মিডিয়ায় ছেড়ে ওই জঘন্য অন্যায় চাপা দেবার চেষ্টা চালিয়েছেন। একইভাবে বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী কয়েকজন মেথরের পা ধোওয়ানোর ছবি মিডিয়ায় ছেড়ে মহান সাজার চেষ্টা করেছিলেন। অথচ  গত ৫ বছরে ৩৩৯ জন মেথরের মৃত্যু ঘটেছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার জন্য। এছাড়া জি-২০ সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষা প্রসঙ্গে অনেক কথা বলা হলেও মোদীর সরকারই পরিবেশ ধ্বংসের কান্ডারি হিসেবে ক্রিয়াশীল। পরিবেশ সংক্রান্ত সব আইন লঘু করে কর্পোরেটদের স্বার্থে বনাঞ্চল ধ্বংসের অভিযান চলছে এদেশে। উৎখাত করা হচ্ছে আদিবাসীদের জল-জঙ্গলের অধিকার থেকে। এতকিছু স্ববিরোধিতার মধ্যে নিজেকে ‘বিশ্বগুরু’ হিসেবে জাহির করা ভণ্ডামি ছাড়া আর কী?

           নরেন্দ্র মোদী কেবল নিজে বলে চলেন অর্থাৎ ভাষণ দিয়ে যান কিন্তু কারো প্রশ্ন তিনি শুনতে নারাজ। তাই তিনি কোনও সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, এমনকি সংসদেও যান কদাচিৎ। যাতে কোনও সাংসদের প্রশ্নের জবাব দিতে না হয়। এহেন মোদী জি-২০ সম্মেলনে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পরে প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলন করেন নি। অথচ আলোচনার বিষয়বস্তু দুই রাষ্ট্রপ্রধানেরই সাংবাদিকদের জানানোর কথা। জো বাইডেন বলতে না পারা কথা গিয়ে উগরেছেন ভিয়েতনামে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদীকে বলা কথাগুলি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে ভিয়েতনাম সফর চলাকালীন আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাইডেন একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সহিষ্ণুতা, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষার গুরুত্বের কথা বলেছেন। এছাড়া নাগরিক সংগঠনগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্বের কথাও তিনি মোদীকে বলেছেন বলে জানান বাইডেন। যেগুলির বড়োই অভাব বোধ হচ্ছে সম্প্রতি এদেশে। একটি আপাদমস্তক সাম্রাজ্যবাদী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে, তার বিন্দুমাত্রও নেই সংসদ ভবনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ঠোকা ভন্ড মোদীর।

          মোদীর ভণ্ডামির আরো বড়ো প্রমাণ হল জি-২০ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ভারতের দারিদ্র্য ও দরিদ্র মানুষের খারাপ অবস্থা আড়াল করার চেষ্টা। তার জন্য সারা দিল্লী শহরকে রঙিন সুদৃশ্য কাপড়ে ঢেকে দিয়েছে মোদী সরকার। তাছাড়া ব্যবস্থা করা হয়েছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার। সম্মেলনের আগে থেকেই মেট্রো, অটো সমস্ত গণপরিবহন বন্ধ রেখে সাধারণ মানুষকে চূড়ান্ত হেনস্থার মধ্যে ফেলা হয়েছে। সম্মেলন আঙিনার ধারেকাছে সাধারণ মানুষের কোনও প্রবেশাধিকার ছিলনা। অথচ নাকি এই সম্মেলন অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মানুষের ইস্যু নিয়েই আলোচনার জন্য আয়োজিত। আয়োজক দেশ হিসেবে ভারতের জনগণের করের টাকায় আয়োজিত এই সমারোহে জনগণই ব্রাত্য। ফায়দা কেবল মোদীর, ‘ বিশ্বগুরু’ ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায়। এমনকি এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী সম্মেলনস্থলের অদূরে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে যে নাগরিক জমায়েত  সংগঠিত করে নাগরিক জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি তুলে ধরার রেওয়াজ  আছে, তাও এক্ষেত্রে ভয়ংকর নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে বাস্তবায়িত হতেই পারল না। অথচ সহিষ্ণুতা, ঐক্যমত ইত্যাদি নিয়ে কত আলোচনা মোদীর মুখে! একে ভণ্ডামি ছাড়া কী বলা যায়?

          এই ভণ্ড মোদীর শাসনে ভারতে বেকারত্ব ও  দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে রেকর্ড পরিমাণ। সাম্প্রতিক সময়কাল পর্যন্ত ভারতে বেকারত্বের হার ৮.১১ শতাংশ এবং মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও দেশের বার্ষিক মোট উৎপাদনের গড় (GDP) আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (IMF)-এর পূর্বাভাষ অনুযায়ী এই বছরে দাঁড়াবে ৬.১ শতাংশ। জিডিপি বাড়লে মাথাপিছু আয়ে তার কোনও প্রতিফলন পড়ছে না। কারণ মোট জিডিপি’র ৬০ শতাংশই আসছে রিয়েল এস্টেট, হোটেল ব্যবসা সহ অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিষেবা ক্ষেত্র, ব্যাঙ্ক-বীমা ইত্যাদি ক্ষেত্র থেকে। যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। ফলে দেশে দারিদ্র্য ও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বরাদ্দ কমানো হয়েছে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে। বেরোজগার গরীব মানুষ অনাহার-অর্দ্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১০৭ নম্বরে। আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে আমাদের  প্রতিবেশী দেশগুলি। শ্রীলঙ্কা(৬৪), নেপাল(৮১), বাংলাদেশ(৮৪) ও পাকিস্তান(৯৯)। রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে মাথাপিছু খাদ্য ও দানাশস্য গ্রহণের গড় ১৭১ কিলোগ্রাম। আফ্রিকার দেশগুলির গড় ১৯০ কিলো। আর চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় যথাক্রমে ৩৬০, ৪০৭, ৪৯৪ ও   ৫৯০ কিলো। রাষ্ট্রসংঘের উপরোক্ত সংস্থার সর্বশেষ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে অপুষ্টিতে ভোগা প্রায় ৮২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ২২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ভারতে বসবাস করেন। এত কিছুর পরেও মোদীকে ‘বিশ্বগুরু’ বলে মানতে হবে?

       আর একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে নিবন্ধে ইতি টানব। জি-২০ বৈঠকে দরিদ্র দেশগুলির কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে বলে মোদী দাবি করেছিলেন। অথচ কিউবায় হতে যাওয়া ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের ‘জি-৭৭ প্লাস চায়না’ জোটের বৈঠকে তিনি নিজে বা বিদেশমন্ত্রী কেউই অংশ নিচ্ছেন না। বিদেশ সচিবের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিদল সেই বৈঠকে যোগ দেবে বলে জানা গেছে। এতগুলি দেশের এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে ‘বিশ্বগুরু’র যোগদান না করার সিদ্ধান্ত মার্কিন  রাষ্ট্রপতি বাইডেনের নিষেধাজ্ঞায় কিনা জানা নেই কিন্তু এই অনুপস্থিতিও কি আর এক ভণ্ডামির দৃষ্টান্ত নয়?