ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন‍্যতম প্রধান নেতা হিসাবে  সাফল‍্য ব‍্যর্থতার ইতিহাস একপাশে সরিয়ে রেখে ইতিহাসের তথ‍্যনিষ্ঠ ছাত্র হিসাবে যদি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ভূমিকার মূল‍্যায়ন করা হয়,তাহলে স্বীকার করতেই হবে, জননেতা হিসাবে সাধারণ মানুষের বৃহত্তম অংশের কাছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতবর্ষে ফিরে এসে অল্প কিছুদিনের মধ‍্যেই জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতায় পরিণত হওয়া এই ব‍্যারিস্টার। কোন পদাধিকারী না হয়েও কংগ্রেসের  নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতার কারণেই সভাপতি নির্ভর সংগঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা আদায় করার প্রশ্নে কংগ্রেসের মঞ্চে থাকা কমিউনিস্টদের সঙ্গে গান্ধীর প্রবল মতবিরোধ ছিল। দলিতদের পূর্ণ মর্যাদার প্রশ্নে বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের সঙ্গেও তাঁর বিরোধিতার মীমাংসা হয়েছিল ১৯৩২ সালে পুনা চুক্তির মাধ‍্যমে। গান্ধীজি পরধর্ম বিদ্বেষ এবং ভারতীয় সমাজে প্রচলিত অস্পৃশ‍্যতা প্রথার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিলেও হিন্দু সমাজে প্রচলিত বর্ণাশ্রম প্রথার বিরোধিতা করেন নি। তিনি কমিউনিস্টদের শ্রেণী সংগ্রামের আদর্শের বিরোধিতা করতেন শ্রমজীবিদের অধিকার স্বীকার না করার কারণে। অর্জিত সম্পদে মালিকদের স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে বলেই তাঁর মত ছিল। একইসঙ্গে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশপ্রেম নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সংশয় না থাকলেও তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ‍্যবাদী শাসন থেকে বলপূর্বক স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াতে বিশ্বাসী ছিলেন না। শত সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি এই অবস্থান আমৃত্যু পরিবর্তন করেননি। গান্ধীজীর সমালোচকরা এও অভিযোগ করেন যে তিনি সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীদের “বিপথগামী “হিসাবে চিহ্নিত করে অহিংস অসহযোগ ও সত‍্যাগ্রহের পথে নিয়ে আসার জন‍্য বাড়তি উদ‍্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে সাম্প্রদায়িক শক্তির সংগঠিত উত্থানের বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধিতা অবশ্যই আন্তরিক ছিল কিন্তু তা নেহাতই ছিল অহিংসার আদর্শের প্রেরণায়। ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করায় বিশ্বাস করতেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই সীমাবদ্ধতার কারণেই একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া আর কারুর কাছ থেকে আর এস এস, হিন্দুমহাসভা ও পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের বিভাজনের রাজনীতির সর্বাত্মক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে গান্ধীজি চাইতেন ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে মানুষের শুভবুদ্ধির ঐক‍্য। যা শ্রেণীস্বার্থের সংঘাত ও দরিদ্রকে শোষণ করে ধনীর সম্পদবৃদ্ধির আর্থ সামাজিক  ব‍্যবস্থার কারণেই বাস্তবে তখনও অসম্ভব ছিল এবং এখনও অসম্ভব। ধনিক শ্রেণী নিজের প্রয়োজনেই সরকারের সঙ্গে হাত মেলাবে তা ব্রিটিশ আমলেও যেমন দেখা গিয়েছিল স্বাধীনতার পরেও তা বদলায় নি। বরং শ্রমজীবী মানুষের শোষণ বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলনকে বিভক্ত করার প্রয়োজনে কর্পোরেট পুঁজির মালিক এখন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে ব‍্যবহার করে। গান্ধীজি শ্রমিক আন্দোলন কে প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ মনে করতেন। তাঁর পথেই আরও একধাপ এগিয়ে শ্রমিকে ন‍্যূনতম মজুরির অধিকার এবং কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণের দাবি আজ কর্পোরেট প্রভুরা অপ্রয়োজনীয় মনে করে,শুধু তাই নয় কর্মচারীদের বিশেষত শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবিকার নিরাপত্তার দাবিও তাদের কাছে অবান্তর বলে মনে হয়।

অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সার্থকতা যদি গান্ধী আরউইন চুক্তির মাধ‍্যমে ভারতবর্ষের ডোমিনিয়ন স্ট‍্যাটাস আদায়কে গণ‍্য করা হয় তাহলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের শর্তে  ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন অবশ‍্যই গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করার ব‍্যর্থতার ফসল। কোন সন্দেহ নেই এই কারণে জীবনের শেষপর্বে গান্ধীজির অনুশোচনায় অন্ত ছিল না। কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে, ঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের মতোই ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি কখনও লুকিয়ে কখনও প্রকাশ‍্যে সক্রিয় থেকেছে। পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার দায় কোনো রাজনৈতিক দলের ছিল না এখনো নেই কিন্তু পাকিস্তান থেকে ভাষার ভিত্তিতে পৃথক হয়ে স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিমূহূর্তে মৌলবাদীদের সংঘাতের মুখোমুখি হয়। বস্তুত প্রথম সুযোগেই স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের গৃহীত সংবিধানে উল্লেখিত ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মুজিব হত‍্যার পরে সেখানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিসর্জন দেন এবং এর এগারো বছরের মাথায় ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারে ফেরার পরে ৫ম সংবিধান সংশোধন আদালতের রায়ে  বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সংবিধানে আবার উল্লেখ করা হলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এই যুক্তি দেখিয়ে সর্বোচ্চ আদালত ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেছে।

স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরের বছরেই হিন্দু মৌলবাদী ঘাতক নাথুরাম গডসের গুলিতে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু নিঃসন্দেহে সৌভ্রাতৃত্বের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে  সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রথম শক্ত চ‍্যালেঞ্জ হিসাবে গণ‍্য করা যায়। তিন বছরের মাথায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলিও আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক বিভাজন এভাবেই মৌলবাদীর ষড়যন্ত্র বিস্তারের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এককালের অখণ্ড এই রাষ্ট্রকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ‍্যবাদী শক্তির বিভাজন করে শাসন করো নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় গণ আন্দোলন কখনোই পরাধীন ভারতবর্ষে গড়ে না ওঠার দায়িত্বও কতকটা গান্ধীজীর ওপর বর্তায় বইকি। আর এস এস  মুসলিম তোষণের অভিযোগের প্রচার চালিয়ে  গান্ধীজিকে হত‍্যার যুক্তি সাজিয়েছিল গত তিন বছর  ধরে তার সপক্ষেই নতুন করে তুলে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারই অঙ্গ হিসাবে মহেশ মঞ্জরেকরের ছবি গডসে গত২০২২ সালে মুক্তি পায়। এই ছবি করার পিছনে ইতিহাসেল প্রতি বস্তুনিষ্ঠ থাকার যুক্তি দেখিয়ে পরিচালক সত‍্যটা মানুষই বেছে নিক – জাতীয় মন্তব্য করেছিলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতাকে হত‍্যার পিছনে যুক্তিকে সত‍্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার আরেকটি চেষ্টা।

গান্ধীজি নিহত হওয়ার পর  এই দেশের বহুত্ববাদী সহিষ্ণুতার ঐতিহ্যকে যে আর এস এস ধ্বংস করার জন‍্য বদ্ধপরিকর তা পরবর্তীকালে বার বার প্রমাণিত হয়েছে বিশেষত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পরে ভারতের আভ‍্যন্তরীন রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়ার চেষ্টা বেপরোয়াভাবে শুরু করেছিল আর এস এসের রাজনৈতিক মুখ ভারতীয় জনতা পার্টি,তাতে চূড়ান্ত সাফল্য আসে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে জয়ী হয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠনের মাধ‍্যমে। গুজরাটে দাঙ্গা লাগানোয় সফল মুখ‍্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার ঢের আগেই বেছে নিয়েছিল। এহেন নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে তাঁর দল  ভারতীয় জনতা পার্টি  জয়ী হয়ে সরকারে ফেরার পর বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেছিলেন “এই প্রথম নির্বাচনে প্রচার করার কোন দলই ” সেকুলার” শব্দটি সামনে নিয়ে আসতে পারেনি, আমাদের সাফল‍্য এটাই।” অতি সম্প্রতি সংসদে নতুন ভবনে সাংসদদের হাতে ভারতীয়  সংবিধানের যে মুদ্রিত কপি তুলে দেওয়া হয়েছিল,সেখানে ইচ্ছাকৃতভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্র শব্দ দুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এভাবেই রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে চাইছে গান্ধীজির হত‍্যাকারীরা।