দাম বাড়ছে সবকিছুরই, কমছে শুধু শ্রমশক্তির। শ্রমিকদের মজুরি কমছে। ২০১৯-‘২০ বর্ষেই দুনিয়ায় মজুরি থেকে আয় কমেছে ১০.৭ শতাংশ। আরো বেশি মুনাফার লোভে শ্রমিকদের মজুরি কমাচ্ছে পুঁজিওয়ালারা। মজুরি যেমন কমাচ্ছে, তেমনই কমিয়ে দিচ্ছে কাজের নিরাপত্তাও। আজ আছে, কাল কাজটা থাকবে কিনা ঠিক নেই। ছুটি নেই, কাজের ঘন্টার বাপ মা নেই। অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসার সুযোগ নেই, মালিকের দায়দায়িত্ব নেই, বয়সকালে পেনশনের গ্যারান্টি নেই। পৃথিবীর ৭০% মানুষের হয় একেবারেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা নেই, অথবা নামমাত্র রয়েছে। এই তো অবস্থা!


২০০৮ থেকেই পুঁজিবাদ গাড্ডায়। ১৪ বছরেও সে মুক্তি তো পেলই না, এমনকি মুক্তির দূরতম সম্ভবনাও দেখতে পেল না। সংকট কমার বদলে বেড়েই চলেছে। এখান থেকে বাঁচার উপায় নেই। অথচ বাঁচার জন্য আঁকুপাঁকু করছে পুঁজিওয়ালারা। সবচেয়ে বেশি যতটা পারা যায় মুনাফা লোটার জন্য যা করতে হয় এখন সে তাই করছে। শ্রমিকদের যতটা নিংড়ে নেওয়া যায়, তারচেয়ে একটুও কমে থামতে চাইছে না।
এই গোদের উপরই এসেছিল কোভিড ‘১৯। সাথে এনেছিল লকডাউন। কতজন ছাঁটাই হলেন? লকডাউন উঠে গেলে পুরনো কাজ ফেরত পেলেন কতজন? কতজন বাধ্য হলেন আগের চেয়ে কম মজুরির কাজে যোগ দিতে? আর কতজন বেকার হয়েই থাকলেন? লকডাউনের পর কি ছাঁটাই বন্ধ হল? আগে থেকেই জমেছিল বিপুল বেকারবাহিনি, তার সাথে আরো কত কোটি যুক্ত হয়ে ফ্যা ফ্যা ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তায়? কে দেবে এত হিসেব? কী’করে বাঁচবে মানুষ, শ্রমশক্তি ছাড়া যার বিক্রি করার কিছু নেই, সেই মানুষ?


কাজ হারানো মানুষ চিরকাল বসে তো থাকতে পারেন না! খেয়ে পরে বাঁচতে তো হবে! সংসার চালাতে তো হবে! বাধ্য হয়েই যে যেমন কাজ পাচ্ছেন, সেটাই করতে শুরু করছেন। বেগার খাটছেন, খুঁটে খাচ্ছেন। একজন একদিনে, হয়তো, দুটো বা তিনটে কাজ করছেন। দিনের বেলা দোকানে দোকানে মাল সাপ্লাই করছেন, রাতে কোনো বিল্ডিংয়ের বাইরে টুলে বসে পড়ছেন সিকিউরিটি গার্ডের পোষাকে। সকালে কোনো বেসরকারি অফিসে যাচ্ছেন হাজার পাঁচেক টাকার মাইনেতে, সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় কোনো অ্যাপে লগ-ইন ক’রে তিন চার টিপ বাইক চালিয়ে নিচ্ছেন। সারাদিন হয়তো এর-ওর-তার-তার বাড়িতে ফাইফরমাশ খেটে দিচ্ছেন, সন্ধেবেলা অটো চালাচ্ছেন কয়েক ঘন্টা, তারই সাথে হয়তো জমি বাড়ির দালালিও করতো হচ্ছে। মোদ্দা কথাটা হল, শ্রমিকশ্রেণির বিপুল অংশটাই আজ খেপ খাটছেন এভাবে।
শ্রমিকশ্রেণি তার সংগঠিত চেহারা হারাতে শুরু করেছে বহু আগেই। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শুরু থেকেই। এখন অসংগঠিত ক্ষেত্রটাও চেতরে-বেতরে গেছে। একটা বড় অংশই এখন তথাকথিত ‘স্বনিযুক্ত’। গত ১৮ই মে ২০২২ প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্ষদ State of Inequality in India Report প্রকাশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশে আয় করেন এমন জনসংখ্যার সর্ববৃহৎ অংশটাই ‘স্বনিযুক্ত’। ৪৫.৭৮ শতাংশ।


‘স্বনিযুক্ত’ মানে? আসলে তিনি বেকার, কাজ জোটেনি তাই কিছু একটা করছেন নিজেই। অথচ সরকার দেশে কর্মহীনের সংখ্যা কমিয়ে দেখাবে ব’লে বেকারের তালিকায় তার নাম রাখেনি। স্বনিযুক্ত কর্মীদের প্রায় সকলেই আসলে কোনো না কোনো রকমের শ্রমিক, কিন্তু শ্রমিকের স্বীকৃতি নেই। কাউকে ডাকা হয় ‘ফ্রিলান্সার’, কাউকে ‘ইণ্ডিপেন্ডেন্ট কন্ট্রাক্টর’, কেউবা আবার ‘পার্টানার’ নামে। ‘মজুরি’ বা ‘বেতন’ নয়, সামান্য যা আয় করেন সেটাকে বলা হয় ‘কমিশন’। ‘ইনসেনটিভ’ও আছে। এরকমই কতই রঙ্গ, কতই বাহার! অথচ মোদ্দা কথাটা হল, এঁদেরই চুরি যাওয়া শ্রমে মুনাফা বাড়ছে কারোর না কারোর।
শ্রমজীবী জনতাকে নিংড়ে নেওয়ার এই এক দারুন চালাকি। শ্রমশক্তি নিয়োগ করো, সেটা তো করতেই হবে, শ্রমশক্তি নিযুক্ত না হলে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করবে কে? মুনাফা জোগাবে কে? তাই নিয়োগ করো, কিন্তু করো পরোক্ষভাবে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। প্রত্যক্ষ নিয়োগ মানে নিয়োগকারীর সাথে নিযুক্ত কর্মীটির একটা শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল! পুঁজিবাদ জানে, ঝামেলা ওখান থেকেই শুরু! প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই কাজের ঘন্টার হিসেব, ন্যূনতম মজুরি, মজুরির সাথে এটা-ওটা দায়দায়িত্ব, দরকষাকষি, বহুৎ হ্যাঙ্গাম! তারচেয়ে কায়দা ক’রে যদি শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটাকেই আবছা করে দেওয়া যায়, তাহলেই কেল্লাফতে! সাঁপও মরবে, পুঁজিবাদের লাঠিও ভাঙবে না!
আপাতভাবে দেখলে মনে হবে, সুইগীর সাথে সুমনের সম্পর্কটা ঠিক শ্রমিক-মালিকের নয়। সুইগীও তাকে ‘পার্টনার’ ডাকে। তাছাড়া সুমন শ্রমিক হলে তো তাকে রোজ নির্দিষ্ট সময় বাধ্যতামূলকভাবে গতর খাটাতে হত, কিন্তু তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা তো নেই। অ্যাপ তো আছে নিজেরই মোবাইলে, যখন খুশি লগ-ইন করতে পারে সে! যখন খুশি লগ-আউট। ইচ্ছে হলে দুটো ডেলিভারি করেই বাড়ি চলে যেতে পারে, ডেলিভারি পিছু ১৫টাকা আর কিলোমিটার পিছু ৫টা মতো! ইচ্ছে হলে সে পনেরোটা ডেলিভারিও করতে পারে, বা তারও বেশি। আবার ইচ্ছে না হলে একটাও নাই করতে পারে। ‘পার্টনার’ বলেই না এত ফ্রিডম, ‘ওয়ার্কার’ হলে থোড়েই পেত!


যদিও আসল গল্পটা হল, দিনে ১০ ঘন্টা লগ-ইন থাকলে এবং ১৩টা ডেলিভারি করলে তবেই সেদিন ৭৫০টাকা আয় গ্যারান্টি হয় ছেলেটার। ৫০০ টাকার কাজ করলে সামান্য ইনসেনটিভ! আবার এরও অনেক সাবপ্লট আছে; ওই যে ১৩টা ডেলিভারি করতেই হবে, সাধারণত দেখা যায় ৯টা কি ১০টা ডেলিভারির পর ফোনে আর অর্ডারই আসছে না! লে সামলা! সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় অ্যাপের মাধ্যমে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স! সেই প্রযুক্তি যাদের হাতে অর্থাৎ সুইগীর মতো সংস্থা, একটা বাড়িতে এক প্লেট বিরিয়ানি ডেলিভারির এই পুরো প্রক্রিয়ায় তাদের কিন্তু কোনোই বিনিয়োগ নেই। খাবার তৈরি হচ্ছে রেস্টুরেন্টে, সেখানে বিনিয়োগ করেছেন রেস্টুরেন্টের মালিক আর শ্রম প্রয়োগ করেছেন তার কর্মীরা। ডেলিভারির জন্য বাইক, বাইকের তেল সেসবের খরচ তো সুমনের। কোম্পানিটি শুধু রেস্টুরেন্ট, ডেলিভারি শ্রমিক এবং উপভোক্তাদের একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কানেক্ট করিয়ে দিচ্ছে। অথচ পুরো নিয়ন্ত্রনটাই তাদের হাতে আর মুনাফাটাও। মুনাফার একটা ভাগ অবশ্য রেস্টুরেন্টের মালিকও পাচ্ছেন, রেস্টুরেন্টের কর্মীরা পাচ্ছেন নির্দিষ্ট মজুরি। আর আমাদের সুমন? সে যেটা পাচ্ছে সেটা নেহাত ‘কমিশন’। তাও কত? ১০ ঘন্টা খেটে, ১৩টা ডেলিভারির জন্যে কয়েক লিটার তেল পুড়িয়ে, রেস্টুরেন্টের সামনে কিংবা কাস্টমারের বাড়ির বাইরে পার্কিংয়ের জায়গা না পেয়ে বাইক রেখেছে ব’লে ট্রাফিকের জরিমানা গুনে মাত্র ৭৫০ টাকা। অতয়েব শেষাবধি কিছুতেই গল্পটা ‘ফ্রিডম’-এর নয়, গোলামিরই। জঘন্য কায়দায় নির্মম লুটের। এবং এনিয়ে কোনো তর্ক চলতেই পারে না।


এই কায়দাটার পোষাকী একটা নামও দেওয়া হয়েছে ইদানিং। গিগ অর্থনীতি। সেই অর্থনীতিতে যারা কাজ করছেন, তাদের বলা হচ্ছে গিগ শ্রমিক।


ঠিক কাকে বলব গিগ শ্রমিক? শুধু সুমনকে? মানে সুমনের মতো ডেলিভারি-বয়দের? না, ডেলিভারির কাজ ছাড়াও আরো হাজার রকম কাজে যুক্ত কর্মীরাই গিগ শ্রমিকের আওতার মধ্যে পড়বেন। শ্রমিকশ্রেণির বহু সংগ্রামে অর্জিত শ্রম আইনগুলো পাল্টে মোদি সরকার যে চারটে শ্রমকোড বানিয়েছে, তার একটায় (কোড অন স্যোশাল সিকিুরিটি) গিগ শ্রমিককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এইভাবে, “a person who performs work or participates in a work arrangement and earns from such activities outside of traditional employer-employee relationship.” অর্থাৎ কিনা যিনি তাঁর নিয়োগকারীর সাথে কোনো প্রথাগত শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে আবদ্ধ নন। এই কোডেই ‘প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হচ্ছে, “platform work” means a work arrangement outside of a traditional employer employee relationship in which organisations or individuals use an online platform to access other organisations or individuals to solve specific problems or to provide specific services or any such other activities which may be notified by the Central Government, in exchange for payment‌” ।