স্বাধীনতার অল্প কিছু পর থেকেই কলকাতার রাজভবন কে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালেরা কার্যত কেন্দ্রের শাসকদের দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। এই রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর ই প্রথম ব্যক্তি যিনি কেন্দ্রের শাসকদের দলীয় কার্যালয়ের পাশাপাশি কলকাতার রাজভবনকে সাম্প্রদায়িকতার আখড়াতেও পরিণত করলেন। আর এস এস – বিজেপি শিবিরভুক্ত দুশোর ও বেশি ‘ সাধু’ র সামনে নাম না করে জগদীপ ধনকর যেভাবে তথাকথিত ‘ তোষণ’ তত্ত্বের আড়ালে মুসলমান সম্প্রদায় সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, কার্যত হুঁশিয়ারি দিলেন, তাতে তাঁকে কোনো সাংবিধানিক প্রধান বলে মনে হচ্ছিল না।মনে হচ্ছিল , আর এস এস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মত সঙ্ঘের কোনো শাখা সংগঠনের সদস্য।
বিজেপির মুখ্যপাত্র হিশেবে নূপুর শর্মা কিছুদিন আগে হজরত মহম্মদ সম্পর্কে অত্যন্ত আপত্তি জনক বেশ কিছু কথা বলেছিলেন।নূপুর শর্মার সেই আপত্তিজনক কথা ঘিরে কেবল ভারতেই প্রতিবাদ ওঠে নি, আন্তর্জাতিক স্তরে বিস্তর প্রতিবাদ উঠেছিল।এমনকি ভারতের উপর অর্থনৈতিক চাপ ও কিছু কিছু রাষাট্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল।নূপুর শরামার ওই বিদ্বেষমূলক কথা ঘিরে কিন্তু রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর আজ পর্যন্ত একটা কথা বলেন নি। হিন্দু দেবতার অপমান ঘিরে সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল গর্জে উঠলেন আর বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মা যখন হজরত মহম্মদ ঘিরে চরম অমর্যাদাপূর্ণ কথা বললেন, তখন সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল নীরব থাকলেন।রাজ্যপালের এই পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে তাঁর সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য টি বেশ ভালোভাবেই।


তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র কি উদ্দেশ্য নিয়ে হিন্দু দেবতা কালী সম্পর্কে কুরুচিকর শব্দ উচ্চারণ করেন, পরে টুইটে সেই কুরুচির পক্ষেই আবার সাওয়াল করেন- তা আমাদের বুঝে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয় না। নূপুর শর্মার কুরুচিকর মন্তব্যের জেরে মুসলমান ভাবাবেগে প্রচন্ড আঘাত লেগেছে। তার জেরে আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভারত ক্রমশঃ কোনঠাসা হয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেই জায়গা থেকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি গোটা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যে ঘৃণা তৈরি হয়েছে। রাগের জন্ম নিয়েছে। সেইসব কিছু থেকে গোটা সমাজের দৃষ্টিটা যাতে অন্য দিকে প্রবাহিত হয় , ঠিক সেই কারনেই তৃণমূল সাংসদ হিন্দুদের আরাধ্য দেবী কালী সম্পর্কে এই স্পর্ধোক্তি করবার দুঃসাহস অর্জন করতে সাহস করেছিল।
মহুয়া মৈত্র বা তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ই ছিল নূপুর শর্মাকে আড়াল করতে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করা।সেই আঘাতের জেরে হজরত মহম্মদ সম্পর্কে গোটা হিন্দু আধিপত্যবাদীদের অসূয়া, অশ্রদ্ধা- যার জেরে কেবল মুসলমান সমাজ ই নয়, যে কোনো ধর্মের ই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ, এমন কি ধর্মনিষাঠ মানুষের মনে যে যন্ত্রণা তৈরি হয়েছে- সেই যন্ত্রণা , আবেগকে ভিন্ন খাতে বইয়ে দিতেই হিন্দু দেবী কালীকে ঘিরে তৃণমূল সাংসদের এই বিষোদগার।


সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদী আর এস এস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে নূপুর শর্মার হজরত মহম্মদ কে ঘিরে নীতিবহির্ভূত আক্রমণ থেকে বাঁচাতেই অত্যন্ত হিশেব কষে, হয়ত বা নাগপুরের রেশমবাগের ‘ কেশব ভবনে’ র কর্তা মোহন ভাগবতের নির্দেশেই মহুয়া মৈত্রকে দিয়ে একাংশর মানুষের ভাবাবেগে আঘাত সৃষ্টিকারী এইসব কথাগুলো বলানো হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য করা দরকার যে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু কখনো ই ধর্মনিরপেক্ষ পথে নিজেকে পরিচালিত করেন না।প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় রীতিনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রকাশ্য যাপনচিত্রের সম্পর্ক ঘিরে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের বিতর্কের কথা আমরা জানি পুনর্গঠিত সোমনাথ মন্দিরের দ্বারোদঘাটন ঘিরে। সেই সোনালী অতীত আমরা হারিয়েছি।বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কখনো ই ধর্মনিষ্ঠ আচরণের ধারপাশ দিয়ে হাঁটেন না।সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থে এঁরা , এঁদের দলের সবাই ই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে থাকেন ।আর ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ই জটিল এবং উত্যপ্ত করে তোলে সাম্প্রদায়িকতাকে।


মুসলমানদের নাগরিকত্ব হরণ করে, তাঁদের আর্থ- সামাজিক- সাংস্কৃতিক অধিকার হরণ করে রাজনৈতিক হিন্দুদের ‘ জিম্মি’ বানানো ই ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তি আর এস এসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির একমাত্র উদ্দেশ্য।এভাবেই তারা দেশের সংবিধানের খোলনোলচে বদলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল করতে ই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজপার্টি, বিহারে নীতীশকুমারের দল, উড়িষ্যাতে নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল ,মহারাষ্ট্রে শিবসেনার দুই শিবির ইত্যাদিরা অত্যন্ত অনুগত দালালের ভূমিকা পালন করে চলেছে। সংসদের ভিতরে বা বাইরে বিজেপি যখন ই বিপদে পরে আড়ালের ত্রাতা হয়ে অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় থাকা প্রায় সব দল ই তখন নিজেদের অবিচল বিজেপিজীবী ভূমিকা টি পালন করে।পশ্চিমবঙ্গে ও আর এস এস – বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিকে সামাজিক ভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে তৃণমূল কংগ্রেসের চেষ্টার ত্রুতি নেই।আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মুসলমান সমাজের একবিন্দু আর্থ- সামাজিক উন্নতি মমতা করেন নি।কিন্তু মমতা তাঁর নিজের দলের প্রতি অনুগত একাংশের ইমাম – মোয়াজ্জিনদের জন্যে মুসলমানদের ই হকের ওয়াকফের টাকা দিয়ে তাঁদের ভাতা দিতে শুরু করেছেন ক্ষমতায় এসে ই।মমতার এই ছদ্মবেশী ‘ মুসলমান প্রেম’ যে কেবল মুসলমান সমাজের ভিতরেই একটা অন্তর্বিরোধের জন্ম দিয়েছে তা নয়, মোদি ক্ষমতায় আসার আগে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা হিন্দু সমাজের ভিতরে আরো গভীর ভাবে দানা বাঁধতে সাহায্য করেছে।একটা বড় অংশের হিন্দু পুরোহিতদের ভিতরে আর্থিক বঞ্চনার মানসিকতা ওই ইমাম ভাতার ফলে প্রশ্রয় পেয়েছে।আর সেই মানসিকতাই ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপির এই রাজ্যে ভোট বৃদ্ধি ঘটিয়েছে।পরবর্তীতে মমতা এবার পুরোহিত ভাতা চালু করে গোটা বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলেছেন।


এই যে সাম্প্রদায়িকতার পারস্পরিক প্রতিযোগিতা, তার ই অঙ্গ হল দেবী কালীকে ঘিরে তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিষোদগারের রাজনৈতিক পটভূমি। নূপুর শর্মার হজরত মহম্মদ কে অসম্মান করার গোটা বিষয়টা ঢেকে দিয়ে ধর্মের আকারে একটা উগ্র ভাবাবেগ কে ধর্ম বলে চালাতেই আর এস এস – বি জে পির গোপন অথচ বিশ্বস্ত বন্ধু হিশেবে মহুয়া মৈত্র দেবী কালী সম্পর্কে ওই আপত্তিজনক কথা গুলি বলেছেন।পরিবেশ কে আরো জটিল, আরো উগ্র এবং উত্তেজক করে তুলে বিজেপিকে বিভাজনের রাজনীতিকে আরো সুগম করে দেওয়াই তৃণমূল সাংসদের উদ্দেশ্য।


তৃণমূল সাংসদের এই উদ্দেশ্য কে সফল করতেই তাই সাংবিধানিক পদে থেকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর বিজেপির দলীয় নেতা হিশেবে রাজভবনে দাঁড়িয়ে নিজের কথাগুলি পেশ করলেন। হিন্দুদের দেবদেবীর অপমানের প্রসঙ্গ তুলে রাজ্যপাল ‘ তোষণ’ তত্ত্বের অবতারণা করলেন।পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন রাজ্যপালকে খোদ রাজভবনের মাটিতে দাঁড়িয়ে আর এস এস- বিজেপির রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী কথা বলবার সুযোগ করে দিয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, অর্থনেতিক স্বনির্ভরতা– এইসবের ধারপাশ দিয়ে মমতার প্রশাসন বিগত বারো বছরের শাসনকালে হাঁটেন নি। সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আধুনিক, বিজ্ঞানমুখী শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ রুদ্ধ করে দিয়েছেন মমতা।মাদ্রাসা গুলিতে নিয়োগ কার্যত বন্ধ। পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলিতে সরকারি প্রাইমারি ইস্কুলগুলির অবস্থাও তথৈবচ।তীব্র বেকারির জ্বালায় ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছে সংখ্যালঘু সমাজের ছেলেমেয়েরা।সেখানেও কেবলমাত্র বাংলাভাষায় কথা বলবার দায়ে সেইসব রাজ্যের পুলিশ ওইসব মানুষদের দেগে দিচ্ছে ‘ বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিশেবে। তাঁদের কোনো রকম আইনি সুরক্ষা দিচ্ছে না মমতা প্রশাসন।


এরকম একটা পরিস্থিতির ভিতরে দেবী কালী বিতর্ক। সেই বিতর্ক ঘিরে অনড় অবস্থানে মহুয়া মৈত্রের থাকা ।অথচ যেকোনো ইস্যুতে অত্যন্ত সবাক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে এই ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাক দেখা – এসবের অর্থ কি জনগন বুঝছে না?
আর রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গটি ঘিরে সাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করা, রাজ্যপালের পদে থেকে খোদ রাজভবনের ভেতরে দাঁড়িয়ে ,ভিন্ন ধর্মাবলম্বী সহ নাগরিকদের উদ্দেশ্যে ,নাম না করে ,এইভাবে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলা –এই ভয়ংকর অবস্থার ভিতর দিয়েই কিন্তু এখন আমরা নিত্যদিন গুজরাণ করছি। মমতা তার সাংসদ মহুয়া মৈত্র বা রাজ্যপাল ধনকর কিংবা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী ,এঁদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, কেবলমাত্র সংখ্যাগুরু ভাবাবেগের মর্যাদাই তাঁদের কাছে আছে ।সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভাবাবেগের কোনো মর্যাদা তাঁদের কাছে নেই। আর মানুষের রুটি রুজির প্রশ্ন? সেসব তাঁরা এখন নিশ্চিন্তে, নিরাপদে বাক্সবন্দী করে রেখেছেন ।নির্বাচন এলে আবার সেই সব ললিপপগুলো মানুষের সামনে দেখিয়ে ,ভোট বাক্স ভর্তি করতে চাইবেন এইসব নেতারা।