কেমন আছেন গ্রামবাংলার মানুষ? কেমন আছে গ্রামবাংলার আকাশ-বাতাস-জলহাওয়া? রাজ্য যখন তীব্র দাবদাহে জ্বলছে, যখন কেমন চলেছে কৃষিকাজ ? এ সমস্ত উত্তর পাওয়ার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রচিত আর্থিক সমীক্ষায়। চলতি বছরের আর্থিক সমীক্ষায় ছবি এবং বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।

তাই খুঁজতে হয় অন্য তথ্যের ভাণ্ডার এবং প্রকাশিত কিছু খবর। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে কান পাতলে যে কথাগুলি উঠে আসে তার মধ্যে শাসকের দুর্নীতি আছে কিন্তু সাধারণ মানুষের মূল চাহিদা হল কাজ। কোথায় কাজ? রেকর্ড বেকারি আক্রান্ত করেছে গ্রামের মানুষকে। ২০১৯ সালেই গ্রামবাংলায় বেকারের সংখ্যা বেড়েছিল ৮.৩ লক্ষ। তারপর কোভিড হয়েছে, লকডাউন হয়েছে, গ্রামবাংলার পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছে। কোথায় ফিরে এল ? যে কৃষিতে অন্নসংস্থান হয় নি বলে তাঁরা কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছিল, সেই কৃষিতেই খেতমজুরি করতে শুরু করল তাঁরা। মজুরি কোথায় ? মজুরি স্বল্প, কাজও নেই। বেশ কিছু মানুষ আবার কাজের খোঁজে ছুটলেন ভিনরাজ্যে।

এরকম কি হওয়ার কথা ছিল ? দেশে সঙ্কট ছিল, কিন্তু কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পও ছিল- একশ দিনের কাজ প্রকল্প বা এমজিএনরেগা ? তার কি হল ? সম্প্রতি এক সমীক্ষা হয়েছিল পুরুলিয়া এঁর বাঁকুড়ার ৭টি গ্রামে। কাজ হবে বলে এই কটি গ্রামে জবকার্ড করে অপেক্ষা করতে করতে মাস, বছর সব ঘুরে গেছে। কাজ আসে নি, কাজ করেও মজুরি আসে নি। গ্রামবাসীরা সেই সংস্থার সমীক্ষকদের জানিয়েছেন যে তাদের পেনসন বা অন্য আয়ের পথ সব বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার থেকে ঋণের ভারে তাঁরা জর্জরিত। কাজ না হলে বাঁচার এঁর কোন পথ নেই। সরকারী তথ্য আর বাস্তবে মিল নেই। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই প্রকল্পে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে। আমরা দেখেছিলাম যে কেন্দ্রের ঘোষিত বাজেটে এই প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ যথেষ্ট নয় এবং এই প্রকল্পের যত চাহিদা বেড়েছে, তত বরাদ্দ কমেছে। ২০২০-২১ সালে এই প্রকল্পে কাজ করতেন ১.৩ কোটি মানুষ এ রাজ্যে। কাজ কমে ২০২১-২২ এ তা হল ১.২ কোটি। ২০২৩ সালে তথ্য জানাচ্ছে এই প্রকল্পে কাজের দাবিদার কমে হয়েছে ৪৪৪৩। কি কাজ করবে গ্রামের মানুষ ? রেগার কাজ বন্ধ, অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজ আসছে না, খেতমজুরিতে আয় নেই।

কাজ নেই, তাই সংসার চলবে কি করে? ধার করতে হবে, তাই করে চলেছে ধার। চড়া সুদের হারে বেসরকারী ক্ষুদ্র সংস্থা থেকে ধার করে চলেছে গ্রামের মানুষ। পরিবারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো অনেক পরিবারে এখানে বিলাসিতা। তাই অল্পবয়সী ছেলেদের কাজে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এর সাথে অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া বেড়ে গেছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের এক সমীক্ষায় জানা যায় যে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের গ্রামে মেয়েদের মধ্যে ৫২.৩% শিক্ষার আঙিনার বাইরে। ছেলেদের মধ্যে এর অনুপাত ১৫.৭%। এই তথ্য ২০২০ সালের। তাহলে কন্যাশ্রী প্রকল্প দিয়েও অল্পবয়সে বিয়ে ঠেকানো গেল না মেয়েদের? আসলে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কন্যাশ্রীর অর্থ পাওয়া যাবে বলে স্কুলের খাতায় মেয়েটির নাম লিখিয়ে বিয়ের টাকার জোগাড় হয়ে যায় আর পরিবারে কিছু অর্থ হয়।জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার সর্বশেষ রিপোর্ট জানাচ্ছে যে এ রাজ্যের গ্রামে কন্যাশিশুদের ৪৮% দের ১৮ বছরের নীচে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটিকে সরাসরি কাজে লাগিয়ে দিলেই তো হয়। তাই হয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার জানিয়েছে যে এ রাজ্যে কোন শিশু শ্রমিক নেই, তুলে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী সমস্ত শিশুশ্রমিকদের জন্য বিদ্যালয়গুলি। অথচ ২০১২ সাল থেকেই এ রাজ্যে বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে যে শিশু শ্রমিক বাড়ছিল তা গবেষকদের সমীক্ষা

মূলক গবেষণায় উঠে এসেছিল। উত্তর দিনাজপুর, কুছহবিহার-এই সব উত্তরবঙ্গের জেলায় বেড়ে চলেছিল শিশুশ্রমিক। শিশুশ্রমিক হয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের দলের সাথে ভিনরাজ্যে চলেও গেছে তারা। তাই এই ছেলেদের কোন খতিয়ান কোথাও নেই। এভাবেই পরিবারকে আর্থিক ভাবে টিকিয়ে রাখছেন গ্রামের মানুষ। এ বেঁচে থাকা কি বেঁচে থাকা? ২০২৩ সাল সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনীর ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত। এই সংশোধনীর ফলেই দেশে এসেছিল বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েতের শাসন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা সবচেয়ে আগে মেনে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করে। ত্রিশ বছর পর কেমন আছে এই ব্যবস্থা এ রাজ্যে? মানুষের অংশগ্রহণের কথা ভুলে গেছে গ্রামের মানুষজন। গ্রামের পর গ্রাম আছে শুধু গরুপাচারকারী, কয়লা মাফিয়া, বালিপাচারকারীদের রাজত্ব। এই রাজত্ব চালায় বাস্তুঘুঘুরা, বামফ্রন্ট সরকারের অপারেশন বর্গার ফলে যারা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল। জমিদার- জোতদার লেঠেল বাহিনীরা বংশ পরম্পরায় গ্রাম বাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে, মহাজনী কারবার চালিয়েছে। কিন্তু ত্রিশ বছর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। তাই ২০০৯/১০ সাল থেকেই গ্রামে ফিরে আসার নানা চেষ্টা করতে থাকে এই বাস্তুঘুঘুর দল। জমিও টুকরো টুকরো হতে শুরু করল ভাগ হতে হতে। তখন কৃষির ভিত্তিতে শিল্প গড়ার সময় পশ্চিমবঙ্গে।কৃষি থেকে আয় কমছে, অ-কৃষি জনিত রোজগার গ্রামে বাড়ছিল। গ্রামের মানুষের আয় বেড়ে যাওয়ার ফলে চাহিদা বাড়ছিল, এবং এর ফলে অ-কৃষি উৎপাদন বাড়তে শুরু করল।

২০১০ সালের দেশে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের আদমসুমারি হল। তাতে দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গ এক নম্বরে। এর কারণ কিন্তু গ্রামের কুটির শিল্প। কিন্তু এই সব কিছু সম্ভব হয় পেটে ভাত পড়লে।

২০১১ সালের পর গ্রামে যারা দাপিয়ে বেড়ালো তাদের বেশির ভাগই গ্রামে ফিরে আসা জোতদার-জমিদারের পরিবারের মানুষজন। জমিদারি ব্যবস্থা নেই, কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহারের দাম দিতে হল গ্রামের মানুষকে। জমি-মাফিয়া থেকে শুরু করে গ্রামজুড়ে মাফিয়ারাজ ধ্বংস করতে উদ্যত হল বাংলার গ্রাম। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পথ কেটে তৈরি হল ভাদু শেখের মত মাফিয়া যারা চোরাচালানে সিদ্ধহস্ত। তৃণপমুল কংগ্রেস এবং বি জে পি এদের ভিত্তি করেই নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তৃত করল। মানুষের পেটে গরম ভাতে টান পড়ল।

কেমন আছে গ্রামের মানুষজন? অনাহার বাড়ল। কাজ নেই, রোজগার নেই, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা ভুলতে বসেছে গ্রামের মানুষ। কৃষি উৎপাদন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঘটে যাচ্ছে কৃষক আত্মহত্যা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জানালেন যে একজন কৃষকও আত্মহত্যা করেন নি। সেই মর্মে জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো তার পরিসংখ্যানে কৃষক আত্মহত্যার পাশে সংখ্যা লিখে দিল শূন্য। কিন্তু ২০২১ সালে তথ্যের অধিকার আইনে এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছিল যে ঐ বছরেই একমাত্র পশ্চিম মেদিনীপুরে ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছিল। পড়ে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী জানান নিজের বক্তৃতায় যে ঐ তথ্য ভুল ছিল। অসত্য কথা কারণ পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সভার কাছে যে তথ্য আছে তার ভিত্তিতে জানা যায় ২০২২ সালের মধ্যে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ২১৭। প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চয়ই এর চেয়ে বেশি কারণ সব তথ্য জানা যায় না। ২০১১ সালের আগে গ্রামে এত ব্যপক হারে কৃষক আত্মহত্যা শোনা যেত? পঞ্চায়েতের বাংলায় গ্রামের মানুষের বেঁচে থাকার নানা উপায় ছিল। ছিল পঞ্চায়েতের নোটিশ বোর্ড। সেখানে থাকত নাঙা খোঁজখবর। এখন খোঁজখবর বলতে রাজ্য সরকারের নানা নামের প্রকল্প।

শোনা যায় যে প্রকল্পের সংখ্যা নাকি ৯৯। গ্রামবাংলার পরিবারগুলির আর্থিক সঙ্কটের দায় এড়াতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দপ্তর? মানুষের কাজ না থাকার দায় এড়াতে পারেন দেশের প্রধানমন্ত্রী?

ত্রিস্তর ব্যবস্থায় মানুষের পঞ্চায়েত তুলে দিয়ে আমলা তান্ত্রিক প্রথায় পঞ্চায়েত চালানো কি মানুষকে ত্রাতায় পরিণত করল না? কারুর মনে হল না যে এই সুরক্ষা কবচগুলি মানুষের অর্জিত অধিকার ছিল। সেই অধিকার কেড়ে নিয়ে তাঁর টুকরো প্রকল্প হিসেবে তাঁকে দিলে তাঁর প্রাপ্য তো ছিনিয়ে নেওয়াই হয়। গ্রামের মানুষ আজ বিক্ষুব্ধ। নানা ভাবে এই বিক্ষোভ চোখে পড়ছে। তাদের প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধেই তাঁদের ক্ষোভ। দলমত নির্বিশেষে গ্রামবাংলার মানুষের এই ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। শাসকেরা এই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন তো?