আধুনিক ইতিহাসের সব থেকে শ্রদ্ধেয়, আলোচিত চরিত্র আর্নেস্তো চে গ্যেভারার জীবনকে প্রচন্ড বৈচিত্র্যময় বললেও অনেকখানি কম বলা হয়। মৃদুভাষী, বহুমুখী এই ব্যক্তিত্ব বছরের পর বছর সময় ধরে গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছেন তাঁর কর্মকান্ডের জন্য তিনি পৃথিবীর কত মানুষের কাছে ঘৃণ্য ও তারও বহু গুন বেশি কত মানুষের কাছে তিনি ঠিক কতটা প্রিয়, ভালোবাসার।

অনুসন্ধান করা যাক সময়ের চাদরে লুকিয়ে থাকা মানুষটির নানা আকর্ষণীয় গল্পের।

১৯২৮ সালে আর্নেস্তো গ্যেভারার জন্ম আর্জেন্টিনার রোজারিওতে।

শংসাপত্রে আর্নেস্তোর জন্মদিন ১৪ জুন, ১৯২৮ হলেও আদতে তাঁর জন্ম আরও এক মাস আগে। আর্নেস্তোর বাবা মা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর, তৎকালীন রক্ষণশীল আর্জেন্টিনাতে বিতর্ক এড়াতে আর্নেস্তোর জন্মদিন শংসাপত্রে পরিবর্তন করে দেন।

আর্নেস্তো গ্যেভারা ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত। ১৭০০-এর দশকে চের পূর্বপুরুষরা আয়ারল্যান্ড ছেড়ে নতুন যে জায়গায় আসেন, সেটিই বর্তমানে আর্জেন্টিনা। চে-র বাবা আর্নেস্তো গ্যেভারা লিঞ্চ নিজের পুত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, ” আমার ছেলের শিরায় আইরিশ বিদ্রোহীদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে “। ২০১৭ সালে, আয়ারল্যান্ডের ডাক পরিষেবা চে স্মরণে একটি ডাকটিকিট জারি করে যেখানে ছিল বিপ্লবীর পৃথিবী বিখ্যাত ছবি। যদিও ডাকটিকিটে চের ছবি আর্জেন্টিনা, কিউবা, রাশিয়াতেও আছে তবে ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসের পট পরিবর্তন করে দেওয়া বিপ্লবীর এই আইরিশ শিকড় আমাদের অনেকেরই সামনে আসে না।

বার্থ সার্টিফিকেটের নাম অনুযায়ী আর্নেস্তো গ্যেভারা রাফায়েল ডে লা সেরনা, কী করে “চে” হয়ে উঠলেন, সেখানেও লুকিয়ে আছে একটা ছোট্ট মজা। আর্জেন্টিনায় “চে” হল বন্ধু বা দোস্ত কে সম্বোধন করার ডাক। আর্নেস্তো এই শব্দ এতটাই ব্যবহার করতেন যে পরবর্তীতে তাঁর কিউবার কমরেডরা তাঁদের কাছে নতুন শোনা এই বিদেশী শব্দকে আর্নেস্তোর নামের সাথে জুড়ে দেন। আর্নেস্তো গ্যেভারা, গোটা পৃথিবীর কাছে হয়ে ওঠেন চে গ্যেভারা।

ছোট বেলা থেকেই শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য রোগে চে এতটাই ভুগেছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁকে মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। বুয়োন্স ইয়ার্স ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৫৩ সালে ফিজিশিয়ান হিসাবে কুষ্ঠরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি স্নাতক হন এবং এরপরে মেক্সিকো জেনারেল হসপিটালে এলার্জি নিয়ে ইন্টার্ন হিসাবে রিসার্চ শুরু করেন। এরই মাঝে নিজের বাইক ” লা পোডেরোসা ” তারপর বেরিয়ে পরেন ল্যাটিন ভ্রমণে, এক অবিস্মরণীয় পরিবর্তনের খোঁজে। ” দ্যা মোটরসাইকেল ডায়েরি “-র গল্প তারপরে অনেকেরই জানা। স্প্যানিশ শব্দদ্বয় ” লা পোডেরোসা “-রই ইংরাজি অর্থ হল, দ্যা পাওয়ারফুল।

চে-র হবির পরিসীমা ছিল সুবিশাল। তিনি যৌবনে প্রচন্ড রকমের রাগবি খেলতে ভালোবাসতেন। তিনি একটা দীর্ঘ সময় সান ইসিড্রো রাগবি ক্লাবে স্ক্রাম-হাফ খেলেন, তারপর ১৯৫১ সালে ট্যাকল নামে রাগবি খেলার প্রতি নিবেদিত তার নিজস্ব ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছিলেন। শ্বাসকষ্টের জন্য তাঁকে রাগবি খেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে আসতে হলেও তিনি বলেছিলেন, “রাগবি খেলার জন্য একদিন আমার মৃত্যু হতে পারলেও, আমি এটি খেলতে পেরে খুশি।”

তার সাথে চের ছিল দাবা খেলার নেশা যেটা তিনি সারা জীবন বহন করেছিলেন।

খেলার মাঠের বাইরে চে-এর প্রিয় ছিল কবিতা। চে-এর মৃত্যুর পর একটি সবুজ কবিতার খাতা উদ্ধার হয় নিজের হাতের লেখায়। খাতাটি ভর্তি ছিল পাবলো নেরুদা, সিজার ভ্যালেজো এবং নিকোলাস গুইলেনের কবিতায়। শুধুমাত্র তাই নয় হ্যাটম্যান ও কিটস ও ছিল তাঁর বেশ প্রিয়।

কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের পর, চে গ্যেভারা অর্থনীতির সাথে জড়িত বিভিন্ন পদে নিযুক্ত হন। ১৯৫৯ সালে তাঁকে নিযুক্ত করা হয় প্রেসিডেন্ট অফ দ্যা ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক পদে, যা তাঁকে দেশের অর্থনীতিকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সবরকম ক্ষমতা দিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট সরকারের ক্যাবিনেটে শিল্প মন্ত্রী হিসাবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এখনও কিউবার ৩ পেসোর নোটে চে-এর ছবি বিদ্যমান।

চে গ্যেভারা কিউবার সাক্ষরতা হার বৃদ্ধিতে সুবিশাল ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ইউনেসকোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৯ এর আগে অবধি কিউবাতে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৭% যা তৎকালীন ল্যাটিন আমেরিকায় চতুর্থ সর্বোচ্ছ।

এরপর চে-এর “লিটারেসি ব্রিগেড”, শিক্ষকদের নিপুন ভাবে ট্রেন করা, নতুন স্কুল কলেজ তৈরী পরের দু বছরে কিউবার শিক্ষা ব্যবস্থায় এক বিশাল ফারাক এনে দেয়। 

তথ্য বলছে ২০১০ সালে পনেরো বছরের ঊর্ধ্বে কিউবার সাক্ষরতার হার ৯৯%।

এই তথ্য থেকেই অনুধাবন করা যায় – চে ও বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর জুটি কিউবার শিক্ষা ব্যবস্থায় কতটা দূরদৃষ্টি প্রভাব এনেছিল।

কিউবায় বিপ্লব সফল হওয়ার পর চে বলিভিয়া ও কঙ্গো তেও একই ধাঁচে বিপ্লব সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। তবে তাঁর সেই ইচ্ছে আর পূরণ হয়নি। কিন্তু তাঁর এই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পর ইতিহাস তাঁকে আর কখনও অগ্রাহ্যও করতে পারেনি।

মেরিল্যান্ড ইনস্টিটিউট অফ আর্ট চের ‘গুয়েরিলেরো হিরোইকো’ ছবিকে সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৬০ সালে হাভানার লা কুবরের বিস্ফোরণের পর সেটিকে কেন্দ্র করে স্মরণসভায় তোলা হয়েছিল ছবিটি। ভিক্টরিয়া & এলবার্ট মিউজিয়ামের তথ্য অনুযায়ী এই ছবি পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বার পুনরুৎপাদন করা হয়েছে।

কিছু তথ্যই বলে দেয় জানা অজানা চে-কে কতটা মনে প্রাণে আঁকড়ে রেখেছে বিশ্বের মানুষ, তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এতদিন ধরে আকৃষ্ট করে এসেছে গোটা বিশ্বের যুব সমাজকে, করে যাবে আগামীতেও ।