The RSS ideology of “Hindu Nationalism” is based on similar lines as Mussolini’s “Italian Fascism”.

মোদী জমানাতে ঘটে চলা একাধিক কাণ্ডে এবিভিপির আক্রমণই ধরুন, কিংবা সাংবাদিক বা শিল্পীদের ওপর আক্রমণের কথাই ধরুন, প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক – বেশির ভাগ মিডিয়া হাউসই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে এইসব অশান্তির খবর “বাক্‌স্বাধীনতা বনাম জাতীয়তাবাদ” নামক একরকমের ফাঁপা সাদাকালোর বাইনারিতে রাঙিয়ে প্রচার করে এসেছে। আরএসএস সর্বদাই নিজেদের রঙীন মোড়কে প্রচার করে থাকে – হিন্দুত্ব সংগঠনগুলো সেই মোড়কটিকে খুব মূল্যবান সম্পত্তির মত ধারণ করে থাকে, কারণ তারা মনে করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে লাগাতার বিশ্বাসঘাতকতা চালিয়ে যাবার যে লজ্জাজনক ইতিহাস তাদের কাঁধে চেপে বসে আছে, সেই ইতিহাস এই জাতীয়তাবাদের রঙীন মোড়ক দিয়ে তারা খুব সহজেই ঢেকে দিতে পারবে। এই স্ব-আরোপিত মোড়কটি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নিজেদের নতুনভাবে রিপ্রেজেন্ট করার কাজে ব্যবহার করে, ভান করে যেন তারা অতি-উগ্র এক দেশপ্রেমিকের দল, দেশের স্বার্থ যাদের কাছে বাকি সমস্ত স্বার্থের উর্ধ্বে। আজকের বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন অ্যাজেণ্ডাকে তার মতাদর্শগত নির্দেশক আর এস এস এর ইতিহাস-দর্শন থেকে বুঝে নেবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মাথায় রাখা আজকের শাসকশ্রেণি তথা কর্পোরেট ক্যাপিটালের কাছে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি জনগণের বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য ও আন্দোলনকে ভেঙে দেবার অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার হিসেবেই মদত পেয়ে থাকে।

দেশ জুড়ে একটা দক্ষিণপন্থী ভাবধারার ছায়া পড়ছে, এবং অন্ধকার যত কাছে আসে, ছায়া তত দীর্ঘতর হয়। দক্ষিণপন্থার সাথে ফ্যাসিবাদের একটা ঐতিহাসিক যোগাযোগ আছে, সেসব ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়, দক্ষিণপন্থার বিশেষ আগ্রহ থাকে ইতিহাসের প্রতি, আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ইতিহাস বদলে দেবার প্রতি। তাই আসল ইতিহাসগুলো, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সঠিকভাবে জেনে রাখা জরুরি। আমাদের সামগ্রিক জ্ঞানই হয়তো একদিন রুখে দিতে পারে ফ্যাসিবাদকে। দক্ষিণপন্থার মুখেরা এখন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী, অমিত শাহ , অজয় সিং বিশট্‌। শেষের জনকে চিনতে পারলেন না তো? এটি যোগী আদিত্যনাথের আসল নাম। নব্য হিন্দুত্ববাদের নতুন পোস্টার বয়। এঁরা বিজেপি, এঁরাই আরএসএসের স্বয়ংসেবক, কিংবা অন্যান্য উগ্র হিন্দুত্ববাদী গ্রুপের ঠেকাদার – যে হিন্দুত্বের সঙ্গে আপনি আমি ছোটবেলায় কখনও পরিচিত হই নি। এঁদের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে আমরা দেখেছি, ক্লোজেট থেকে বেরিয়ে আসা হিন্দুত্ববাদীদের আসল চেহারা, মুসলিমদের ওপর অসম্ভব রাগ, ঘৃণা, মুসলিম নামধারী যে কাউকে ‘বহিরাগত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া, দলিতদের পায়ের জুতো মনে করা, তুচ্ছ কারণে তাদের মেরে ফেলা, গরুকে মা হিসেবে প্রজেক্ট করার অছিলায় মুসলিম নামধারী যে কাউকে ডেমোনাইজ করে নৃশংসসভাবে মেরে ফেলা, ধর্মের নামে ধর্ষণকে মান্যতা দেওয়া এবং দেশপ্রেমের নিত্য নতুন সংজ্ঞা বের করা। জাতীয়তাবাদকে রিডিফাইন করা।
আমরা যখন বিজেপির ব্যাকগ্রাউন্ড জানার চেষ্টা করি, আরএসএস সম্বন্ধে খোঁজখবর নিই – টুকরোটাকরা নাম চোখে পড়ে। বীর সাভারকর, গোলওয়ালকর, হেগড়েওয়ার, নাথুরাম গডসে। এঁরা আসলে কারা? কেমন ছিল সংগঠন হিসেবে আরএসএস? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কতখানি অবদান ছিল এদের? জাতীয়তাবাদ আর জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে সম্পর্কটি ভারতে অজ্ঞাত। ভারতের আমজনতা যখন ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে চলেছে, তখন এইসব স্বনিয়োজিত ন্যাশনালিস্টদের সেইসব আন্দোলনে কী ভূমিকা ছিল, তা একবার ফিরে দেখলেই বোঝা যায় এদের ন্যাশনালিজমের দম কতটা।

১৮ই মার্চ ১৯৯৯ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কে বি হেগড়েওয়ারের ছবি দেওয়া একটি ডাকটিকিটের উদ্বোধন করেন, উদ্বোধনী ভাষণে তিনি হেগড়েওয়ারকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে বর্ণনা করেন। হেগড়েওয়ার, আরএসএস গঠনের আগে ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য, এবং খিলাফত আন্দোলনে (১৯১৯-১৯২৪) যোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁর এক বছরের কারাদণ্ড হয় – সেটাই ছিল তাঁর শেষ স্বাধীনতা সম্পর্কিত কোনও আন্দোলনে যোগদান। সাভারকরের হিন্দুত্বের আদর্শে অনুপ্রাণিত হেগড়েওয়ার এর পর, মুক্তি পাবার পরেই, ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আরএসএসের প্রতিষ্ঠা করেন, এবং এই সংগঠন সেই দিন থেকে শুরু করে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষদিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকেছে, শুধু তাইই নয়, ভারতের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করেছে এবং চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার লড়াইকে ক্রমাগত বিপথগামী করবার।” ১৯৩০ সালে গান্ধীজি যখন লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করলেন, তিনি “সর্বত্র এই নির্দেশ পাঠালেন যেন সঙ্ঘের কোনও সদস্য এই সত্যাগ্রহে অংশ না নেয়। যদিও কেউ স্বেচ্ছায় অংশ নিতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হবে না। এর মানে এইই দাঁড়ায় যে সঙ্ঘের কোনও দায়িত্বশীল সদস্য সত্যাগ্রহে অংশ নেবার অধিকারী ছিল না। যদিও হেগড়েওয়ার নিজে এই আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন এবং জেলেও গেছিলেন। তবে এইবারে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে নয়, আরএসএস থেকে প্রকাশিত তাঁর জীবনী থেকে জানা যায়, তাঁর জেলে ঢোকার মূল উদ্দেশ্য ছিল “সেখানকার স্বাধীনতাপ্রেমী, আত্মদানকারী কয়েদিদের দলের সাথে মিশে তাদের সঙ্গে সঙ্ঘের উদ্দেশ্য আর কার্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা এবং সঙ্ঘের কাজের জন্য তাদের ভবিষ্যতের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা”।

স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ফলে হিন্দু এবং মুসলমান, দুই তরফেরই নিজেদের নিজেদের বিভেদমূলক কার্যকলাপ মাথাচাড়া দিচ্ছিল। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে, যখন গান্ধী ভারত ছাড় আন্দোলনের উদ্দেশ্যে সত্যাগ্রহ শুরু করেছেন, সেই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের গৃহমন্ত্রালয়ের লেখা একটি নোট থেকে জানা যায় যে আরএসএসের নেতারা গৃহমন্ত্রকের সচিবের সাথে দেখা করেন এবং “সঙ্ঘের সদস্যরা আরও বেশিমাত্রায় সিভিক গার্ড হিসেবে যোগদান করবে – এই মর্মে সচিবকে আশ্বস্ত করেন”। এই সিভিক গার্ড নামক পদটি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের “আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা”র প্রয়োজন মেটাতে।

ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হওযার দেড় বছর পর, ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ বম্বে সরকার প্রভূত সন্তুষ্টির সাথে একটি মেমোতে লেখেন, যে “সঙ্ঘ যথাযথভাবে নিজেদের আইনের সীমানায় সংযত রেখেছে, এবং ১৯৪২ সাল থেকে শুরু হওয়া দেশজোড়া আন্দোলনের সাথে কোনওভাবেই নিজেদের জড়ায় নি।”

ডান্ডি মার্চের সময়ের মতই, আরএসএসের স্বয়ংসেবকেরা এবারেও ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদান করতে দেন নি। সঙ্ঘ কেবল অকর্মণ্য লোকেদের আখড়া, অর্থহীন বাগাড়ম্বর করে কেবল; শুধু বাইরের লোক নয়, সঙ্ঘের স্বেচ্ছাসেবকেরাও এইভাবে সঙ্ঘের সমালোচনা করত। তারা প্রচণ্ডভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল।”

কিন্তু আরএসএসের নেতৃত্বের কাছে এই আন্দোলনে যোগদান না করার সপক্ষে এক অদ্ভূত যুক্তি ছিল। ১৯৪২ এর জুন মাসে দেওয়া এক বক্তৃতায়, যার কয়েক মাস পরেই ব্রিটিশদের তৈরি করা এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রায় তিরিশ লক্ষ বাঙালি মারা যায়, গোলওয়ালকর বলেন যে “সঙ্ঘ আজকের সমাজের এই অবক্ষয়ের জন্য অন্য কাউকে দোষ দিতে চায় না। মানুষ যখন অন্যকে দোষ দিতে শুরু করে, তখন বোঝা যায় দুর্বলতা তার নিজের মধ্যেই আছে। দুর্বলের ওপর হওয়া অত্যাচার অনাচারের জন্য সবলকে দোষ দেওয়া বৃথা … সঙ্ঘ তার মূল্যবান সময় অন্যকে দোষারোপ করে বা সমালোচনা করে নষ্ট করতে ইচ্ছুক নয়। আমরা যখন জানিই যে প্রকৃতির নিয়মেই বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে, তখন তার জন্য বড় মাছকে দোষ দেওয়া বৃথা। প্রকৃতির বেঁধে দেওয়া নিয়ম, ভালো হোক বা খারাপ, তাইই পরম সত্য। তাকে “অন্যায়” বললেই সেই নিয়ম বদলে যায় না।” এমনকি, ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসেও, যখন এক বছর আগের নৌবিদ্রোহের জের হিসেবে ব্রিটিশ পাকাপাকিভাবে ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, গোলওয়ালকর তখনও সেইসব সঙ্ঘের সদস্যদের তীব্র সমালোচনায় ব্যস্ত ছিলেন যারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে চেয়েছিল।

১৯৪৭ সালের পনেরোই আগস্ট, আরএসএসের মুখপত্র দ্য অর্গানাইজারে প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে সঙ্ঘ সরাসরি ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার বিরোধিতা করে, এবং লেখে যে “এটা কোনওদিন হিন্দুদের নিজেদের পতাকা হবে না, হিন্দুরা একে সম্মানও করবে না”।

স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাস পরে, হিন্দু মহাসভা আর আরএসএসের সদস্য নাথুরাম গডসে, ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি, গান্ধীজিকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনটে গুলি করে হত্যা করে। সেই সময়ে গান্ধীজির ব্যক্তিগত সচিব পেয়ারেলাল নায়ারের সংরক্ষিত লেখাপত্র উদ্ধৃত করে ইতিহাসবিদ এ জি নুরানি লিখেছেনঃ “সেই দিন আরএসএসের সদস্যদের কিছু কিছু এলাকায় নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল রেডিও সেট চালু করে ‘গুড নিউজ’এর জন্য অপেক্ষা করতে।

“খবরটা ছড়িয়ে পড়ার পরে, আরএসএসের বিভিন্ন শাখায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়”,।

এর কয়েকদিন পরেই আরএসএসের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়, এবং দেশজুড়ে এই সংস্থাটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। 4 th ফেব্রুয়ারি সরকারের প্রকাশিত এক ঘোষণাপত্রে জানানো হয়ঃ “যে ঘৃণা আর হিংসার বাতাবরণ এ দেশে তৈরি করা হচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতাকে অঙ্কুরে নষ্ট করবার জন্য, তাকে সমূলে উপড়ে ফেলার লক্ষ্যে … ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে বেআইনী ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্যরা বেআইনী অস্ত্রশস্ত্রের মদতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুঠপাট, ডাকাতি এবং খুনের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এমনকি তারা প্রচারপত্র বিলি করে করে লোকজনকে আগ্নেয়াস্ত্র জোগাড় করে হিংসার পথ বেছে নিতে প্ররোচিতও করছে বলে জানা গেছে … সঙ্ঘের এই সব হিংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে অনেকের প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে। সবচেয়ে দামী যে প্রাণটিকে আমরা হারিয়েছি সব শেষে, তিনি হলেন স্বয়ং গান্ধীজি। এই পরিস্থিতিতে এই হিংসার পুনরাবৃত্তি যে কোনও মূল্যে প্রথম সুযোগেই আটকে দেওয়া এই সরকারের জাতীয় কর্তব্য, যে কর্তব্যের বশে চালিত হয়ে সরকার সঙ্ঘকে বেআইনী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করল।”

১৯৪৮ সালের সাতাশে মে তারিখে, এক বিশেষ আদালত বা স্পেশাল কোর্ট বসিয়ে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার সাথে সরাসরি এবং অন্যভাবে জড়িত থাকা অভিযুক্তদের নিয়ে মামলার শুনানি শুরু হয় লালকেল্লায়। অভিযুক্তরা হল নাথুরাম বিনায়ক গডসে, নারায়ণ দত্তাত্রেয় আপটে এবং বিষ্ণু রামকৃষ্ণ কারকর; দিগম্বর রাম চন্দ্র বাডগে, শঙ্কর (কিস্তায়ার ছেলে), বিনায়ক দামোদর সাভারকর, গোপাল বিনায়ক গডসে এবং দত্তাত্রেয় সদাশিব পারচুড়ে।

নাথুরাম গডসে অবশ্য আদালতে দাবি করেন যে তিনি গান্ধীকে খুন করার আগেই আরএসএসের সংস্রব ত্যাগ করেন, আরএসএসও সেই দাবি করে। যদিও এই দাবির সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব হয় নি, কারণ আরএসএসে “কোনও ঘটনার রেকর্ড, কোনও সদস্যদের রেজিস্টার কখনও রাখা হত না”,। অবশ্য নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে, একই মামলায় সহ-ষড়যন্ত্রী হিসেবে তিরিশ বছর জেল খাটার পরে বাইরে বেরিয়ে ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান যে নাথুরাম আদপেই কোনদিনও আরএসএস ছাড়েন নি, তিনি কোর্টে মিথ্যে কথা বলেছিলেন। “সমস্ত ভাইয়েরাই,” গোপালের বক্তব্য অনুযায়ী, “আরএসএসের সদস্য ছিল। বলতে পারেন, যতটা না আমরা বাড়ির আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলাম, তার থেকে বেশি বেড়ে উঠেছিলাম আরএসএসের মধ্যেই। আরএসএস ছিল আমাদের কাছে নিজের পরিবারের মত। নাথুরাম দিয়ে এটা বলানো হয়েছিল যে ও আরএসএস ছেড়ে দিয়েছে, কারণ গোলওয়ালকর এবং আরএসএস গান্ধীহত্যার পরে যথেষ্ট প্রতিকূলতার মুখে পড়েছিল। কিন্তু সত্যিটা হল, ও কোনওদিনও আরএসএসের সংস্রব ছাড়ে নি।” একই দাবি ইকোনমিক টাইমসে দেওয়া গডসে পরিবারের আরও এক সদস্যের সাক্ষাৎকারে জানা গেছে। ফ্রন্টলাইনের ওই একই সাক্ষাৎকারে গোপাল গডসে এমনকি লালকৃষ্ণ আদবানিকেও দোষারোপ করেন “ভিতুর ডিম” বলে – কারণ তিনি নাথুরামের পক্ষ নিতে অস্বীকার করেছিলেন।

১৯৪৯ সালের ৩০শে নভেম্বর, সঙ্ঘের বানানো একটি কমিটি যখন এই সঙ্ঘের সংবিধান লেখা শেষ করে, তখন আরএসএস দ্য অর্গানাইজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে তাদের আপত্তি ব্যক্ত করেঃ

“… কিন্তু আমাদের সংবিধানে প্রাচীন ভারতে প্রণয়ন হওয়া সংবিধানের কোনও উল্লেখই করা নেই … আজ পর্যন্ত তাঁর প্রণীত সেইসব আইনাবলী “মনুস্মৃতি” নামে পরিচিত । সম্ভবত এই একটা জায়গায় আরএসএস, সংগঠনের, বা সংগঠনের নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার ব্যাপারে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, যে তাঁরা হয় তো নিজেদের প্রাচীন সংবিধান মনুস্মৃতির থেকেও নিজেদের মহান বলে মনে করতেন – যে সংবিধানে লেখা আছে, শুধুমাত্র ব্রাহ্মণের সেবা করা শূদ্রদের কাছে মহত্তম কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত; এর বাইরে যে কাজই সে করুক না কেন, তাতে তার কোনও ফললাভ হয় না।” একটি প্রাচীনপন্থী দমনমূলক সময়ের প্রতিচ্ছবি – যে সময়ে “সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শূদ্রের ধন উপার্জন করা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হত, কারণ শূদ্র ধন উপার্জন করলে তা ব্রাহ্মণের পীড়ার কারণ হয়”।

আরএসএস এই সময় থেকে পরবর্তী কয়েক বছর ধরে ভারতের সংবিধানের বদলে মনুস্মৃতিকে সংবিধানের মান্যতা দেবার পক্ষে জোরদার সওয়াল চালিয়ে গেছিল, এমনকি ১৯৫০ সালে যখন সংবিধান সরকারিভাবে দেশে লাগু হয়, তখনও পর্যন্ত।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, যখন রাজনৈতিক চাপানউতোরের মাঝে আর এস এসের উত্তরসূরীরা ইতিহাসকে প্রায়শই ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় প্রবলশক্তি প্রয়োগে ব্যস্ত ঠিক তখনই জানতে ইচ্ছে করে , এই যে সম্প্রদায়টি, যারা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বশ্যতা স্বীকার করেছিলো, ভারতের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করেছে এবং চেষ্টা করেছে স্বাধীনতার লড়াইকে ক্রমাগত বিপথগামী করতে; এই সম্প্রদায় যারা জাতীয় পতাকার এবং দেশের সংবিধানের যথাযথ সম্মান দেয় না, যারা জাতির জনক হিসেবে সম্মানিত একজন মহান নায়কের হত্যার পরে আনন্দের সঙ্গে মিষ্টি বিলিয়ে ছিল এদেরকে আমাদের “জাতীয়তাবাদী” হিসেবে চিনতে হবে! বাকি সবাই “অ্যান্টি-ন্যাশনাল”! আরএসএসের ইতিহাস মূলত ব্রিটিশের পা চাটার ইতিহাস।

আজকের বিজেপি নিঃসন্দেহে তার পূর্বসরী জনসঙ্ঘের অবিকল অনুকৃতি নয়, এমনকী ৯০ এর দশকের শুরুতে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান শক্তি হয়ে ওঠার পর্বে তার যে চরিত্র ছিল তার থেকেও খানিকটা আলাদা। কংগ্রেসকে পেছনের আসনে ঠেলে দিয়ে সেই এখন কর্পোরেট পুঁজির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং দেশি বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থে সবচেয়ে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। মিডিয়ার একাংশ বিজেপি ও মোদির কেবল ‘উন্নয়ন সর্বস্ব মুখ’কেই আমাদের সামনে তুলে ধরতে চাইলেও ঘটনাধারা দেখিয়ে দিয়েছে বিজেপি বা তার সামনের সারির নেতারা তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতিকে কখোনোই পেছনের সারিতে ঠেলে দেয় নি, বরং সর্বদাই তাকে অবলম্বন করে এগোতে চেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়েও লোকসভা নির্বাচনের আগে পরে ধর্মীয় মেরুকরণ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো বিভিন্ন মন্তব্য ও কার্যকলাপ, পরিকল্পিত দাঙ্গা ও সংখ্যাগুরুর মৌলবাদকে চাপিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ংকর সমস্ত ঘটনা বারেবারেই সামনে এসেছে।
‘কর্পোরেট কমিউনাল’ শক্তি বিজেপির পুঁজির পক্ষে দাঁড়িয়ে চালানো আগ্রাসন আর তার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মধ্যকার পরস্পর সম্পর্ককে বুঝে নেওয়া কঠিন কিছু নয়। মেহনতি মানুষের ঐক্যকে বিভক্ত করার এবং তাদের লড়াই আন্দোলন দাবি দাওয়ার বিষয়গুলিকে উত্তেজনার ইন্ধন সমৃদ্ধ বিভিন্ন ইস্যু দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার সবচেয়ে সহায়ক কৌশল হিসেবেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ব্যবহার করে থাকে। সাম্প্রতিক বিজেপি সরকারের কার্যকলাপের তত্ত্বায়নের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ব-ভারতীয়ত্বের সমীকরণ কষা হয়, তবে অপর দিকটি অবশ্যই আদানি আম্বানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা, মেক ইন ইন্ডিয়ার নামে এফ ডি আইকে সাড়ম্বর আহ্বান আর শ্রম আইন, জমি অধিগ্রহণ নীতি, বিলগ্নীকরণ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তড়িৎ গতির সমস্ত সংস্কারের পরস্পর সংযুক্ত এক বহুবর্ণ ছবির কোলাজ। নয়া উদারনৈতিক রাজনীতি অর্থনীতির বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আর উগ্র হিন্দুত্বের আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বহুস্বর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষার গণতান্ত্রিক লড়াই এখন একসঙ্গে মিলেছে।

তথ্য বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহীত