আবদুল আজিজ তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ডে পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ সার্বিক অর্থে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন ।পবিত্র ইসলাম যে তার ধর্মীয় বিধান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা এই দুটি ভিক্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, সে সম্পর্কে শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে রাজনৈতিক তত্ত্বকে উপস্থাপিত করেছিলেন সেই তত্ত্বের প্রধান ভিত্তি ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা।


পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহর এই তত্ত্বকে আশ্রয় করে কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী ধর্মগুরু আবদুল আজিজ নিজের কার্যক্রম কে প্রসারিত করে, পিতার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথমেই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন; ভারতের মুসলমানেরা কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারেনা ব্রিটিশের এই দখলদারির মানসিকতা ।
আবদুল আজিজ যেভাবে কার্যভার গ্রহণের সাথে সাথেই দেশের পরাধীনতা সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় নিজের অভিমত প্রকাশ করেছিলেন তা ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করবার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। আবদুল আজিজ অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন এই প্রতিকূল পরিবেশের ভেতরে প্রকৃত মুসলমান কোনো অবস্থাতেই যথার্থভাবে ধর্মচারণ করতে পারে না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার নিয়ন্ত্রণাধীন ভারত কে তিনি অভিহিত করেছিলেন’ দারউল হরব’ হিসাবে অর্থাৎ; যুদ্ধরত একটি দেশ হিসেবে। ব্রিটিশের আগ্রাসী মানসিকতা, বিশেষ করে দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতি ব্রিটিশের যে ভয়ংকর বৈরী মানসিকতা, সেই রাজ্যগুলিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য ব্রিটিশের যে অভিস্পা , সেই জায়গা থেকেই ব্রিটিশকে তিনি যুদ্ধরত জাতি আর ব্রিটিশ আমাদের ভারতকেও যুদ্ধরত একটি দেশে পরিণত করছে –এ কথা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন।


ব্রিটিশের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেছিলেন আবদুল আজিজ। সেই ফতোয়ায় তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছিলেন; ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের শরিক হওয়া প্রত্যেকটি মুসলমানের একটি পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য ।ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন; ভারতের মুসলমানেরা যদি মনে করে ব্রিটিশ তাদের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ভারতীয় মুসলমানরা জয়লাভ করবে না ,এটাই যদি ভারতীয় মুসলমানদের মনোভাব হয়, তাহলে তাঁরা যেন অন্যান্য স্বাধীন মুসলমান দেশে গেয়া আশ্রয় নেয় ।অর্থাৎ ; ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণাধীন ভারত যে কোনো অবস্থাতেই একজন স্বাধীন মানুষের আর্থ-সামাজিক- ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের পক্ষে অনুকূল নয়, উপযুক্ত নয় ,ভারতীয় মুসলমানদের উদ্দেশ্যে সেই ফতোয়ায় তিনি বলেছিলেন। ব্রিটিশের সঙ্গে যদি এঁটে উঠতে না পেরে ভারতীয় মুসলমানেরা ভারতের বাইরে স্বাধীন মুসলমান দেশে এগিয়ে আশ্রয় নেয়, সেখানেও তাঁদের চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়ানোর জন্য সব রকম ভাবে সচেষ্ট হতে হবে তাদের স্বাধীন মুসলমান দেশে অবস্থান করে ।
ওই ফতোয়ায় আবদুল আজিজ অত্যন্ত জোড়ের সঙ্গে বলেছিলেন; বাইরের সমস্ত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন শক্তি সাহায্য নিয়ে, নতুনভাবে শক্তি সঞ্চয় করে, ভারত থেকে ইংরেজদের শেষ পর্যন্ত বিতাড়িত করতেই হবে। আব্দুল আজিজ আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, ভারতের বাইরে স্বাধীন মুসলমান দেশগুলি ভারত থেকে ইংরেজকে বিতরিত করবার এই প্রক্রিয়ায় অকুন্ঠ সহযোগিতা করবে এটা তাঁর গভীর বিশ্বাস।


ব্রিটি ঔপনিবেশিকতা বিরোধী সলতে পাকানোর ক্ষেত্রে শাহ আবদুল আজিজের এই ফতোয়া এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। কেবলমাত্র ভারতীয় মুসলমানদের ভেতরেই নয় ,হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যে অংশের মানুষদের ভেতর ধীরে ধীরে ব্রিটিশ শাসনের অপকৌশল সম্বন্ধে একটা সচেতনতা তৈরি হতে শুরু করেছিল, তাঁদের কাছেই শাহ আবদুল আজিজের এই ফতোয়া গভীর রেখা পাত করেছিল।
ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নেতৃত্ব দানকারী আমজনতার ভেতর শাহ আবদুল আজিজের এই ফতোয়া যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল তাকে কেবলমাত্র মুসলমান সমাজের মানুষদের উদ্বেলিত হওয়ার ঘটনা হিসেবে দেখাটা বোধহয় ঠিক নয়। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার উন্মেষে এই ফতোয়া যে ভূমিকা পালন করেছিল, পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে গুলিকে ত্বরান্বিত করবার ক্ষেত্রে সেই ভূমিকা বিশেষভাবে ফলপ্রসূচি হয়েছিল।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উষা লাগ্নে ভারতীয় মুসলমানেরা শাহ আবদুল আজিজের এই ফতোয়া কে অবলম্বন করে যেভাবে জান কবুল লড়াই শুরু করেছিলেন , তা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। শাহ আবদুল আজিজ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ভয়াবহকতা সম্বন্ধে ভারতীয় প্রেক্ষিতে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল হলেও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ কিভাবে নিজের প্রভাব বিস্তার করছে, নিজের অপকর্মকে ঢেকে রাখছে নানা ধরনের আবরণের ভেতর দিয়ে, বিশেষ করে ভারতবর্ষ থেকে অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ব্রিটেনে যে নবজাগরণ ঘটছে, শিল্প বিপ্লব ঘটছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটছে– সেই সমস্ত বিষয়গুলিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ভেতর দিয়ে ,ভারতে কিভাবে তারা অর্থনৈতিক শাসন চালাচ্ছে ভারতীয় জনগণের সমস্ত ধরনের অধিকার কে তারা হরণ করছে, সেই জিনিসগুলিকে খুব সফল ভাবে চেপে যেতে সক্ষম হয়েছিল ।


শাহ আবদুল আজিজ ব্রিটিশের এই অপকৌশল সম্পর্কে সেভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন না ।ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্রিটিশের সঙ্গে পেরে ওঠার ক্ষেত্রটি তিনি প্রথম অবস্থায় খুব সফলভাবে এঁটে উঠতে পারছিলেন একথা বলতে পারা যায় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে শাহ আবদুল আজিজের পরিপূর্ণ ধারণার অভাব ছিল।বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্র গুলির বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ও তাঁর সম্যক ধারণার অভাব, অভিজ্ঞতার অভাব- ভারতের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা পর্ব কে খানিকটা সমস্যাসংকুল করেছিল। তবু তার মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় শাহ আবদুল আজিজের এই ফতোয়া কে আশ্রয় করে, তাকে মান্যতা দিয়ে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ভারতের মুসলমান সমাজ যেভাবে জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং একটি স্থায়ী গণ আন্দোলন ভারতের বুকে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন, যার প্রভাব ভারতের ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে, অন্যান্য রাষ্ট্রগুলিতেও পড়েছিল ।সেই আন্দোলনকারীদের সাহস ,সাংগঠনিক শক্তি, তিতিক্ষা ,ত্যাগ– যা পরবর্তীকালে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী গণ আন্দোলনের উত্তরাধিকার হিসেবে বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়েছিল ।
আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে ,ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনের এই সূচনা পর্বের কালক্রম ঘিরে ঐতিহাসিকেরা কার্যত নীরবই থেকেছেন। শাহ আবদুল আজিজের ফতোয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিতকে টলিয়ে দেওয়ার যে সংকল্প রচিত হয়েছিল, সেই ঘটনাক্রম যদি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সঠিকভাবে আলোচিত হত, তার মূল্যায়ন যদি সঠিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাসের ছাত্র -শিক্ষক থেকে শুরু করে গোটা দেশের নাগরিক সমাজ পেতেন, তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের বিভাজনের রাজনীতি কেন্দ্রিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই অনেকখানি বাধা প্রাপ্ত হত। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বাধীন ভারতেও স্বাধীনতা আন্দোলনের যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, সেই পর্বে এই সমস্ত ঘটনাক্রমগুলি যথাচিত গুরুত্ব সহকারে কখনোই আলোচিত হয়নি।


শাহ আবদুল আজিজের যে জেহাদী ফতোয়া, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে, ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতার উন্মেষের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল, তার উত্তরাধিকার বহনের ক্ষেত্রে সৈয়দ আহমেদের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।শাহ আবদুল আজিজ যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে উত্তর ভারত, উত্তর- পশ্চিম ভারতে(ভৌগলিক ভাবে আজকের পাকিস্থানে) ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতাকে যে পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ,তাকে সৈয়দ আহমেদ এক শীর্ষবিন্দুতে উপস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে মুসলমান সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রেক্ষিতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, শাহ আবদুল আজিজের মতই সৈয়দ আহমেদের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা, তারও যথাযথ কোনো মূল্যায়ন হয়নি সৈয়দ আহমেদের আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বলে অভিহিত করে সমাজের একটা অংশের মধ্যে এই আন্দোলনের ব্যপ্তিকে সীমাবদ্ধ রূপে দেখানোর প্রবণতা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদের তাদের শ্রেণীস্বার্থের তাগিদে করেছিলেন।
পরবর্তীকালে ভারতীয় ইতিহাসিকদের একটা বড় অংশ ব্রিটিশের সেই স্বার্থকেই স্থায়ী করবার চেষ্টা করেছেন সৈয়দ আহমেদের সহ পরবর্তী নেতৃত্ব আবদুল আজিজের ফতোয়ার উত্তরাধিকার বহন করবার যে ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম, তাকে কেবলমাত্র ওয়াহাবী আন্দোলন বলে উল্লেখ করে। সেই আন্দোলন ঘিরে আলাপ-আলোচনা কেবলমাত্র দেশের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষদের মধ্যে আবদ্ধ রাখার যে মানসিকতা ব্রিটিশ ভারতের ঐতিহাসিকেরা দেখিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বহু মানুষ ছিলেন ।ঠিক একই প্রবণতা ব্রিটিশ এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরেও জাতীয়তাবাদের নাম করে হিন্দু সম্প্রদায়িক চিন্তাপ্রসূত ইতিহাস রচনার পর্যায়ক্রম যারা ভারতের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ,সেই রমেশ চন্দ্র মজুমদার প্রমুখেরা করেছেন। এইসব পর্যায়ক্রম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক তুচ্ছ গটনা হিসেবেই শাহ আবদুল আজিজ বা তাঁর উত্তরসূরিদের কাজকি দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ,আম জনতার মধ্যে ,এইসব আন্দোলনগুলির প্রভাব সম্পর্কে সম্যক ধারণা গড়েই ওঠেনি।


বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ইতিহাসবিদেরা ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালিউল্লাহ সহ শাহ আবদুল আজিজ ,সৈয়দ আহমেদ প্রমূখ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ভারতের জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষিতে অনবদ্য ভূমিকার কথা যথাচিত মর্যাদার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারতের ইতিহাসের এই বস্তুবাদী ধারার সম্মুখ আলোচনা আমজনতার কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক এবং প্রচার মাধ্যম যথোচিত ভূমিকা পালন না করায় ,ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান সমাজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক ইতিহাসবোধ সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা অন্তরায় থেকে গেছে।
শাহ আবদুল আজিজের ফতোওয়াকে অবলম্বন করে যে ব্রিটিশ বিরোধী গণ সংগ্রাম ধীরে ধীরে গোটা উত্তর ভারতকে ছেয়ে ফেলেছিল ,সেই আন্দোলনের রাশ সৈয়দ আহমেদের হাতে অর্পিত হওয়ার পর পর্যায়ক্রম যেদিকে যেতে শুরু করে করে, তা ব্রিটিশের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরো শক্ত ভাবে ফেলেছিল ।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের মাধ্যমে কেবলমাত্র ওয়াহাবি আন্দোলন হিসেবেই সৈয়দ আহমেদ কে শাহ আবদুল আজিজের ফতোয়ার উত্তরসূরী হিসেবে দেখানো হয়।
সৈয়দ আহমদ যেভাবে ব্রিটিশ বিরোধী গণ সংগ্রামকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন , উত্তর ভারতের পর্যায়ক্রমকে অতিক্রম করে ভৌগোলিকভাবে সেই আন্দোলনকে হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলেও তিনি প্রসারিত করবার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, এই গোটা আন্দোলনের পর্যায়ক্রমকেই ব্রিটিশ একটি ক্ষুদ্র ,সংকীর্ণ পর্যায়ের আবরণ দিয়ে আবৃত করে রাখার পক্ষপাতি ছিল।ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে ভারতীয় মুসলমানদের কার্যত অভ্যুত্থানের একটা পর্যায়ক্রম হিশেবে যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, সেই পর্যায় কে চেপে রেখে, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানের অংশগ্রহণকে প্রথম থেকেই একটা নগন্য পর্যায়ে নামিয়ে আনাই ছিল ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ।সেই উদ্দেশ্যেই কিন্তু ব্রিটিশ প্রথম থেকে সৈয়দ আহমেদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে নিছক’ ওয়াহাবি আন্দোলন’ , একটি ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন- এমন বিশেষণে বিশেষিত করতেই সবথেকে বেশি তৎপর ছিল।


এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মুসলমানদের এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টাকে মুক্ত মনে গ্রহণ করতে পারেনি একটা বড় অংশের ভারতীয় ঐতিহাসিকেরাও। ব্রিটিশের তৈরি করা ফাঁদেই তাঁরা পা দিয়েছেন। তাই এই আন্দোলনকে ব্রিটিশ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সূচনা পর্ব হিসেবে না দেখে, তাকে নিছক একটি ধর্মীয়- সংস্কারবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখতেই ভারতীয় ঐতিহাসিকদের একটা বড় অংশ সবসময় তৎপর থেকেছেন।
শাহ আবদুল ওয়াইদ প্রচারিত যে ধর্মমত, সেই ধর্মমতের সঙ্গে সৈয়দ আহমেদ ভারতের বুকে ব্রিটিশ বিরোধী যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার সংযোগ কোথায়? সে সম্পর্কে কিন্তু ব্রিটিশের ধামাধরা ঐতিহাসিকেরা একটিও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেন নি। এক ই কথা প্রযোজ্য পরবর্তীকালে উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী আরএসএসের ঘরের লোক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মত ইতিহাসবিদ সম্পর্কেও ।শাহ আবদুল ওয়াহিদ যে ধর্মমতের উপর ভিত্তি করে সংস্কারবাদী আন্দোলন শুরু করেছিলেন , তার সঙ্গে ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক দিকের সংযোগটাই ছিল বেশি। ধর্মের ব্যবধান কে অতিক্রম করে, বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে সমস্ত ধরনের মানুষকে একত্রিত করার নেতৃত্ব মুসলমান সমাজকে দিতে হবে– সেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন সৈয়দ আহমদ।এই আন্দোলনের সম্যক দিক সম্পর্কে আমাদের ইতিহাসে সঠিক মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে ,আজও আমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একদম সূচনাপর্বে মুসলমান সমাজের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক আন্দোলন কে নিছক একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন ,’ওয়াহাবি আন্দোলন ‘ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করে চলেছি। এই প্রবণতা থেকে উত্তরণের চেষ্টাও তেমন দেখতে পাওয়া যায় না।
অবিভক্ত যুক্তপ্রদেশ, আজকের উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৈয়দ আহমেদ। কৈশোর কাল থেকেই তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং তাঁর অনুসরণকারী পবিত্র ইসলামের চিন্তা চেতনায় উজ্জীবিত ব্রিটিশ বিরোধী জনচেতনার ধারক-বাহকদের দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন ।ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার বিকাশে সৈয়দ আহমেদের সমাজ চেতনার বিকাশে শাহ ওয়ালীউল্লা সহ শাহ আবদুল আজিজ প্রমূখ চিন্তাবিদ, যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভারতের মানুষদের উপর কি ধরনের পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে ,সে সম্পর্কে ভারতের জনগণকে ওয়াকিবহাল করে, ব্রিটিশের অত্যাচারের হাত থেকে ভারতকে বাঁচানোর জন্য আন্দোলন সংগঠিত করেছিলে,ন সেই সব আন্দোলনগুলির ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়েই নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।


সৈয়দ আহমেদের প্রথাগত শিক্ষা শেষ হয় ১৮৩৮ সালে। প্রথাগত শিক্ষার শেষের পর তিনি নিজের জন্মস্থানে ফিরে এসে উপলব্ধি করেন, ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা কিভাবে ভারতের মানুষদের মানসিক শক্তি, মননশীলতাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সেই উপলব্ধি তাঁকে ব্রিটিশ শাসন মুক্ত ভারত প্রতিষ্ঠার সংকল্পে দৃঢ় করে। ব্যক্তি জীবনে ১৮৩৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন সৈয়দ আহমেদ ।কিন্তু সংসারের ঘেরাটোপে নিজের জীবনকে আবদ্ধ রাখতে তিনি কখনোই রাজি ছিলেন না ।তাই নিজের আদর্শকে বাস্তবায়িত করবার লক্ষ্যে সেই সময় থেকেই তিনি দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি দেশীয় রাজ্য ‘টংকে’ র আমিরের কাছে এসে উপস্থিত হন ।তাঁর সৈন্য বিভাগে যোগদান করেন।
যুক্ত প্রদেশের স্বাধীন রাজ্য ‘টংক ‘ তখন তাঁদের সীমিত ক্ষমতার ভেতরেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশের মানুষদের সঙ্গবদ্ধ করবার কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছিল। এই দেশীয় রাজ্যটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায় ভুক্ত ।তাঁরা একযোগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা কিভাবে ভারতের কৃষ্টি কে কলুষিত করছে, ভারতের পরমত সহিষ্ণুতার আদর্শকে দূষিত করছে ,সহিষ্ণুতার পরিবেশকে বিঘ্ন ঘটিয়ে এক অসহিষ্ণু ভারতের জন্ম দিতে চাইছে, পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে ইংরেজের শাসনের নামে শোষণকে শক্তিশালী করতে চাইছে –সেইসব সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করবার কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছিল।
এই রকম একটা সময়ে ,এই দেশীয় রাজ্য ট্যাংকের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সৈয়দ আহমেদ নিজের ভবিষ্যতের সংগ্রামী জীবনের একটা ভিত্তি গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। হাতে কলমে যুদ্ধবিদ্যার শিক্ষা সৈয়দ আহমেদের এই টংক নামক দেশীয় রাজ্যের সেনাবাহিনীতে অবস্থানকালেই হয়েছিল। টঙ্ক রাজ্যের সেনাবাহিনীতে থাকাকালীনই সৈয়দ আহমেদ রণনীতি এবং রণকৌশল সম্বন্ধে নিজেকে বিশেষভাবে উপযোগী করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।


দুর্ভাগ্যের বিষয় এই টংক রাজ্যটির উপর যেভাবে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ নিজের আধিপত্য বিস্তারে পরান্মুখ ছিল, তাতে সেখানকার আমিরের পক্ষে দীর্ঘদিন ব্রিটিশের অধীনতার বাইরে থাকার কাজটি সম্ভবপর হয়নি। অন্যান্য অনেক দেশীয় রাজ্যের মতই টঙ্ক রাজ্য টিও কার্যত বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশের অধীনতা কে স্বীকার করতে টঙ্করাজ্যের আমির যখন ব্রিটিশের অধীনতা স্বীকার করে, তারপর এক মুহূর্ত আর সেই রাজ্যে সেনাবাহিনীতে থাকতে রাজি ছিলেন না সৈয়দ আহমেদ।
টঙ্কের আমীর ব্রিটেশ রাজের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে নিজের সেনাবাহিনীকে ব্রিটিশের অন্তর্গত করার সংকল্প নিলে থেকে পত্রপাট টঙ্কের সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন সৈয়দ আহমেদ। সেখান থেকে চলে এসে তিনি গোটা যুক্ত প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করতে শুরু করেন ।সেই সমস্ত অঞ্চল গুলির সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা, ব্রিটিশ কিভাবে ভারতের মানুষদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে, অর্থনৈতিক শোষণকে দিনের পর দিন জোরদার করছে, সে সম্পর্কে সৈয়দ আহমেদ হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করতে শুরু করেন।


ব্রিটিশের বিভাজনের রাজনীতি সম্পর্কেও এই সময়কালে বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যে যাতায়াতের ভেতর দিয়ে একটা বাস্তব ধারণা সৈয়দ আহমেদ তৈরি করতে পেরেছিলেন। এই সময় তিনি মিরাট ,মুজাফফরনগর সাহারানপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলি, শহর গুলি ঘুরে ঘুরে সেখানকার মানুষের দুঃখ দুর্দশা উপলব্ধি করেছিলেন। সেখানকার মুসলমান সমাজ ,যাঁরা সেই অঞ্চলে সবথেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগানোর কাজটিও অত্যন্ত কৌশলে ,সুচারুভাবে সৈয়দ আহমেদ শুরু করে দিয়েছিলেন ।
প্রথম পর্যায়ের ভ্রমণ কাজ শেষ করবার পর তিনি গোটা এলাহাবাদ, বারানসি ,কানপুর , লক্ষ্মৌ এর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলি ঘোরেন ।সেখানকার মানুষদের দুঃখ দুর্দশা উপলব্ধি করেন। সেখানকার মানুষদের ব্রিটিশের শাসনের নামে শোষণ সম্পর্কে ঐক্যবদ্ধ করে তুলে ব্রিটিশ বিরোধী মানসিকতাকে একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর উপর উপস্থাপিত করেন ।তৃতীয় পর্যায়ে তিনি রোহিলখন্ড ভ্রমণ করেছিলেন ।সেখানে তিনি একইভাবে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কাছে