সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলিতেছে। বাড়ির আলমারি, জামার বুক পকেট, অথবা তাকে রাখা ছোট্টো পুঁটুলির শেষ সম্বলটুকু। কাচিয়ে নিয়ে চললেন বাজারে। ফিরলেন যখন, আধা ব্যাগ বাজার টেনেটুনে ভর্তি হয়েছে। বা এরকমটাও ধরা যায়, মাসের শেষের দিকে অ্যাপ খুলে খাবার অর্ডার দিতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। কয়েক সপ্তাহ আগে অর্ডার করা খাবার ডিসকাউন্ট কুপন দিয়েও এই সপ্তাহে এসে দাম দেখাচ্ছে প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় এর সংজ্ঞা মূল্যবৃদ্ধি।সাম্প্রতিক সময়কার তথ্য কি বলছে দেখা যাক। মিনিস্ট্রি অফ স্ট্যাটিস্টিক্স অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইম্পলিমেন্টেশনের তথ্য বলছে ২০২২ সালের এপ্রিলে এসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৭৯ শতাংশ, যা কিনা ২০১৪ সালের পরে সর্বাধিক। খাদ্যদ্রব্যে টানা সাত মাস মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৩৮ শতাংশ। এই হার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের টলারেন্স লিমিটের ২ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশের উপরে। সহজ ভাষাতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মুদ্রাস্ফীতি সহ্য করার যা ক্ষমতা, তার থেকে অনেকটাই উপরে রয়েছে এই হার।২০১৪ পরবর্তী সময় এই মুদ্রাস্ফীতির হার, অন্তত ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছিলো গড়ে ৪.৫৮ শতাংশ।  ২০২০ তে মহামারীর থাবা, একদিকে দেশের মোট সম্পদের বৃদ্ধির হারে ব্যাপক পতন, ২০২০তে ৬.২৭ শতাংশ হারে মুদ্রাস্ফীতি, আর অন্যদিকে ২০২২ সালের তথ্য যা দেওয়া হলো, ফলাফল দাঁড়ালো ভয়ানক।  কিরকম ফলাফল?  ওই যে, সেই ট্র‍্যাডিশন সমানে চলিতেছে।

১৯৯১ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ সুগম করেছিলো দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির অচলবস্থা। অভ্যন্তরীণ বাজারের সম্প্রসারণ না ঘটা, যার ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমতে থাকা এবং চাহিদার পতন ছিলো যার ভিত্তি। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শর্তাবলির কড়াকড়ি, এবং সরাসরি বিনিয়োগ না আসা, ঋণ সৃষ্টিকারী পুঁজির বাড়বাড়ন্ত আর দেশের পরিশোধের হিসেবের যে ক্রাইসিস সুগম করেছিলো অর্থনীতিতে উদারনীতির পথ। এবং ১৯৯১ সালে ১.০৬ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধির হার ২০১৬ সালে গিয়ে পৌঁছেছিলো ৮.২৬ শতাংশে। এরপরে শুধুমাত্র মহামারীকেই যদি বৃদ্ধির হারে পতনের কারণ হিসেবে দেখতে শুরু করা হয়,  তাহলে মস্ত ভুল হবে। এই পতনের ট্রেন্ড শুরু হয়েছিলো ২০১৭ সাল থেকেই। মূল কারণ, চাহিদার পতন। অর্থাৎ,  ক্রেতারা কিনতে চাইছেন না। কারণ, আবার সেই শুরুর কথা, পকেটে যা রয়েছে, তা দিয়ে বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে তা কেনা সম্ভব হচ্ছে না।টাকা জমিয়ে কিছু কিনতে গেলে আগে আয় করতে হবে। আয় করতে গেলে চাই কাজ। ১৯৯১ সালের পর থেকে বেকারত্বের হার ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে ৫.৬৫ থেকে গেছে। অর্থাৎ, একদিকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটেছে, অথচ বেকারত্বের হারে কোনো হ্রাসের লক্ষন দেখা যায়নি। অর্থনীতির বিতর্কের ধারার মধ্যে এটিকে ‘জবলেস গ্রোথ’ অর্থাৎ ‘কর্মহীন বৃদ্ধি’ বলেও সংজ্ঞায়িত করা যায়। বেকারত্বের হারের যে ট্র‍্যাডিশন সমানে চলিতেছিলো,  তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে সাম্প্রতিক সময়ে এসে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির তথ্য বলছে ২০২১ সালের এপ্রিলে বেকারত্বের হার ছিলো ৭.৯৭ শতাংশ, মে মাসে ভয়াবহ আকার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ১১.৮৪ শতাংশে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারীতে ভারতবর্ষ দেখেছে বেকারত্বের হার ৮.১০ শতাংশকে ছুঁতে। যে বিতর্ককে দীর্ঘদিন জবলেস গ্রোথ বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তার সাথে যোগ হয়েছে নতুন মোড়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে কাজ হারিয়েছেন ৯০ লক্ষ মানুষ, অর্থাৎ কাজ বেমালুম হাওয়া হয়ে যাওয়ার নতুন রাস্তা বেশ কয়েকবছর হলো সুগম হয়েছে। মহামারীর সময় কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হয়ে গিয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির তথ্য বলছে ২০২০ সালের এপ্রিলে গোটা দেশের প্রেক্ষিতে কাজ হারিয়েছেন ১২.২০ কোটি মানুষ।

লকডাউন ওঠার পর থেকে, প্রতি মাসে কাজ হারানোর সংখ্যাটা লক্ষের নিচে নামার কোনো লক্ষন নেই।একদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামছাড়া দাম, অন্যদিকে বেকারত্ব, কাজ হারানো, সর্বপরী পকেটে টান, কি ভাবছেন? দেশের সবাই যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে? ভুল ভাবছেন। দেশে ১০ শতাংশ মানুষ আছেন, ২০২০ সালের অক্টোবরের হিসেব অনু্যায়ী যারা দেশের ৭৪.৩ শতাংশ সম্পদের মালিক, তাদের সম্পত্তির পরিমাণ চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে।  কোভিড এবং তার পরবর্তী সময় ভারতীয় কোটিপতিদের সম্পত্তি বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। খারাপ আছে তারা? কি বলবেন?কাজ হারানো, আয় কমা, বেকারত্বের জ্বালা যখন প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষকে নিক্ষেপ করেছে অনিশ্চয়তার অন্ধকূপে, কতিপয় মানুষ তারা সত্যিই ভালো আছেন। বাজারের আগুন তাদের পকেট স্পর্শ করেনা, উলটে এই মহামারীর সময় প্রতি ৩০ ঘন্টার সৃষ্টি হয়েছে ১জন করে কোটিপতি। সহজ হিসেব, অজুহাত খাড়া করে অর্ধেক মাইনেতে কাজ করানো, কিংবা একজন স্থায়ী কর্মীর জায়গায় পাঁচজন সস্তা মজুর বা ‘ইন্টার্ন’ রেখে রাতারাতি পদ গায়েব করে দেওয়া, কিংবা বেপরোয়া ছাঁটাই – ওয়েলকাম টু দা নিউ ডিকেড।এই কোটিপয়দের স্বার্থে বেশি কথা না বলাই শ্রেয় তাই না? এই কোটিপয়রাই তো সোফার গদি বানিয়ে দেন। তাদের পকেট ভরিয়ে এমন করেই যায় যদি দিন যাক না!প্রশ্ন হচ্ছে এই বিষয়গুলো নিয়ে ড্রয়িংরুমে চায়ের কাপে বা পাড়ার চায়ের দোকানে তুফান উঠবে কিনা! কোটিপয়রাই যে আসলে কতিপয় আর তাদের উল্টোদিকে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তারাই যে সংখ্যায় বেশি, আদতে যে তারাই সিংহভাগ – এই ভাবনা থেকেই চিন্তা কেন্দ্রিভুত হোক। বাকি সবকিছুই যেকোনো স্ট্রাকচারের তলায় মন্দির চাপা পড়ার মতোই পড়ে থাকুক।