তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের কর্মীদের ন্যায্য অধিকার ও বঞ্চনা নিয়ে লিখতে গেলে অনেক বিষয় চলে আসে, যতটা হয়তো বাকি অন্য অনেক পেশার ক্ষেত্রেই আসবে না। প্রথমত: ক্রমাগত obsolete, বা বাতিল, পুরনো হয়ে যাওয়াই এই প্রযুক্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করার দৌড় বরাবরই থাকে, সেই দৌড়ে এগিয়ে থাকাটাই টিকে থাকার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়, অন্য কোনও বিষয় বা চিন্তাপদ্ধতি সেখানে কাজ করে না। দ্বিতীয়ত: বর্তমানে আমাদের দেশে আই-টি শ্রমিকদের মোটামুটি দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে (দাদু বা ঠাকুরমা আইটিতে কাজ করতেন, এমন কর্মী খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না)। প্রথম প্রজন্ম যখন এই পেশায় এসেছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান বাকি চাকুরিজীবী মানুষদের তুলনায় বেশ ওপরের দিকেই ছিল। বলা যেতে পারে তাঁরা নানা বিষয়ের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়ুয়াদের এই পেশার দিকে আকৃষ্ট করেছেন সচ্ছলতা ও জীবনযাত্রার মাপকাঠিতে। একইসাথে, যেহেতু পার্থিব সবকিছুর সাথেই ক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে গেল, তাই নানা ধরণের কাজের জন্য কর্মীর চাহিদা জ্যামিতিক হারে বাড়তে শুরু করল। ক্রমশ: আইটি একটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত জনবহুল ক্ষেত্র হয়ে গেল, যেখানে আইডেন্টিটি বজায় রাখাটাই অনেকের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিল। তৃতীয়ত: তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র আসার পরেই চাকরির বাজার যেমন বড় হয়ে গেল, চাকরি পাল্টানোও তেমনই জলভাত হয়ে গেল। গত কয়েক দশক ধরেই দেখা যাচ্ছে একধরণের কর্মী আছেন, যাঁরা কোনও সংস্থায় দু-বছরের বেশি কখনও থাকেননি। অর্থাৎ বর্তমান মালিকের সাথে না পোষালে তার থেকে দাবি আদায়ের স্ট্রেস না নিয়ে অন্য কোথাও বেশি মাইনে এবং সুবিধার চাকরি খুঁজে নেওয়াটাই দস্তুর। প্রতিযোগিতার বাজারে একই ট্রেন্ড পরে অন্যান্য সেক্টরেও শুরু হল। এইরকম ঢিলেঢালা বাঁধুনি এবং আপাত স্বল্পমেয়াদী পেশার ধরণে তাই কর্মীর অধিকার অথবা একক লড়াইয়ের বদলে যৌথভাবে দাবি আদায়ের পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা কখনোই অগ্রাধিকার পায় নি, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।

এই আলোচনার পরিসরে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কাদেরকে বলা যাবে? (১) আইটি সফটওয়্যার, সার্ভিসেস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি সংস্থার সব ধরণের কর্মী (২) যে কোনও বাণিজ্য সংস্থা, যাদের মূল ব্যবসা আইটি নয়, সেখানকার আইটি সংক্রান্ত কর্মীরা (উদাহরণ – ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থার আই-টি বিভাগ) এবং (৩) যাবতীয় অস্থায়ী, ফ্রি-ল্যান্স আইটি পেশাদার, যাঁদের উদ্ভাবন ও পরিষেবা নানা বাণিজ্যিক কাজে লাগে। এইসব পেশাদারদের কাজের সঙ্গে নানা সংকট জুড়ে থাকে। এবারে দেখা যাক তাঁরা কি কি সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। (১) যদি একজন কর্মী কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই হঠাৎ কাজ হারান, এবং অভিযোগ জানানোর জন্য এসব ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা রাখেন, নিজের সংস্থায় এমন নির্দিষ্ট মানবসম্পদ বিভাগীয় কাউকে খুঁজে না পান, তাহলে সেই সংস্থার কর্মীরা অবশ্যই সংকটে আছেন। রিট্যালিয়েশন এক ধরণের অপরাধ, যার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট আইন আছে, একথা বহু অধস্তন কর্মী বা তার উর্ধতন ম্যানেজার কেউই জানেন না। জানানোর দায়িত্ব কিন্তু নিয়োগকারী সংস্থার (২) অনেক সময়ই নানা কায়দায় বা ছুতোয় কাজের সময়ের থেকে অনেক বেশি সময় অফিসে কর্মীদের আটকে রাখা হয় এবং নির্ধারিত ছুটিও পাওয়া যায় না। প্রায়শই কোম্পানির এমন কোনও নির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকে না, ব্যাক্তিবা গোষ্ঠীবিশেষের ইচ্ছামাফিকই হয় এমন। অফিসের সময় এবং যাওয়া আসার সময়ের বাইরে আর কোনও সময়ই পড়ে থাকে না, যা দিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং ন্যুনতম পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা যায়। এছাড়া অফিসে আটকে থাকার সাথে কখনও সখনও অধস্তন কর্মীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত যৌন দাবি-উসকানিও জুড়ে যায় (৩) বহু সময় এমনও হয় যে একজন কর্মী যে কাজের বিনিময়ে পয়সা পাচ্ছেন, সেই কাজের মূল উদ্দেশ্যটাকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে মেনে নিতে পারছেন না। ইদানীংকালে সাইবার ক্রাইম একটা আঁটোসাঁটো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, যে কথা কারোরই অজানা নয়। এইরকম আরও অনেক কিছু আছে (৪) যদিও সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে যে কোনও মানুষের ওপর তার জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, জন্মস্থান ইত্যাদি কোনও কিছুর ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না, বাস্তবে অনেকক্ষেত্রেই তার উল্টোটা ঘটে। উপরন্তু, বর্তমান সময়ে যখন দেশের শাসক দল গণতন্ত্রকে ফুটবল বানিয়ে খেলতে নেমেছে, তখন যেসব তাচ্ছিল্য বা ঘৃণাসূচক শব্দ আগে মানুষ নিজের পরিচিত, বিশ্বস্ত বৃত্তেই কেবল বলত, এখন তা খোলাখুলি উচ্চারণের সংস্কৃতি ক্রমশ: র‍্যাডিকাল আচরণের অংশ হিসেবে পোক্ত হচ্ছে (৫) অনেকসময়ই বেতন বা কন্ট্রাক্টের ধার্য পয়সা কর্মীর অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট হতে অস্বাভাবিক দেরি হয়, যার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দেখানো বা আইনিভাবে এই দেরির কথা জানানোর ধার ধারে না সংস্থা (৬) এছাড়া কিছু সার্ভিস সেক্টরে দীর্ঘক্ষণ অনড় অবস্থায় বসে থাকতে বাধ্য হন কর্মীরা, এমনকি বাথরুমে যাওয়াও সীমিত বারের বেশি সম্ভব হয় না। এর থেকে যা যা শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, তা হয়ে থাকে।

ওপরের সমস্যাগুলো দীর্ঘকালীন এবং সময়, প্রযুক্তি, মানুষের চেতনা ইত্যাদির সাথে সাথে নিয়ত পরিবর্তনশীল। কোভিড এসে এইসব ছকের বাইরে সম্পূর্ণ নতুন ছক তৈরি করে দিল। সামাজিক দূরত্ব প্রাণে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সুরক্ষিত দূর-নিয়ন্ত্রিত (secured remote) প্রযুক্তি এবং রোবোটিক প্রসেস অটোমেশনের বাজারটা হঠাৎই সুবিশাল হয়ে উঠলো। তা থেকেই অনলাইন শিক্ষা বা ঘরে বসে সবরকম অফিসিয়াল কাজ সারার প্রযুক্তি তৈরি হল। সহকর্মীদের থেকে দূরত্ব আরও বাড়ল। এই পরিবেশে ওপরে বর্ণিত সমস্যাগুলোর বেশ কয়েকটা বেড়ে গেল। শুধু যত বেশি সময়ে অফিসে কাজ করতে হচ্ছিল, প্রায়ক্ষেত্রেই তার থেকে বেশি সময় বাড়িতে থেকে কাজ করতে হলেও অফিস যাওয়া আসার সময়টা বেঁচে যাচ্ছিল এবং অতিরিক্ত মনিটরিং এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল ভেবে কেউ কেউ খুশি হচ্ছিলেন। এরই মধ্যে বহু মানুষ চাকরি হারালেন নানা বাস্তব এবং অবাস্তব কারণে। এর পাশাপাশি সুযোগসন্ধানী কিছু ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রথম সারির উপদেষ্টা সংস্থাগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে এক মাৎস্যন্যায় শুরু করল, যার কারণে বহু পদ বিলোপ হয়ে গেল। নতুন চাকরি খোঁজার পরিসরটাও ছোট হয়ে এল। যে কোনও যুদ্ধের বাজারেই যেমন কিছু লোক দেদার পয়সা কামায়, এই কোভিড যুদ্ধেও তেমনই তৈরি হল তেমন প্রচুর ‘ইউনিকর্ন’ কোম্পানি, যারা স্টক মার্কেটে লিস্টেড হওয়ার আগেই এক বিলিয়নের গণ্ডি পেরিয়ে গেল। এদের প্রত্যেকেই আগাগোড়া তথ্যপ্রযুক্তির ওপরেই দাঁড়িয়ে। সামাজিক নৈকট্যের জুজু নেতিয়ে যাওয়ার পরে এইসব ইউনিকর্নদের অনেকেরই স্পিড কমে এসেছে, বলি হয়েছেন অসংখ্য কর্মী, যা আমরা জানি। একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা খুব দরকার। কোভিডের সময় যেসব মানুষকে শারীরিকভাবে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতে হয়েছে, তাদের মধ্যে বহু আইটি কর্মী আছেন। যা যা সার্ভিস আমরা অনলাইন পেয়েছি, তা সে ব্যাঙ্কিংই হোক, বা অ্যাপ বেসড ডেলিভারি, সবকিছুই ১০০% নির্ভরশীল ছিল পেছনের আইটি পরিকাঠামোর ওপরে, যার তত্বাবধানে ছিলেন বহু অনসাইট কর্মী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কর্মীরা আউটসোর্সড, মাঝারি বা ছোট কোম্পানির কর্মী, যাদের কর্মীবিষয়ক সুযোগ-সুবিধা সীমিত। এমন অনেককে জানি যারা সেসময়ে এই নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করত, আবার চেনাশোনা বেশ কয়েকজন আছেন যাঁরা কর্মরত অবস্থায় সংক্রামিত হন এবং মারা যান। আমাদের সরকারি, আধাসরকারী বা বেসরকারি কোম্পানিগুলো টেন্ডারের মাধ্যমে আইটি আউটসোর্সিং এর জন্য কোনও ন্যুনতম মূল্য নির্ধারণ করে না বরং রিভার্স অকশনকে প্রোমোট করে। সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় যে সংস্থা সবথেকে কম মূল্যে অর্ডার তোলে, সে সবার আগে ম্যানপাওয়ার কস্ট কমায়, কারণ বাকিগুলো একটা পর্যায়ের পর আর কমানো যায় না। তাই অর্ডার তোলার পর বেশ কিছু কাজ সে আবার আউটসোর্স করে দেয় তার থেকে ছোট, শিথিল নিয়মনীতির কোনও কোম্পানিকে, যারা নির্ধারিত পয়সার থেকে অনেক কম পয়সা মাইনের বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নেয় বহু আইটি শ্রমিককে দিয়ে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫ এর মধ্যে ১১১ নম্বর স্থানে থাকা দেশে এ চিত্র খুব স্বাভাবিক। তবে বেসরকারিকরণ, এবং অসুস্থ টেন্ডার ব্যবস্থার যৌথ চাপ নেমে আসছে পরিষেবা ক্ষেত্রে, এবং শেষ পর্যন্ত কর্মীদের ওপর।

অতএব নানাস্তরের আইটি কর্মীরা নানা সময়ে এমন কিছু পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, যখন তাঁদের মনে হয় অন্যান্য অরগ্যানাইজড সেক্টরের মতো আইটিতেও যদি ইউনিয়ন জাতীয় কিছু থাকত, তাহলে একটু ভরসা পাওয়া যেত। সেই ভরসাটুকু দেওয়ার জন্য আছে অল ইন্ডিয়া আইটি অ্যান্ড আইটিইএস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (AIIETU), যার হেড অফিসের ঠিকানা সিলিকন ভ্যালি বা গুরুগ্রাম নয়, এই কোলকাতারই শ্রমিক ভবন। AIIETU তার সদস্যদের কর্মক্ষেত্র সংক্রান্ত আইনি সহায়তা, গ্রুপ ইন্সিওরেন্স ইত্যাদির পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তির তালিম দেওয়াতে (re-skilling) সরাসরি অংশ নেয়। প্রযুক্তি কর্মীদের কণ্ঠস্বর সরকারি সিদ্ধান্তগ্রাহকদের কান অবধি পৌঁছে দেওয়ার কাজেও সদা নিয়োজিত AIIETU।