![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2023/12/ak-4-1024x512.jpg)
“বিশ্বাস করো গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল ছবিটি দেখে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে গ্রামের পথের পাশে পাত পেড়ে খেতে বসেছে দুপুরে! ইনসাফযাত্রা যে এই চেহারা নেবে ভাবিনি! কম বয়সে থাকলে ট্রেনে চেপে পৌঁছে যেতাম ওদের কাছে! ওদের সঙ্গে হাঁটতাম।” যিনি একথা বলছিলেন তিনি একদা যুবফেডারেশনের সক্রিয় কর্মী হলেও এখন প্রত্যক্ষভাবে আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। বেশিদিন হয়নি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সংগঠনে থাকার সময় একাধিক পদযাত্রায় যোগ দিলেও রাজ্যজোড়া পদযাত্রায় কখনও অংশগ্রহণ করেন নি। বামফ্রন্ট সরকার এখন অতীতের স্মৃতি। কিন্তু সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের সরাসরি বিরোধিতা করে এমন সংগঠনে পুলিশি অত্যাচার এবং তাদের মদতপুষ্ট গুণ্ডা মস্তানদের অত্যাচারের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়,সেই সংগঠনের পতাকা ধরে মাইলের পর মাইল পথে দিনের পর দিন হাঁটার স্পর্ধা যারা দেখায়,তাদের সাহস ও আদর্শবোধ এক কথায় মুগ্ধ হওয়ার মতোই।
“ইনসাফ যাত্রা” কর্মসূচিকে অনেকেই ভেবেছিলেন বামপন্থী ছাত্র যুবদের প্রতীকি কর্মসূচি। তাঁরা ভেবেছিলেন এলাকায় এলাকায় ৭ ই জানুয়ারী ব্রিগেডের সমাবেশের প্রচার হবে দু মাস ধরে। টানা কর্মসূচিতে জনগণকে অংশগ্রহণ করানোর ক্ষমতা ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেই বলেই হয়ত চার পাঁচদিনের বেশি জেলায় জেলায় ইনসাফ যাত্রার মিছিল করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বোকা বানিয়ে গত ৩রা ডিসেম্বর কোচবিহার থেকে টানা চল্লিশ দিনের বেশি পথ হাঁটছে ইনসাফ যাত্রা। কলকাতার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ইনসাফ যাত্রা। এই লেখার সময় হাওড়া পেরিয়ে হুগলি নদীয়া উত্তর চব্বিশ পরগণা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার দিকে এগিয়ে চলেছে। আগামী ২২শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যাদবপুরে এইট বি বাসস্ট্যাণ্ডে ইনসাফ যাত্রা শেষ করবেন মীনাক্ষী মুখার্জী,ধ্রুবজ্যোতি সাহা,কলতান দাশগুপ্তরা । যাঁরা মিডিয়া আলো করে বসে থাকা তাবড় সাংবাদিক বিশ্লেষকদের বোকা বানিয়েছেন লাখো মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে। মনে রাখা দরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চনার শিকার একটা গোটা প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসাবে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের নেতৃত্ব হিসাব বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ের ডাক দিয়েছেন বাংলা জুড়ে,পাহাড় থেকে সাগরে।
ইনসাফ যাত্রার অভিজ্ঞতা বলছে, গ্রাম মফস্বলের সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা তরুণ তরুণীরা তো বটেই তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতারণা বঞ্চনার রাজনীতির হিসাব বুঝে নিতে দৃঢ় সঙ্কল্প দেখাচ্ছে অভিভাবকদেরও। তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বিজেপিকে নিয়ে বিভ্রান্তি অনেকটাই কেটে গেছে তাঁদের। শুধুমাত্র বিবৃতির লড়াইয়ে শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জী,অভিষেক ব্যানার্জীদের সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে তাঁরা ক্লান্ত। ২০২০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাম যুবকর্মীদের সন্ত্রাসে ঘরছাড়া করার লক্ষ্য নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী এখন বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখ। নারদার স্টিং অপারেশনে যাঁদের টাকা নেওয়ার ভিডিও ছবি ভাইরাল হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তাঁদের অন্যতম। অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধেও। স্বভাবতই এ হেন শুভেন্দু অধিকারীর ” পিসী ভাইপোর সব কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দেওয়ার “আওয়াজ তোলার নির্বিষ প্রচেষ্টা যে কেবল আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্তের অগ্রগতির ভরসায়,তাও ইতিমধ্যে জনগণ বুঝে ফেলেছেন। শুধু তাই নয়, নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে অপরাধী খুঁজে বার করার প্রক্রিয়া রহস্যজনকভাবে হরিশ মুখার্জী রোড এবং হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রীটে পৌঁছে থমকে যাওয়া নিয়ে বাসে ট্রেনে অটোতে আলোচনা শুরু হতেই উঠে আসছে মোদি মমতার সেটিংয়ের কথা। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আঠারোটি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টির নীচুতলার কর্মীদের গত সাড়ে চার বছরে আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকেছে। একান্ত আলাপচারিতায় তাঁরা স্বীকার করছেন আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচন তো বটেই ২০২৬ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপির সাফল্য অনেকটা নির্ভর করবে মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদির বোঝাপড়ার ওপর। এই অনুমান যে অবাস্তব নয়,তা বোঝা গেছে মমতা ব্যানার্জীর দিল্লির সফরসূচী দেখেই। ১৯ তারিখ ইণ্ডিয়া মঞ্চে সামিল দলগুলোর সভায় যোগ দেওয়ার পরদিন ২০ তারিখ ই তিনি মুখোমুখি হবেন নরেন্দ্র মোদির। মিডিয়া যতই বোঝাক রাজ্যের বকেয়া আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর এই বৈঠক ; কিন্তু আদালত অভিষেক ব্যানার্জীর আয়ের উৎস জানতে চাওয়ার পরেই এই বৈঠক সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে।
শিক্ষক পদে নিয়োগ দুর্নীতির শিকার যোগ্য বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের হাজার দিনের বেশি কলকাতার ধর্মতলায় অবস্থানে বসে থাকার ছবি যেমন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত যুবক যুবতীদের সঙ্গে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতারণার প্রমাণ ;তেমনি গরীব ও নিম্নবিত্তদের জন্য বরাদ্দ রেশনের খাদ্যশস্য এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য মিড ডে মিলের বরাদ্দকৃত চাল বেআইনিভাবে বিক্রি করার চক্রে যুক্ত থাকা শাসকদলের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর অনুগত ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানের সঙ্গে জেলবন্দী। এরই পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ যেমন ক্রমশ পঠনপাঠনের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠছে ,তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের ফলে সিঙ্গুরে মোটরগাড়ি তৈরির কারখানার বেসরকারি উদ্যোগ পরিত্যক্ত হওয়ার পরে গত বারো বছরে একটিও নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি যেখানে তরুণ তরুণীদের কাজের সুযোগ তৈরি হবে। টিভি চ্যানেলের টক শো তে তৃণমূল নেতাদের শিল্প স্থাপন সংক্রান্ত প্রশ্ন করলে তাঁরা কেবল শেষ ছ বছরে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে শিল্পসম্মেলনের কথা বলেন,কিন্তু যে পরিমাণ টাকা শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করার জন্য বিনিয়োগ করা হয়েছে সেই পরিমাণ টাকা কি শিল্প স্থাপনের জন্য কোন ব্যবসায়ী কি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেছেন – সেই প্রশ্ন তুললেই টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক শাসকদলের প্রতিনিধিকে বাঁচাতে আসরে নামেন। তরুণ প্রজন্মের দু চারজন বামপন্থী মুখপাত্র অবশ্য থামেন না,তাঁরা প্রশ্ন তোলেন কেন এই এগারো বছরে একটা সেকটর সিক্স তৈরি করা গেল না? কেন আর একটাও বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা গেল না তথাকথিত মা মাটি মানুষের সরকারের আমলে?
ইনসাফ যাত্রা হিসাব চাইছে পুলিশের হাতে আনিস খানের খুনের। যে খুনের অপরাধীরা শাসকদলের ছত্রছায়ায় আপাতত নিরাপদ। কামদুনির ধর্ষকদের শাস্তিও লঘু হয়ে গেছে রাজ্য সরকারের নিযুক্ত আইনজীবীদের অকর্মণ্যতার কারণে। কামদুনির মায়ের চোখের জলের হিসাব চাইছেন ইনসাফযাত্রীরা। মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর হিসাব কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়া হবে। জবাবদিহি চাওয়া হবে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া কবে ফিরিয়ে আনা হবে? একশো দিনের বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য কেন্দ্রের বিজেপি রাজ্যের তৃণমূল নেতাদের সদর্থক ভূমিকা নেই কেন – তার জবাবও চাওয়া হবে।
পরিতৃপ্তির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দেখেছেন বাজারি মিডিয়া অবজ্ঞা উপেক্ষা করলেও যথার্থ বিকল্প গণমাধ্যম হিসাবে ইনসাফযাত্রার পথের ভিডিও,ছবি এবং বিবরণী উঠে আসছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এভাবেই ইনসাফযাত্রাকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া গেল একঝাঁক নতুন সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার স্বেচ্ছাসেবককে।
এ বছর ৫ ই মার্চ নবজোয়ার যাত্রা নামে তৃণমূল কংগ্রেসের একটি কর্মসূচি শুরু হয়েছিল একই সূচনাস্থল থেকে। ডায়মণ্ডহারবারের সাংসদ ও তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জীর নেতৃত্বে কোচবিহার থেকে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রচুর সুরক্ষা র আয়োজন,দামী এস ইউ ভি গাড়ির সমাহার সহযোগে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তটস্থ থাকত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর নিরাপত্তা নিয়ে। কর্মসূচি সফল করার জন্য জান লড়িয়ে দিয়েছিলেন জেলাপ্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরের অফিসারেরা। তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা নেত্রীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব চাপা থাকেনি, পঞ্চায়েতের প্রার্থী বাছাই নিয়ে ভোটাভুটি হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ভারতের গণতান্ত্রিক যুবফেডারেশনের ডাকে এই ইনসাফ যাত্রায় এর ঠিক বিপরীত ছবি দেখা গেছে। এই যাত্রায় জেড ক্যাটিগরির নিরাপত্তা পাওয়া অভিষেকের মতো কোন ভিআই পি নেই, ,বরং গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেভাবে অংশগ্রহণ করেছেন ইনসাফ যাত্রায়,মীনাক্ষীদের ঘিরে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে – তা এক কথায় নজিরবিহীন। বৃহত্তর ক্ষেত্রের বামপন্থী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের বদলে আক্ষরিক অর্থেই তরুণ প্রজন্মের হাতে এই কর্মসূচিকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল । কোনও সন্দেহ নেই তাঁরা সফল হয়েছেন। ইনসাফ যাত্রার প্রভাব আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে সিপিআই(এম) সহ বাম ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ভোটবাক্সে কতটা পড়বে এই বিশ্লেষণে যাওয়ার সময় এখনো আসেনি। রাজ্যব্যাপী কোন কর্মসূচিকে গণ আন্দোলনে পরিণত করা গেছে – ইনসাফযাত্রা ঘোষিত ব্রিগেড সমাবেশের আগেই সেই সাফল্য স্পর্শ করেছে – এর তাৎপর্য আগামী দিনের রাজনীতিতে সুগভীর।