একটা রবার ব্যান্ড থাকলেও ইরাকে হামলা চালাত আমেরিকা

                                   বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য

মার্চ ১৯, ২০২৩,  ঠিক কুড়ি বছর পার করলো ইরাক, তাদের ওপরে একতরফা মার্কিন আগ্রাসনের।

ইরাকের কাছে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ (weapons of mass destruction) আছে অভিযোগ তুলে ২০০৩ সালের ১৯ শে মার্চ দেশটিতে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো। এই আগ্রাসন ঠেকানোর অনেক চেষ্টা হয়েছিল বিশ্বের নানা মহল থেকে , কর্ণপাত করেনি আমেরিকা-ব্রিটেন কেউই। যে সাজানো অভিযোগের ভিত্তিতে এই একতরফা হামলা হয়েছিল সেই মারণাস্ত্র গোটা ইরাকের কোথাও পাওয়া যায় নি, ছিলও না। ইরাকে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পুতুল সরকার বসিয়ে তেলের খনিগুলোর ওপরে একচেটিয়া অধিকার চেয়েছিল আমেরিকা-ব্রিটেন, চেয়েছিল সোভিয়েত বিলুপ্তির পরে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কব্জা মজবুত করতে, আরও সাম্রাজ্য বিস্তার করতে – সেটা তারা সাফল্যের সাথে পেয়েছে।  

ইরাকে মার্কিন হামলার চূড়ান্ত সলতে পাকছিল ২০০২ এর সেপ্টেম্বরে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের প্রশাসন নতুন জাতীয় নিরাপত্তা নীতি ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয় – জৈবিক, রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্র, গণ বিধ্বংসী অস্ত্রের অধিকারী কোন সন্ত্রাসবাদী দেশ দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি হুমকির মুখোমুখি হয়, তাহলে সেটা ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে তারা সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে। ঠিক একই সময়ে ব্রিটেনেও হাউজ অব কমন্সে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাকের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার এক সাজানো প্রতিবেদন তুলে ধরেন, সেখানে তাদের সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে তুলে ধরা হয়।

এর ঠিক দু মাস পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, যেখানে অস্ত্র পরিদর্শকদের ইরাকে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়। সেই পরিদর্শকরাও জানুয়ারি ২০০৩ এ ইরাকে গিয়ে কিছু খুঁজে পান নি। তারপরেও দমানো যায়নি মার্কিন – ব্রিটেন শক্তিকে । জোরকদমে চলতে থাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন শহরে শান্তিকামী সংগঠন ও মানুষের জমায়েত হয় ১৫ ই ফেব্রুয়ারি , লন্ডন আর রোমে জমায়েত ছিল সবচেয়ে বড়। সাধারন মানুষের হাতে পোস্টার ছিল – ‘নো ব্লাড ফর অয়েল’। বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি মার্কিন ব্রিটেন কোন শক্তিই।

মার্চের ১৭ তারিখে সাদ্দাম হোসেনকে পরিবার নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ছাড়ার সময়সীমা বেধে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ। ঠিক ৪৮ ঘণ্টা পরেই শুরু হয় অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম। ভোর সাড়ে চারটে থেকে একের পর এক মার্কিন ক্রুশ মিসাইল আছড়ে পরে ইরাকে। মাত্র এক মাসের মধ্যেই রাজধানী বাগদাদ আমেরিকা ও ব্রিটেনের দখলে এসে যায়। সবচেয়ে ঘৃণ্য আক্রমনটি চলে বাগদাদের রেড ক্রিসেন্ট মা ও শিশু হাসপাতালে। সরাসরি মার্কিন বোমারু বিমান এতে বোমা ফেলে যায়।

সম্প্রতি ইরাকের ওপরে আরোপিত এই ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ নিয়ে নতুন এক চমকপ্রদ স্বীকারোক্তি সামনে এসেছে বিবিসির ‘শক অ্যান্ড ওয়ার: ইরাক টোয়েন্টি ইয়ারস অন’ নামে নতুন এক সিরিজে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ র ইরাক অপারেশন্স গ্রুপের প্রধান ছিলেন লুইস রুয়েডা। তার স্বীকারোক্তি – ‘ সাদ্দাম হোসেনের কাছে যদি একটি রবার ব্যান্ড বা একটি পেপার ক্লিপও থাকত, তাও আমরা ইরাকে আগ্রাসন চালাতাম। আমরা হয়তো তখন সাধারন মানুষকে এটাই বলতাম, ‘ সাদ্দাম তোমাদের চোখ উপড়ে ফেলতে চান।’

আসলে এমন পরিস্থিতি আমেরিকা ব্রিটেন মিলে তৈরি করেছিল যে ইরাকের বিষয়ে কিছুই জানে না এমন লোকজনের কাছেও যেকোনো মূল্যে ইরাককে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে হবে। এই কাজে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল পশ্চিমের ‘প্রগতিশীল’ তকমা পাওয়া গনমাধ্যমও। তারা সকলে লিখেছিল- বিশ্বশান্তির জন্য ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সরানো দরকার, সাদ্দামের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল–কায়েদার সঙ্গে যোগসাজশ, এমনকি সাদ্দাম হলেন আধুনিক নাৎসি বাহিনীর হিটলার। পরবর্তীতে একটা অভিযোগও সত্যি প্রমানিত হয়নি। এমনকি আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকেও দু চক্ষে সহ্য করতে পারতেন না সাদ্দাম। হামলার শেষে সাদ্দাম যখন বন্দী হলেন এফ বি আই এর হাতে , তখন তাকে সাত মাস ধরে জেরা করেছিলেন জর্জ পিরো। পিরো পরবর্তীকালে সি এন এন এর এক সাক্ষাৎকারে পরিস্কারভাবে বলেন – ইরাকে সত্যি কোন ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ ছিল না। আল কায়দার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের তথাকথিত সম্পর্ক নিয়ে পিরো বলেন, ‘সাদ্দাম আমাকে বলেছিলেন যে তিনি ওসামা বিন লাদেনকে চূড়ান্তভাবেই অপছন্দ করেন এবং পুরো আরব বিশ্বে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য থাকায় তিনি আল কায়েদার আদর্শে কখনই বিশ্বাস করেন না। সেই সময়ে অন্য ইরাকি বন্দিদের ওপরেও চরম নির্যাতন চালিয়েও আমেরিকা নিশ্চিত হয়েছিল যে আল কায়েদার সঙ্গে ইরাকের কোনো সম্পর্ক ছিল না।   

পশ্চিমের গনমাধ্যম একটা কাজ খুব সাফল্যের সাথে করে গেছে। একতরফা আগ্রাসনকে তারা সম্পূর্ণরুপে বদলে দিয়েছিল সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। কিন্তু তারা আজ অবধি প্রশ্ন তোলেনি , যে ধুয়ো তুলে এই আগ্রাসন শুরু হল , সেই ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ কোথায় গেল ? আসলে সেই সময়ে সমস্ত সংবাদমাধ্যমগুলোর সম্পাদকের দায়িত্ত্ব পালন করেছেন বুশ – ব্লেয়ার জুটি । বুশের সরাসরি প্রশ্ন ছিল – তারা নিজের দেশের মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে চায় নাকি সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিতে চায় ? ফলে একতরফা মার্কিন হামলার পক্ষেই কর্পোরেট মাধ্যম তাদের রায় দিয়ে দেয়, কোন ভিন্নমত বা মানবতাবোধ আর কাজ করেনি।

২০০৩ এর মার্চ থেকে ২০১১ র ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারীভাবে ইরাকে মাকিন সেনা ছিল। হামলার ফলে এই আট বছরে সাধারন অসামরিক ইরাকি জনগনের মোট মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ। এটাও সরকারী পরিসংখ্যান। আসল সংখ্যা কয়েকগুন বেশি। মধ্যেপ্রাচ্যে একটা কথা খুব জনপ্রিয় ছিল – ‘কায়রো লেখে, বেইরুট ছাপার কাজ করে আর বাগদাদ পড়ে’। মার্কিন হামলার পরে এক একটা বিস্তীর্ণ এলাকায় আর পড়ার কেউ ছিল না।   

বুশ আর ব্লেয়ারের এই জুটিই ছিল আসলে ‘গণবিধ্বংসী’, যা এই কুড়ি বছরে প্রমান হয়েছে।  ২০০৩ এর এই হামলার সময়ে মার্কিন জনগনের ৭৬ শতাংশ পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন, আর এখন কুড়ি বছর পরের জরিপে ৬২ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন এই একতরফা হামলা চূড়ান্ত ভুল পদক্ষেপ ছিল।