এই প্রতিবেদকের মতো নিম্নমেধার মানুষের পক্ষে কোন মহৎ মানুষের পদরেখা ধরে চলা এক অসম্ভব ব্যাপার। সে অক্ষম চেষ্টা সে করেও না, তাঁদের দূর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করার সহজ কাজটিই সে করতে পারে। সাধ্যমতো তাই ই করার সে চেষ্টা করছে।

কয়েক দিন আগে ৭ই ডিসেম্বর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের মূল ব্রত বিধবা বিবাহ প্রথম সম্পন্ন হবার তারিখের আগে-পরে আবার, তা নিয়ে সমাজ মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।

এই সুযোগে প্রতিবেদক ‘লেফট স্কোয়াড’এর প্রথম কিস্তির লেখার বিষয় হিসাবে মহামতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (যদিও নিজে তিনি সব সময়েই ব্যবহার করেছেন – ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা নামটি। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ১৮৩৯ সালে যখন দেওয়া হয়, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বৎসর) মহাশয়ের বিষয়ে পল্লব গ্রাহিতার সাহায্যে কিছু কথা বলতে চেষ্টা করছে।

ঐ যে কলকাতার ঠনঠনিয়ার মধ্য বয়স্কা নারী, চরম দারিদ্রপীড়িত ক্ষুধায় কাতর মলিন বালক ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য ফলারের ব্যবস্থা করে, তাঁর ক্ষুন্নিবারণ করেছিলেন এবং যে কারণে তিনি সকল নারীকে ‘করুণাময়ী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই বোধ থেকে তিনি কোনদিনও সরে আসেন নি।

বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংগ্রহের সভা করতে গিয়ে এক শিশু-বিধবা কন্যার কষ্ট দেখলে, তাঁর মন গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য, শুধু এই একটি ঘটনাতেই যে তিনি বিধবা বিবাহের জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম ও লাঞ্ছনা ভোগ করেও ঋজু ভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তা নয়। তিনি নানা ঘটনার মধ্যবর্তিতায় উপলব্ধি করেছিলেন, বঙ্গসমাজে বিধবাদের প্রতি চরম অন্যায়, অত্যাচার ও কখনও কখনও অশ্লীলতার ঘটনা ঘটে থাকে।

ঈশ্বরচন্দ্র লাগাতার উজান দরিয়ারা মাঝির মতো কষ্টকর পথে চলে, কখনও স্বনামে কখনও বেনামে বিধবা বিবাহের পক্ষে নিবন্ধাদি লিখে, বহু কৃতবিদ্য মানুষকে নিজের মতের স্বপক্ষে এনে, নিজে শারীরীক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত হয়ে, ১৮৫৬ সালে অক্টোবর মাসে সরকারের কাছ থেকে বিধবা বিবাহের আইন করিয়ে নিতে সক্ষমপর হয়েছিলেন। কাল বিলম্ব না করে তার দু’মাসের মধ্যে, কলকাতায় ৭ই ডিসেম্বর বিধিসম্মতভাবে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও বিধবা কালীমতির মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হলো।

কিন্তু শ্রীশচন্দ্রের দম খাটো ছিল। তিনি ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করে নিজ ঝাঁকে আবার ফিরে এলেন।

কিন্তু তাতে ঈশ্বরচন্দ্রের জেদ কমে নি ! তাঁর পুত্র নারায়ণের সঙ্গে এক বিধবার বিবাহ দিলেন। তিনি সেই উপলক্ষে তাঁর ভাই শম্ভূচন্দ্রকে বলেছিলেন -“বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনে সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এজন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোনও সৎকর্ম করিতে পারিব তাহার সম্ভবনা নাই। এই বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হয়েছি এবং আবশ্যক হলে প্রাণান্ত স্বীকারেও পরাম্মুখ নহি।“( শম্ভূচন্দ্র যেমন লিখেছেন, অবিকল তাই রাখা হলো)

বিধবা নারীর সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেবার পরে আরও কয়েকটি বিধবা বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু শেষতঃ, তাকে হতাশই হতে হয়েছিল। এই মহৎ কৃত্য, কূপমণ্ডুক সমাজ তাঁর জীবদ্দশায় গ্রহণ করলো না। তাই ঈশ্বরচন্দ্র খেদোক্তি করে বলেছিলেন – “আমাদের দেশের লোক এতো অসার ও অপদার্থ একথা পূর্বে জানলে আমি কখনোই বিধবা বিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।“

এখানে বলতে হবে বিধবা বিবাহ প্রবর্তন ছাড়াও, বাল বিবাহ ও বহু বিবাহ রদের জন্য তিনি নিবন্ধ লিখে ও সহযোগী পথিকৃতদের সঙ্গে নিয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

কূপমণ্ডুক, অমানবিক, অত্যাচারী, নারী বিদ্বেষী সমাজের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে চাবুকের ব্যাঙ্গবাণ তিনি নিক্ষেপ করেছিলেন –“ আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস এই, যদি নরক নামে বাস্তবিক কোন স্থান থাকে; তাহা হইলে টিকিকাটা বিদ্যাবাগীশের পাল সর্বাগ্রে নরকে যাইবেন, এবং নরকের সকল জায়গা দখল করিয়া ফেলিবেন; আমরা আর সেখানে স্থান পাইবো না।“

২-

ঠাকুরদাদা রামজয় তর্কভূষণ, মা ভগবতী দেবী, বাবা ঠাকুরদাস শিশুকালেই তাঁর মধ্যে অনেকগুলি গুন উপ্ত করে দিয়েছিলেন। কালে দিনে সেই গুনগুলি আরও বেড়ে উঠল।

তাই, এই কঠোর পরিশ্রমী, জেদি ও তেজি লৌহদৃঢ় মানিসিকতা সম্পন্ন, শিক্ষার প্রতি বিপুল প্রীতিময় মানুষটি যে, উল্লিখিত তিনটি বিষয়েই নিজেকে নিবেদিত ও নিয়োজিত রাখবেন, তা কী কখনও হতে পারে!

ইতোমধ্যে মহান রামমোহন রায় অনেক কাজ নিষ্পন্ন করেছেন। ১৮৩৩সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর যখন তিনি প্রয়াত হলেন, ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র ১৩ বৎসর। মহামতি রামমোহনের পদরেখা তখন জাজ্বল্যমান হয়ে বিরাজ করছে। বিদ্যাসগর সর্বতোভাবে না হলেও, তার উত্তারাধিকার অনেকটাই বহন করেছেন বলা যায়। আসলে তখনকার যুগ এক নব জাগরণের যুগ। ডিরোজিও, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, ডেভিড হেয়ার, ডি ওয়াটার বেথুন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কালীপ্রসন্ন সিংহ, দীনবন্ধু মিত্র, মোয়াট প্রমুখ মহাভাগের জীবনকে যেমন ঈশ্বরচন্দ্র আলোকিত করেছেন, তেমনই, বিপরীতে তাঁরাও। তাঁর নিজ দর্শন ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞানের মিলন। এবং সেই সঙ্গে সমাজকে যা বিড়ম্বিত করা ছাড়া আর কিছুই করবে না, সংস্কৃত শিক্ষার সেই বোঝাগুলিকে নামিয়ে দেওয়া। এবং সেই মতোই তিনি এগিয়ে গিয়েছেন।

বিষ্ময় মানি, তিনি কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মান, বালিকাদের জন্য শিক্ষালয় স্থাপন, বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে সংস্থা নির্মান, এবং কত পুস্তক রচনা করেছেন তিনি, তা ভেবে ! বিষ্ময় মানি, এতো কর্মকাণ্ডের মধ্যে ২৭টি পুস্তকের বেশিরভাগ অল্পকালের মধ্যে তিনি রচনা করলেন কী ভাবে ! যার মধ্যে কয়েকটি অনুবাদ ও কয়েকটি মৌলিক। কোনটি নিজ নামে, কোনটি ছদ্মনামে। পুস্তক প্রকাশ ও তা বিক্রির জন্য ব্যববস্থাদি করাও তো এক বিরাট কাজ! তাঁর লিখিত পুস্তক গুলির মধ্যে এখনও পাঠ করা হয় এরকম কয়েকটির নাম – বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবন চরিত, বোধোদয়, সংস্কৃত ব্যকরণের উপক্রমনিকা, ব্যকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলি, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস, ভূগোল খগোল বর্ণনম ( বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তক) ইত্যাদি।তাঁর গদ্য শৈলি নিয়ে কিছু সমালোচনা কেউ কেউ তৎকালে করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গুণির সম্মান অকপটে জানাতে ভুল করেন নি – “বঙ্গ সাহিত্যে আমার কৃতিত্ব যদি দেশের লোক স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বারোদ্ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগর।“ (বিদ্যাসগর চরিত।)

এসবের বাইরে, তাঁর মানবিকতার বহুবিধ নিদর্শণ এখনো আমাদের আলোচনার মধ্যে এসে থাকে। মহামারী কলেরা রোগীর সেবা, বিপন্নদের সাহায্য, দুর্ভিক্ষে ত্রাণ দান, (ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের প্রতি তাঁর যে সহায়তা, তা ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে।) বিভিন্ন খাতে শুধু দান বাবদেই ব্যায় করেছেন ১২-১৩ লক্ষ টাকা। (সেই সময়কার হিসাবে কত বিপুল পরিমান অর্থ তা, একথা মনে রখতে হবে)।আয়ূ যাপনের ৫২ বৎসরের মধ্যে অসমান্য কীর্তিগুলি তিনি নিস্পন্ন করেছিলেন। এসবের মধ্যবর্তিতায় তিনি স্বদেশে-বিদেশে শ্রদ্ধার আসনে বৃত হয়ে আছেন।

জীবনের শেষ চৌদ্দ বছর তো তিনি কার্মাটারে সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন। আর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ৭২ বৎসর বয়সে।প্রতিবেদকের মতো আয়ূ সূর্য যাদের পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে, তাঁদের পক্ষে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা কষ্টকর হলেও, তরুণ বয়েসীদের জন্য তা অনায়াস সাধ্য হবে। অতএব আহ্বান, তাঁরা এগিয়ে আসুন।