যখন এই লেখা লেখা হচ্ছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে, ততক্ষণে মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছুঁয়েছে, আহতের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এ কথা বলাই বাহুল্য যে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেকটাই বেশি, এগুলি স্রেফ নথিভুক্ত দস্তাবেজের হিসেব। বহু মানুষের লাশ এখনও ধ্বংসস্তূপের তলায়, বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। একটানা ১৪২ দিন ধ’রে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে প্যালেস্তাইনের নানান শহরে।

      এক সময় হামাস-খতম করার লক্ষ্যে গাজা-র উত্তরে হামলা চালাল ওরা, সেখানকার অসামরিক বাসিন্দাদের বলা হ’ল দক্ষিণে চলে যেতে। অনেকে জান বাঁচাতে সরে গেলেন দক্ষিণে। ইজরায়েল পরের ধাপের হামলা শুরু করল দক্ষিণেই। বলা হ’ল আরও দক্ষিণে সরে যেতে। বহু প্যালেস্তিনীয় তা-ই করলেন, খান ইউনুস-এ সরে গেলেন। সেখান থেকে আরও দক্ষিণে রাফা-য় সরে গেলেন তারপর। উত্তর দিক থেকে উত্তর-গাজা, গাজা, দেইর-আল বালাহ্, খান ইউনুস মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার পর এখন ইজরায়েলি বাহিনী বেলাগাম আগ্রাসন চালাচ্ছে রাফা-য়। তাড়িয়ে তাড়িয়ে মারছে, খাঁচায় পুরে খুঁছিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। পৃথিবীর কোনও ভাষাতেই এটাকে ‘যুদ্ধ’ বলে না। যা ঘটছে তা  দখল আর গণহত্যাই। এবং এই দখলের, এই গণহত্যার শুরুটা কোনোভাবেই ২০২৩ সালের অক্টবরে হয়নি। ’২৩-এর অক্টোবরে যা হয়েছে তা ছুতো মাত্র।

    ১৯৪৮ সালের ১০ই মার্চ, বুধবার। তেল-আভিভ শহরের উত্তর দিকে ইয়ারকন স্ট্রিটের একটি বাড়িতে (‘Red House’) ১১ জন জায়নবাদী নেতা ও ইহুদি সেনা-অফিসারের মিটিঙে চূড়ান্ত হয় ‘প্ল্যান ডি’ (Plan D)। ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত বিপুল এলাকা থেকে, সেই দেশ থেকে কীভাবে প্যালেস্তিনীয়-আরবদের তাড়ানো হবে, কীভাবে তাদের নিকেশ করা হবে, তার বিস্তারিত পরিকল্পনা ছিল এটি। মিটিঙটি বসেছিল দুপুরে, আর সন্ধের মধ্যেই বিভিন্ন বেসরকারি সামরিক বাহিনীর কাছে পৌঁছে গেছিল নির্দেশ। বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের লম্বা তালিকা ধ’রে সেইসব জায়গা থেকে প্যালেস্তিনীয়-আরবদের উচ্ছেদ করার পদ্ধতি সম্পর্কে অনুপুঙ্খ এই নির্দেশিকায় ছিল: হুমকি, অবরোধ, বোমাবাজি, ঘরে আগুন দেওয়া, সম্পত্তি ধংস, লুটপাট, বলপূর্বক বসতি উচ্ছেদ, বাড়ি ও মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া, এমনকি ধ্বংসস্তূপেও মাইন বিস্ফোরণ— যাতে একজনেরও বেঁচে ফিরে আসার সম্ভবনা না থাকে।

     ‘প্ল্যান ডি’-র নির্দেশিকা হাতে পেয়ে কালক্ষেপ না ক’রে অস্ত্র হাতে হামলেও পরেছিল জায়নবাদী মিলিশিয়াগুলো। যে বাড়িতে এই পরিকল্পনাটি পাকা হয়েছিল, সেটি ছিল প্যালেস্তাইনের মূল জায়নবাদী গুপ্ত-মিলিশিয়া ‘হাগানা’-র সদর দপ্তর।

     এই মাস্টার-প্ল্যানটি গৃহীত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে প্যালেস্তাইনের অর্ধেকের বেশি অধিবাসী (প্রায় ৮ লক্ষ মানুষ) ভিটে থেকে উৎখাত হন। ৫৩১টি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১১টি শহরাঞ্চল ফাঁকা হয়ে পড়ে, সেখানকার সমস্ত অধিবাসী উচ্ছেদ হন। এই জাতিভিত্তিক সাফাই অভিযানটির লক্ষ্যই ছিল, প্যালেস্তাইনের একটির পর একটি জনপদকে ফাঁকা ক’রে সেখানে ইহুদি উপনিবেশ স্থাপন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের এখানে নিয়ে এসে বসতি স্থাপন। এক কথায়, জবরদখল।

     ‘সেটলার আন্দোলন’ (Settler Movement) নামে খ্যাত জবরদস্তিমূলক বসতি স্থাপনের এই জায়নবাদী প্রকল্পটিই ইজরায়েল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। 

     আমরা ভারতের অভিজ্ঞতা থেকেই ‘হিন্দু ধর্ম’ আর ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর দূরত্ব সম্পর্কে সচেতন। জানি, দু’টো এক জিনিস নয়। ‘জায়নয়াদ’ও আসলে ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর মতোই একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যা ইহুদি ধর্মীয় পরিচিতির রাজনীতিকরণ ঘটাতে চায়। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের খোয়াবকে বাস্তবায়িত করতে ‘হিন্দুত্ববাদী’রা যেভাবে হিন্দু ধর্মের সামরিকীকরণ ঘটাতে চায়, জায়নবাদীদের সশস্ত্র মিলিশিয়াগুলিও তেমনই ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ (ইজরায়েল) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। হাগানা ছিল তেমনই একটি মিলিশিয়া।

      ১৯১৭ থেকে ১৯৪৮ সাল অবধি প্যালেস্তাইনে ব্রিটশ-ম্যানডেট বলবৎ ছিল। তারও আগে দেশটা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। দক্ষিণ ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার বিরাট ভূভাগজুড়ে ছিল এই সাম্রাজ্য। সেই অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকেই, উনিশ শতকের শেষ-ভাগে, জায়নবাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেদিক থেকে এ-দেশের হিন্দুত্ববাদের চেয়ে বয়সে জায়নবাদ একটু বড়োই বটে, যদিও আমাদের দেশেও হিন্দুত্বের মতাদর্শটির ভিত্তিভূমি ওই উনিশ শতকের শেষ-ভাগ থেকেই মজবুত হচ্ছিল। তবু সংহত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হিন্দুত্ববাদের ধারণা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ‘আর এস এস’-এর প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল বিশ শতকের বিশ-দশক অবধি। ওদিকে জায়নবাদী সংগঠন তৈরি হয়ে গেছে উনিশ শতকের নব্বই-দশকেই।

    ১৮৯৭ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম জায়নবাদী-কংগ্রেস। সুইৎজারল্যাণ্ডে। আহ্বায়ক থিওডর হেরজ়ল। তিনিই নবগঠিত ওয়ার্ল্ড জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এই সম্মেলন থেকেই, সেই কবে ১৮৯৭ সালে, স্থির হয়ে গেছিল জায়নবাদীদের মূল লক্ষ্য। প্যালেস্তাইনে ইহুদি জাতি-রাষ্ট্র গঠন। তার আগের বছর, ‘৯৬-তে, প্রকাশিত হয়েছিল হেরজ়ল-এর লেখা ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ নামের পুস্তিকা। 

    প্যালেস্তাইনে আরব-মুসলমান, ইহুদি, খ্রিস্টান, আদিবাসী সহ সব সম্প্রদায়ের মানুষেরাই ছিলেন যুগ যুগ ধ’রে। আমাদের ভারতেরই মতো; নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের বহুজাতিক দেশ। সেইখানে বহুত্বের সব রঙ মুছে একটিই নির্দিষ্ট জাতি-পরিচিতির ভিত্তিতে এক-জাতি-রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য।

    ঘটনা হচ্ছে, যে-সময় জায়নবাদীরা এই লক্ষ্য স্থির করছেন, তখনও ইহুদিরা সে-দেশের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি মাত্র। সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবরা। ফলে একটি ইহুদি জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল এই অঞ্চলে ইহুদিদের একটা নির্ণায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করা। স্থানীয় আরব জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত না ক’রে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-থাকা ইহুদিদের প্যালেস্তাইনে নিয়ে এসে বসতি স্থাপন না ক’রে যা সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ একদিকে প্যালেস্থিনীয়-আরবদের জন্য ‘জাতিভিত্তিক-সাফাই অভিযান’ (Ethnic cleansing), অন্যদিকে অপ্যালেস্থিনীয়-ইহুদিদের জন্য ‘বসতি-স্থাপন অভিযান’ (Settler Movement)। জায়নবাদের ডান-পা আর বাঁ-পা। উনিশ শতকের শেষ থেকে দু’পায়ে গটগট হেঁটে এগোতে শুরু করলেন জায়নবাদীরা। তাঁদের লক্ষ্যের দিকে।

        বিশ শতকের শুরু। সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের সময়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এমন একটা অঞ্চলে, সে-সময়, ইহুদি অভিবাসন ও বসতি স্থাপন নিশ্চিত করার জন্য জায়নবাদীদের ভিড়তেই হ’ত সাম্রাজ্যবাদের শিবিরে। একটা মৈত্রী-বন্ধনে আবদ্ধ হতেই হ’ত। পৃথিবীর এই অঞ্চলে বিকশিত হতে-থাকা মুক্তিকামী আরব-জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গ’ড়ে তুলতে ইহুদিরা যে দারুন ভূমিকা পালন করবে, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে হেরজ়ল-রা ‘সেটলার আন্দোলন’-এর একটা গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতে চান অটোমান সাম্রাজ্যের কাছে। কিছু পরে, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন এবং প্যালেস্তাইনে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ কায়েমের প্রাক্‌মুহূর্ত থেকে, জায়নবাদীরা ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টাতেও কসুর করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করার ইনামও তারা পায়।

       ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ব্রিটিশ বিদেশ-সচিব আর্থার বেলফোর্ড সাহেব ব্রিটেনের জায়নবাদী নেতা লর্ড রোৎসচাইল্ড-কে একটি চিঠি লেখেন। প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটিশদের সমর্থন ঘোষণা করা হয় এতে।

     “আরবদের মেরে তাড়াও, তারপর তাদের জমিতে বাইরে থেকে আসা ইহুদিদের উপনিবেশ গড়ো”, এই তো জায়নবাদের মূল কথা। জায়নবাদ নামের মতাদর্শটি আদতেই এক ধরণের উপনিবেশবাদী মতাদর্শ। অনেকেই বলেন, ভুল বলেন না, ‘বেলফোর্ড ঘোষণাপত্র’টি ছিল উপনিবেশবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের গাঁটছড়া। এই গাঁটছড়া বেঁধেই উপনিবেশবাদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের বিয়ে হ’ল ১৯১৭ সালে। বাচ্চা জন্মাল তিরিশ বছর সাতাশ দিন পর। তার নাম, ইজরায়েল। 

    ১৯৪৭-এর ২৯শে নভেম্বর রাষ্ট্রসঙ্ঘের ১৮১ নং রেজোলিউশন পাশ হ’ল। ইজরায়েল নামের ইহুদি-রাষ্ট্রটি গঠনের প্রস্তাব পাশ হ’ল। শুরুতে তেল-আভিভ-এর ‘রেড হাউস’-এ যে মিটিঙের কথা উল্লিখিত, যেখান থেকে পাশ হয়েছিল ‘প্ল্যান ডি’, সেটি আরও কয়েক মাস পরের গল্প। তবে এই ‘প্ল্যান ডি’-র আগে থেকেই, কার্যত বহু আগে থেকেই জায়নবাদীরা একদিকে চালিয়ে গেছে এথনিক ক্লিঞ্জিং, অন্যদিক সেটলার মুভমেন্ট। একদিকে প্যালেস্তিনীয়-আরবদের প্যালেস্তাইন থেকে সাফ করা, অন্যদিকে প্যালেস্তাইনের মাটিতে অপ্যালেস্থিনীয়-ইহুদিদের উপনিবেশ স্থাপন করা। ইজরায়েলের প্রসব-মুহূর্তে এই দখল-অভিযানের গতি ও তীব্রতা, স্বাভাবিক কারণেই, চূড়ান্ত আকার নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ‘প্ল্যান ডি’ মোতাবেক হামলা শুরুর দু’ মাস চার দিন পর, ১৪ই মে ১৯৪৮, তেল-আভিভ থেকেই পৃথিবীকে প’ড়ে শোনানো হয় ‘ইজরায়েলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’। সে-দিন মধ্যরাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর ক’রে ইংরেজরা।

     অসংখ্য প্যালেস্তিনীয়-আরব উৎখাত হন ভিটেমাটি থেকে। বাস্তুচ্যুত হন। উদ্বাস্তু হয়ে চলে যান পাশের দেশগুলোতে। মিশরে, লেবাননে, জর্ডানে। প্যালেস্তাইন নামের দেশটার অধিকাংশটাই ইজরায়েল হয়ে যায় ’৪৮-এ। যে-টুকু যা জমিজমা বেঁচে ছিল, ১৯৬৭-র ছয় দিনের যুদ্ধে সেটাও গিলে খায় ইজরায়েল।

      ইজরায়েল নামে যে রাষ্ট্র, তার সীমানার ভেতরে যে প্যালেস্তিনীয়-আরবরা থাকেন, তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। নাগরিক অধিকার তাঁদের নেই। মাটিটা তাঁদেরই, তাঁদের পূর্ব-পুরুষ ও নারীদের, তাঁদেরই শ্রমে-মেহনতে গড়া জনপদগুলো, তাঁদেরই রক্তে-ঘামে সিঞ্চিত জমি, দেশটা তাঁদেরই— রাষ্ট্রটি নয়। ওটা ইহুদি-রাষ্ট্র।

      ১৯৪৮-এ দখলদার এই রাষ্ট্রটির জন্মের মুহূর্তে প্যালেস্তিনীয়-আরবদের সাথে যা যা হয়েছে— হুমকি, অবরোধ, বোমাবাজি, ঘরে আগুন দেওয়া, সম্পত্তি ধংস, লুটপাট, বলপূর্বক বসতি উচ্ছেদ, বাড়ি ও মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া, এমনকি ধ্বংসস্তূপেও মাইন বিস্ফোরণ, হত্যা, গণহত্যা— এই সমস্ত কিছুকে একসাথে একটি শব্দে নিজেদের মাতৃভাষায়, আরবিতে, ওঁরা বলেন ‘নাকবা’। ‘নাকবা’ মানে বিপর্যয়।

      এই বিপর্যয়, এই জাতিভিত্তিক সাফাই অভিযান একটি ঘটনা হয়ে থেমে থাকেনি ওখানেই। প্যালেস্তাইনের জন্য এটি এক চলমান প্রক্রিয়া। ১৯৬৭-র আরব-ইহুদি যুদ্ধের শেষে সমগ্র প্যালেস্তাইন দখল, ’৮২-তে ফের বড়ো ধরণের গণ-বিতারণ। প্যালেস্তিনীয় ভূখণ্ডে সামরিক দখল আর প্যালেস্তিনীয় জনগনের জীবনের উপর নিরবিচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ, এক দিনের জন্যেও এতে কোনও ফাঁক পড়েনি কোথাও। ’৯৩ সালের ‘অসলো চুক্তি’তে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী অপসারণ ও প্যালেস্তিনীয়দের স্থানীয় সায়ত্ব শাসনের সুযোগ দেওয়া হলেও জায়নবাদী ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি তো মেলেনি সামান্যও।

      গাজা-য় খাদ্য, বিদ্যুৎ, এমনকি পানীয় জল সরবরাহও নিয়ন্ত্রণ ক’রে ইজরায়েল। এই মুহূর্তে যা চলছে, গত অক্টোবর থেকে, তা তো স্রেফ বোমাবাজি, সামরিক অভিযান, বিমান হামলা নয়। গাজা-য় খাদ্য, বিদ্যুৎ, পানীয় জল সরবরাহও বন্ধ করে রেখেছে ইজরায়েল। মাসের পর মাস। উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। যে-শিশুরা এখনো মরেনি, বারুদের কালো ধোঁয়ায় ঢাকা প্যালেস্তাইনের বাতাসে এখনো শ্বাস নিচ্ছে কোনোমতে, কোনও ত্রাণশিবিরে বা কোনও ধ্বংসস্তূপের পাশেই হয়তো-বা, সেই বাচ্চাগুলো গবাদি পশুর খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছে। পানীয় জলের পাইপে সমুদ্রের নোনা-জল ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে এখনো বেঁচে-থাকা বাচ্চাগুলোকে মারতে আর বোমাও না খরচ করতে হয় কোনও। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে— যতটুকু যে-জল মিলবে, তা-ই পান ক’রে— যাতে তারা সহজেই মরে যেতে পারে। পৃথিবীর কোন্‌ ভাষায়, এরপরও, যুদ্ধ বলে একে?

   যা ঘটছে , তা দখল আর গণহত্যাই। জাতিভিত্তিক সাফাই অভিযান। এথনিক ক্লিঞ্জিং। জায়নবাদীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদ্ধতি এটাই।

     এদেরই ভারতীয় অবতার যারা, সেই হিন্দুত্ববাদীদের খোয়াবটাও তো একই। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের বহুজাতিক এক দেশের বহুত্বের সব রঙ মুছে একটাই খাঁচা নির্মান। একটাই ধর্ম, একটাই মত, একটাই ভাষা, একটাই খাদ্যাভাস, একটাই চাল ও চলন, একটাই তথাকথিত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। ইজরায়েলের ভারতীয় সংস্করণ। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে অনেক অনেক লেঠেল, বল্লমধারী, বন্দুকবাজ। মিলিশিয়া। বেসরকারি সামরিক বাহিনী। জায়নবাদী হাগানা-র মতো হিন্দুত্বের বজরঙ দল। গণপিটুনি, মব লিঞ্চিং। পাড়ায় পাড়ায় ছোটো-খাটো যত আছে বাবরি মসজিদ, ঢিল ছোঁড়া। দাঙ্গার আয়োজন। বুলডোজারে মুসলিম-ঘেটো, দলিত-বসতি গুঁড়িয়ে দেওয়া। ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া। লাশ, সারসার লাশ। তারও পরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে বে-ঘর মানুষগুলোকে বে-নাগরিক বানানোর ক্রোনোলজি। ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী যেমতো, সেমতোই আসমুদ্রহিমাচল ডিটেনশন ক্যাম্প। আদীগন্ত-বিস্তারী এক জেলখানা থেকে দেখা যাবে, অনতিদূরেই, সারা মুখে শিশুরক্ত-নারীরক্ত-নররক্ত মেখে ডিনার শেষে উঠে দাঁড়াচ্ছেন ফ্যুয়েরর। রেটিনা-নাড়িভুড়ি-যৌনাঙ্গে মাখামাখি যেন হিটলার, যেন নেতানিয়াহু, নরেন্দ্র মোদি।            

    ইন্টারনেট-সূত্রে জানা যাচ্ছে, ইজরায়েল আর ভারতের ব্যবধান নাকি ৪৫৩২ কিলোমিটার। তবে তা নেহাতই ভৌগোলিক দূরত্ব। ইতিহাসের হিসেব ভিন্ন, রাজনীতিরও। মোদি-শাহদের জমানায় আমাদের ভারতবর্ষ,  আদতেই, খুব দূরে নেই ইজরায়েলের থেকে। জান-প্রাণ যেটুকু যা শক্তি আছে সব দিয়ে ওদেরকে রুখে দিতে হবেই এবার।

এবার লড়াই, মাননীয় সহনাগরিক, আমাদের স্বদেশের নামে।