৮ ডিসেম্বর, ২০২২- লেননের কণ্ঠকে, জন লেনন কে খুন করার পর অতিবাহিত হয়েছে ৪২ বছর।

আজও জন লেনন কে স্মরণ করতে বসলে স্মৃতির মোড়কে ইতিহাসে ভেসে আসে কীভাবে ষাটের দশকে সংস্কৃতি জগতে আলো জ্বালিয়েছিলো – ” দ্যা বিটলস “।

লেননের গান ইমাজিন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গান হিসাবে ভোট পেয়েছিল। বিশ্বজুড়ে উদারনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী থেকে শুরু করে মার্ক্সবাদীরা নানা সময়ে দাবি করেছেন লেনন আসলে তাদের সমমনস্ক মানুষ। ইতিহাস থেকে তথ্য কি বলছে ?

লেননের ইমাজিন গানের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফ যেখানে উদার বিশ্বায়নের স্বপ্ন কে তুলে ধরেছে – “Imagine there’s no country. It isn’t hard to do Nothing to kill or die for, And no religion too…”

ঠিক সেখানেই মার্ক্সবাদীরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ইমাজিন গানের শেষ অংশে – “Imagine no possessions I wonder if you can No need for greed or hunger A brotherhood of man…”

লেনন নিজেই বলেছিলেন তাঁর গানের শেষ স্তবক উঠে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো থেকে। তাঁর মুখে যেমন প্রায়ই উঠে আসতো বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদীদের বিরোধীতা, একই সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধীতা তাঁকে বামপন্থীদের মধ্যে নায়ক করে তোলে।  সিআইএ, লেননের এই তৎকালীন সক্রিয়তার জন্য সর্বতভাবে চেষ্টা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁকে নির্বাসন দেওয়ার জন্য। তবে তারা সফল হয়নি।

এফবিআই-এর একটি সার্ভিলিয়েন্স রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে জন লেনন তারিক আলীর মার্ক্সবাদী গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং পরবর্তীতে তারিক আলী নিজেই এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের মার্ক্সবাদী ক্লাইডসাইড কর্মীরা যখন “ওয়ার্ক-ইন” করতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি তাদের পাঁচ হাজার পাউন্ডের একটি চেক পাঠান অর্থসাহায্য স্বরূপ।

১৯৬৯ সালে লন্ডনের একটি ৱ্যাডিক্যাল আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ” রেড মোল “-এর তরফ থেকে জন লেননের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়।  সেখানে লেনন বলেন – ” আমি নিজে হয়তো কমিউনিস্ট নই, তবে আমি কার্ল মার্ক্স, লেনিনের লেখা পড়েছি। আমার চেয়ে কমিউনিজমের প্রশংসাকারী হয়তো আর কেউ নেই। তাই নিজে থেকে আমি শান্তি আন্দোলনে যোগ দিয়েছি।

আমি মনে করি এই পৃথিবীতে বিপ্লব ও একটি বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে “

লেননের গান “Power To The People”, “Revolution” যেখানে তিনি লিখেছেন – “You say you want a revolution/Well, you know/ We all want to change the world…” এর মধ্যে দিয়েই জন লেননের রাজনৈতিক ভাবনার অনেকখানি বহিঃপ্রকাশ হয়।

বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক ক্ষুদ্র উদাহরণ তৈরি করতে চেয়েছিল জন লেননের গানের ব্যান্ড ” দ্যা বিটলস “-ও। ষাটের দশকে ব্রিটেনে করের হার ছিল অতন্ত্য বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি।  তাই তৎকালীন বিটলস ম্যানেজার মিস্টার এপস্টেইন একটি কর্পোরেট ট্যাক্স আশ্রয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। সংগীত, চলচ্চিত্র, ইলেকট্রনিক্স ইত্যাদির জন্য সহায়ক সংস্থাগুলিকে একত্রিত করে তিনি একটি কম্পানি Apple Corps এর কথা ভাবেন। তবে সেই কম্পানি গড়ে ওঠার আগেই মৃত্যু হয় বিটলস ম্যানেজার এপস্টেইনের। তবে ভাবনা টি থেমে থাকেনি। ১৯৬৮ সালে আত্মপ্রকাশ হয় Apple Corps এর।

Apple Corps এর তরফ থেকে বিটলস জানায় তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে অর্থ মজুত আছে, যা দিয়ে তারা মানবতার স্বার্থে কাজ করতে চায়। Apple Corps কখনই মুনাফা-সর্বোচ্চকারী হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবে না, তারা সকল রকম উদ্ভাবনী মানুষদের নানা সৃজনশীল কার্যকলাপে অর্থায়ন করবে। লেননের বন্ধু ও বিটলসের সদস্য পল ম্যাককার্টনি একে “এক ধরনের “পশ্চিমী কমিউনিজম” বলে অভিহিত করেন।

তবে বেশিদিন দীর্ঘায়িত হয়নি এই প্রকল্প। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল ভাবে অর্থের ব্যবহার ও একটা সময় পর নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যের জন্য ১৯৭০ নাগাদ ভেঙে যায় জন লেননের গানের ব্যান্ড দ্যা বিটলস।

আর ঠিক এর পরেই জন লেনন যখন একা গান লেখা থেকে একক উপস্থাপনায় মন দেন তখনই তাঁর কাছ থেকে পৃথিবী উপহার পায় “ইমাজিন”, “ওয়ার্কিং ক্লাস হিরো”, “পাওয়ার টু দ্যা পিপলের” মত গান ।

জন্মভূমি লিভারপুলকে ভালোবেসেও উচ্চ কর এড়াতে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড পেয়েও বেশি দিন দীর্ঘায়িত হল না লেননের গল্প।

৮ ডিসেম্বর, ১৯৮০ মানসিক বিকারগ্রস্ত বন্দুকবাজ মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যানের বন্দুকের গুলিতে থেমে যায় লেননের হৃদস্পন্দন।

জন লেনন রাজনৈতিক ভাবে “নিরপেক্ষ” ছিলেন না – পক্ষ ছিল তাঁর কণ্ঠে।

তিনি একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে কোনও দেশ নেই, যেখানে কোনও হত্যা নেই, যেখানে কোনও ধর্মও নেই ;

কী ভাবছেন ? অসম্ভব ?

হয়তো – কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে স্বপ্নরা তো বারবারই অসম্ভবের বেড়াজালকে ভেঙেই দৃষ্টান্ত তৈরী করে গেছে।  তাই না ?