১৮ই আগষ্ট পতাকা, শ্লোগান ছাড়া হাজার খানেক সংখ‍্যার নাগরিক মিছিল সুকান্ত সেতু থেকে ধীরে ধীরে যাদবপুর এইট বি বাস টারমিনাসের কাছে পৌঁছনোর পরেই মিছিলের সামনে অধ‍্যাপিকা মালিনী ভট্টাচার্য,অধ‍্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র অধ‍্যাপিকা নন্দিনী মুখার্জীকে দেখার পরেই গেরুয়া পতাকা নিয়ে জনা পনেরো বিজেপি সমর্থক চিৎকার করে বিদ্রূপাত্মক শ্লোগান দিচ্ছিল। অথচ পাল্টা শ্লোগান উঠল না নাগরিক মিছিল থেকে, শুধু মাইক লাগানো কয়েকটি অটো থেকে স্বপ্নদীপের হত‍্যাকারীদের শাস্তির দাবি এবং র‍্যাগিংমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দাবির ঘোষণা করা হচ্ছিল। যাদবপুর থানার সামনে তখন একই দাবিতে এস এফ আই ছাত্রছাত্রীদের শ্লোগান চলছিল। অথচ সেদিন রাতের টিভি চ‍্যানেল এবং পরের দিনের খবরের কাগজে র‍্যাগিংমুক্ত ক‍্যাম্পাসের দাবির এই যৌথ জমায়েতের খবরের পর্যালোচনা উঠে আসেনি।

অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল আগেরদিন বিজেপির প্ররোচনামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচির খবর। রূপান্তরকামী এক ছাত্রকে এভিবিপির বেধড়ক মারধরের খবরের থেকে গুরুত্ব পেয়েছে স্বপ্নদীপের খুনের প্রতিবাদের নামে তৃণমূল ছাত্রপরিষদের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক‍্যাম্পাস দখল করার খবর। তৃণমূল ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে থাকবেন সহ উপাচার্যকে আঙুল উঁচিয়ে ধমক দেওয়া রিসার্চ স্কলার এবং একুশে জুলাই মমতার মঞ্চ মাতিয়ে দেওয়া ছাত্রনেত্রী। অথচ বার বার যে ছাত্র সংগঠন র‍্যাগিং বিরোধী মিছিলে আক্রমণ করে,র‍্যাগিংয়ের অপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ডাকা সভা শুরু আগেই চড়াও হয়ে মারপিট শুরু করে-তারা শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ চায় এই দাবি নিতান্তই হাস্যকর। বস্তুত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংয়ে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার সুযোগ নিয়ে গত ১৪ ই আগষ্ট মুখ‍্যমন্ত্রী প্রকাশ‍্য সভায় সিপিআই(এম) তথা এস এফ আইয়ের ঘাড়ে দোষ চাপানোর পরেই তৃণমূল ছাত্রপরিষদ পরিকল্পিতভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ‍্যন্তরে বামপন্থী আন্দোলনকে শেষ করার জন‍্য সংঘাতের রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রছাত্রীরা সেই চেষ্টা যে ব‍্যর্থ করবেন তা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে যাঁরা চেনেন তাঁরা বুঝতে পারবেন। যদিও ১৬ ই আগষ্ট যাদবপুর ক‍্যাম্পাসে তৃণমূল ছাত্রপরিষদের হামলার দোষ ঢাকবার উদ্দেশ্যে বাজারি মিডিয়া এস এফ আই নেত্রী আফরিন রহমানের ওপর আক্রমণের সংবাদ গোপন করে একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে মমতা অভিষেকের বন্দনা করে হাততালি কুড়ানো ছাত্রনেত্রীকে নিয়ে ব‍্যস্ত রইল বেশি। সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বহুদিন যাবৎ আর এস এস সহ দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যস্থল হিসাবে চিহ্নিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক‍্যাম্পাসে ঢোকার জন‍্য সুযোগ খুঁজছিল বলেই যাদবপুরের ছাত্রী সোনারপুরের রাজন‍্যা হালদারকে মিডিয়ার সামনে তুলে আনার পর র‍্যাগিংয়ে ছাত্রমৃত‍্যুর ঘটনার পূর্ণ সদ্ব‍্যবহার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

তৃণমূল ও বিজেপি নেতা নেত্রীদের পর পর বিবৃতি দেখে শুনে মনে হচ্ছে র‍্যাগিংয়ে মৃত ছাত্রটির পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানানো বা অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে সোচ্চার হওয়ার চাইতেও তাঁরা এস এফ আইয়ের ঘাড়ে যেন তেন প্রকারে দোষ চাপাতে বেশি আগ্রহী। কেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী দক্ষিণপন্থী ছাত্ররাজনীতির বদলে বামপন্থার দিকেই বেশি আগ্রহ দেখান সেই রাগেই এই পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে শুধুমাত্র নেশা ভাঙ আর র‍্যাগিংয়ের আখড়া হিসাবে প্রচার করার রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেন মমতা ব‍্যানার্জী ব্রাত‍্য বসু থেকে সুকান্ত মজুমদার পর্যন্ত।র‍্যাগিংকে অপরাধ হিসাবে প্রকাশ‍্যে ঘোষণা করা এবং মাদক বিরোধী আন্দোলনকে অন‍্যতম রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করার কারণে বহুযুগ ধরেই রাজ‍্যের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ইউনিয়নে এস এফ আই খুব বেশি সমর্থন পেত না। যাদবপুরেও তার ব‍্যতিক্রম ঘটত না। আবার যাদবপুরে ডি এস এফ নিজেদের বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বললেও তারা পশ্চিমবঙ্গের ২০১১ ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে সর্বাত্মক প্রচার করেছিল। অভিজ্ঞজন বলেন পুলিশি ও গুণ্ডাদের হাতে নিগৃহীত বা আক্রান্ত হলে ডিএসএফ নির্দ্বিধায় এস এফ আইএর সাংগঠনিক সাহায্য নিয়েছে আবার প্রয়োজনে প্রত‍্যক্ষভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচার করতেও তাদের বাছাই করা নেতা নেত্রীরা দ্বিধা করেন না। পাশ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্রের দায়িত্বও কয়েকজন ডিএসএফ নেতা পালন করেছেন।ফ‍্যাস ও ডব্লিউ টি আইয়ের অবশ‍্য এস এফ আই বিরোধিতায় কোন খাদ নেই।

ক‍্যাম্পাসের বাইরে কিছুদিন আগে পর্যন্ত তারা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক হিসাবে রাজনৈতিক প্রচারে ছিল। তথাকথিত স্বাধীন ছাত্রসংগঠনগুলির এই সুবিধাবাদী অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে,উচ্ছৃঙ্খলতা, মাদক ব‍্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে, এবিভিপি এবং টিএমসিপির সরাসরি প্রভাব যাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের ওপর না পড়ে তার জন‍্য অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী এককাট্টা থাকেন। গত ১৬ ই আগষ্ট বিকেলে অরবিন্দ ভবনের সামনেও সেই ছবিই দেখা গেছে।কিন্তু এই পরস্পরবিরোধী বৈচিত্র্যের মধ‍্যেও হস্টেলের নিয়ন্ত্রণ রাখার জন‍্য কালেক্টিভ নামক সংগঠনের নেতাদের কয়েকজন শাসকদলের সঙ্গে ব‍্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ রেখে চলে। প্রাক্তন ছাত্রদের হস্টেলে থেকে যাওয়া হস্টেলের র‍্যাগিং এর বাড়াবাড়ি প্রশ্রয় পেয়ে যায় তাদেরই বদান‍্যতায়। অনেকেই বলছেন র‍্যাগিংয়ের ঘটনায় একটি ছাত্রের মৃত্যু না ঘটলে এই যোগসাজশ সামনে আসত না। এই লেখার সময় পর্যন্ত অন‍্যতম অভিযুক্ত যাদবপুরের যে প্রাক্তনী নিরুদ্দেশ সেই অরিত্র মজুমদার ওরফে আলু টালিগঞ্জের এক তৃণমূল নেতার স্নেহধন্য। বস্তুত র‍্যাগিংয়ের ফলে গত ১০ ই আগষ্ট রাণাঘাটের বাসিন্দা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যু না হলে মেইন হস্টেলের অনেক তথ‍্যই সামনে আসত না। যেমন অভিযুক্তদের মধ‍্যে প্রেথম গ্রেপ্তার হওয়া যাদবপুরের প্রাক্তনী সৌরভ চৌধুরীর রাজনৈতিক পরিচয় না জানা গেলে তাকে এস এফ আই বলেই প্রচার করা হতো। অথচ সৌরভ এবং গ্রেফতার হওয়া আরেক অভিযুক্ত প্রাক্তনী সুমন কাঞ্জিলাল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের পক্ষ থেকে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেউচাপাঁচামিতে খনি এলাকায় মানুষ কে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে বোঝাতে গিয়েছিলেন।