জ্যোতি বসু সমগ্র বাংলায় অতি পরিচিত নাম, পরিচিতি সমগ্র উপমহাদেশে এবং দেশের সীমানা পেরিয়েও তাঁর পরিচিতি নগন্য নয়। তিনি ছিলেন রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের অর্ধেক সময় তিনিই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাছাড়াও ১৯৫০ ও ৬০ এর দশকে বাংলায় বিরোধী দলের নেতৃত্বের সফল ভূমিকায় ছিলেন জ্যোতি বসু। তার এই অবস্থান বহুল প্রচারিত এবং বহুল চর্চিত বিষয়। কিন্তু তার বহুল প্রচারিত এই সফল ভূমিকার ভিত্তিভূমি সম্পর্কে অনেকেই তেমন ওয়াকিবহাল নন। হয়ত বা এ বিষয় অনেকে তেমন গুরুত্ব দিতেই তেমন আগ্রহী নন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতি ছাত্র জ্যোতি বসু লন্ডনে পারি দিলেন ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য বাস্তবে ফিরে এলেন কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু। লন্ডনে বাংলা তথা ভারতের কমিউনিস্টদের সাথে যুক্ত হলেন, যুক্ত হলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে। ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু যখন কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু হয়ে দেশে ফিরে আসেন, নিজের জীবনের ভবিষ্যৎ গতিপথ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শ কার্যকর করার দায়বদ্ধতা তিনি গ্রহণ করেছেন। বিপুল স্বাচ্ছন্দের জীবনযাত্রা থেকে প্রতিকূল অনিশ্চিত পরিবেশ মোকাবিলার কল্পনাতীত সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন আদর্শগত দায়বদ্ধতার কারণে। এই পর্বে যে সমস্ত যুবক কমিউনিস্ট আন্দোলনে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তারা প্রথমেই শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। সদ্য ইংল্যান্ড ফেরত জ্যোতি বসু হয়ত বা সেখানকার শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতার এই ফ্রন্টে যুক্ত হলেন।

কৃতি ছাত্র এবং নিশিকান্ত বসুর পুত্র জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট মতবাদ গ্রহণ করা যথেষ্ট বিষ্ময়কর ঘটনা। বিষ্ময়ের এখানেই শেষ নয়। সুখ-স্বচ্ছন্দের জীবনকে হেলায় সরিয়ে রেখে সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই বিপদসঙ্কুল জীবন প্রবাহে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাসিয়ে দেওয়া আরো বিষ্ময়কর। তত্ত্বগতভাবে সমৃদ্ধ এবং শ্রমিক সংগ্রামের ময়দানকে তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ। দেশে ফেরার আগেই তার সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত। তাই ৪২ সনে ফিরে ব্যারিস্টারের কালো পোশাক গায়ে চাপল না। ধুতি পাঞ্জাবীর সাজে সামিল হলেন এখানকার শ্রমিক আন্দোলনে। পার্টির সিদ্ধান্তে প্রথমে কিছুদিন বন্দর শ্রমিকদের সংগঠিত করার উদ্যোগে সামিল হলেন। কিছুদিনের মধ্যে তেমন সাফল্য এখানে মেলেনি। ইতি মধ্যে পার্টি বৃহত্তর প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। তাঁকে যুক্ত করা হয় রেল শ্রমিক ইউনিয়নে। দেশের রেল শ্রমিক সংগঠনই ছিল তখন সর্ব বৃহৎ। সেই সংগঠনেই তিনি যুক্ত হলেন। রেল শ্রমিকদের সংগঠন গড়ায় যথেষ্ট অসুবিধা ছিল। অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন হুমায়ুন কবীর। সে অবস্থাতেই সংগঠনের অগ্রগতি ঘটাতে থাকে। বি.এন রেলের শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি নিত্যানন্দ চৌধুরী এবং সম্পাদক হন কমরেড জ্যোতি বসু। এরপরে যুক্ত হন বি.ডি রেলেও। কিছু সময় পর উভয় সংগঠন একত্রিত হয়। যুক্ত সংগঠনের সভাপতি এবং সম্পাদক হন যথাক্রমে মহম্মদ ইসমাইল এবং জ্যোতি বসু। রেল শ্রমিকদের বৃহৎ সংগঠনের পরিচালনার সাথে তিনি ক্রমশ আরও কয়েকটি সংগঠন পরিচালনার কাজও করেছেন, সে সময় রেল শ্রমিক সংগঠন তার বিস্তৃতি এবং গুরুত্বের দিক থেকে ছিল অগ্রণী। তিনি অসম ও উত্তর পূর্বাঞ্চলসহ সমগ্র পূর্ব ভারতে রেল শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। এ পর্যায়ে সর্বভারতীয় স্তরে রেল শ্রমিক নেতৃত্ব ছিল সংস্কারবাদী। তাী বিরুদ্ধে আবশ্যিক ভাবেই নিয়ত লড়াই করতে হত। এই সংগঠনকে সর্বভারতীয় ফেডারেশন স্বীকৃতি দিতে চায়নি। অনেক লড়াই করেই স্বীকৃতি আদায় করতে হয়।

রেল কর্তৃপক্ষও এই ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে যথেষ্ট অসুবিধাজনক অবস্থায় কাজ করতে হয়েছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর মিলল কর্তৃপক্ষের, স্বীকৃতি। অনেক কাজই তখন সহজসাধ্য হয় এবং শ্রমিকদের কাছেও আরও বাড়তি গুরুত্ব অর্জন করে। কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের স্বীকৃতি আদায় সম্ভব হয়েছে লাগাতার শ্রমিকদের লড়াই পরিচালনার মাধ্যমেই।

১৯৪৬ সনে এলো প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন। সীমাবদ্ধ ভোটদাতাদের নিয়েই এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রেল শ্রমিকদেী মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক সংগঠকই কাজ করতেন। রেল শ্রমিক নির্বাচন কেন্দ্রে প্রার্থী করা হলো জ্যোতি বসুকে। যথারীতি তিনি শ্রমিকদের ভোটে জয়ী হলেন। এই নির্বাচনেই চা-শ্রমিক কেন্দ্রে দার্জিলিং থেকে রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং কৃষক কেন্দ্র দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত হলেন রূপনারায়ণ রায়।

এই নির্বাচনের দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হবে। কাঁচরাপাড়া রেল ওয়ার্কশপ বিপুল সংখ্যক রেল শ্রমিকের কর্মস্থল। এখানে ভোটার সংখ্যাও বিপুল। নির্বাচনের সময় পার হয়েছে শোনা গেলো, কিন্তু শোনা গেলো, দু’জন পার্টি কর্মীকে বিরোধী পক্ষ আটক করেছে। নির্বাচন শেষে তাদের ওপর আক্রমণ অনিবার্য। নির্বাচন শেষ হওয়ার ফলে বিভিন্ন ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করেছে। এ অবস্থায় সহকর্মীদের কি করে উদ্ধার করা সম্ভব! এমন সময়ে দপ্তরে এলেন জ্যোতি বসু। উপস্থিত ৪/৫ জন কমরেডদেী নিয়ে চললেন সহকর্মীদের উদ্ধারের জন্য। কমরেডদের চোখে বিষ্ময়! কিন্তু সেদিন ঘোর কাটার আগেই জ্যোতি বসুর, নেতৃত্বে আটক কমরেডদের নিয়ে নিরাপদেই সকলে স্থান ত্যাগ করলেন। সীমাহীন সাহস ও আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে উপস্থিত বুদ্ধি এবং কৌশলের দ্বারাই সম্ভব হলো অসাধ্য সাধন। কয়েকশত উত্তেজিত জনতার আক্রমণ থেকে সহকর্মীদের উদ্ধার করে আনা সম্ভব হলো। জ্যোতি বসু তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাহসের সাথে উপযুক্ত কৌশল প্রয়োগ করে বহু সংকটকে তিনি সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। সংগঠনকে রক্ষা করেছেন প্রচন্ড বিপদের থেকে।

৪৬’ এ আইন সভার সদস্যের দায়িত্ব চাপল। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং প্রত্যক্ষ সম্পর্কই তার বজায় ছিল। তাছাড়া আইনসভার সদস্য হিসাবে বর্দ্ধিত ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন। একথা যেমন সঠিক, তেমনই বাস্তবতা ছিল শ্রমিক, কৃষকসহ সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের পাশে — কার্যত গণ আন্দোলনের সার্বিক নেতৃত্বের ভূমিকাই ক্রমশ তার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি শুধু শ্রমিকের নেতা নন, তিনি সামগ্রিক গণ সংগ্রামের নেতা। বিশেষভাবে ৫২’ সনের প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকেই তিনি রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলের নেতা। শ্রমিক ছাড়াও কৃষক, শিক্ষক, ছাত্র–যুব সহ সমস্ত অংশের সংগ্রামের সামনে দাঁড়িছেন জ্যোতি বসু। তাই যেকোনো আন্দোলনের সময়ই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৯৫৯ সনের খাদ্যও মূল্যবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের প্রাককালে সমস্ত বামপন্থী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। জ্যোতি বসুকে গ্রেপ্তার করতে তার বাড়ি এবং পার্টি দপ্তরে পুলিশ হানা দেয়। ঘটনাক্রমে উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনও এক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য তিনি সেদিন অসমে ছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে কলকাতার পুলিশের উদ্যোগ সম্পর্কে সাংবাদিকরা তার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়। জ্যোতি বসুর উত্তর ছিল— ‘ আমি বলব, খাদ্য চোরেদের রক্ষক মন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে গ্রেপ্তার, করা হোক, ‘ আমাকে কেনো গ্রেপ্তার করা হবে?’ রাষ্ট্রের শত্রুতামূল আচরণের বিরুদ্ধে এমন ভূমিকাতেই ছিলেন জ্যোতি বসু।

জীবনের শেষ পযার্য়েও তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ৭০’ সনে সি. আই. টি. ইউ এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি ছিলেন সহ সভাপতি। বাস্তবে ৫০’ দশক থেকে শ্রমিক নেতা জ্যোতি বসু হলেন সমগ্র রাজ্যের তথা দেশের গণ আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা। সে পরিচিতি বাস্তবে সামনে এসে যায়। তবে তার এই অবস্থানের মূল ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছিলো শ্রমিক আন্দোলনের কষ্টসাধ্য ভূমিকা পালনের মধ্যে দিয়ে। গ্রহণ করার অসাধারণ ক্ষমতা বলে তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন শ্রমিক আন্দোলনে। সে অভিজ্ঞতা এবং প্রতিদিনের ঘটনাবলী অভিজ্ঞতার ঝাঁপিতে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান যুগে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকা শুধু শ্রমিকদের জন্য নয়। সমাজের সমস্ত নির্যাতিত মানুষের দুঃখ যন্ত্রণার পাশে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থান জরুরী। ব্যক্তি নেতা হিসাবে জ্যোতি বসুর সাফল্য এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রমী।