আজ জ্যোতি বসুর জন্মদিন। কিন্তু আলোচনার মুখবন্ধে তাঁর মৃত্যুদিনের একটি প্রতিক্রিয়া রইলো। সেদিন, ২০১০-র ১৭ জানুয়ারি কমরেড জ্যোতি বসু সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রকাশ কারাত বলেছিলেন,‘‘He leaves us bereft-because there will be none like JB again.”
কমরেড জ্যোতি বসু অনন্য।


কারন — ১৯৪৬-র ১৯ সেপ্টেম্বর, ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে যিনি অবিভক্ত বাংলার বিধানসভায় মুসলিম লীগ, কংগ্রেস আর সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করছেন, সেই তিনি ২০১০-এ মৃত্যুর আগের দিনগুলিতেই মানুষের কাছে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। আজকের পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণিয় তাঁর ১৯৯৮ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া,‘তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অপরাধ ওরা রাজ্যে বিজেপি-কে ডেকে এনেছে।’


তাঁর জীবন আসলে একটি ওয়ার্কশপ — সঙ্কটের মধ্যে স্থৈর্য, তিনি শেখাচ্ছেন। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষাগ্রহণের কোনও বিকল্প নেই — তিনি শেখাচ্ছেন। তিনি শেখাচ্ছেন — বাস্তববোধ থাকা জরুরী, তবে তা মতাদর্শ সম্মত হতেই হবে। আর শেষপর্যন্ত? শেষ কথার রচয়িতা — মানুষ। ‘‘তাঁরা কখনও ভুল করেন। আবার ভুল থেকে শিক্ষা নেন। শেষ পর্যন্ত মানুষ, মানুষই ইতিহাস রচনা করেন।’’
অনেকের কাছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি ১৯৭৭ থেকে ২০০০ — তেইশ বছরের মুখ্যমন্ত্রী। যাঁরা প্রবীণ, তাঁরা অনেকে দু’দফার যুক্তফ্রন্ট সরকার দেখেছেন। তাঁরা সেই সরকারে কমরেড জ্যোতি বসুর ভূমিকার সাক্ষী। কিন্তু সেখানেও ‘জ্যোতি বসু’-র আকাশ সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৭২ — মাঝের যুক্তফ্রন্টের পর্যায়টুকু বাদ দিলে তিনিই বিরোধী পক্ষের প্রধান কন্ঠস্বর। সেই তিনিই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১ — পশ্চিমবঙ্গে অবিবক্ত কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক, বিধানসভায় বিরোধী নেতা।
১৯৪৬। ১৯ সেপ্টেম্বর।


বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল তৎকালীন কংগ্রেস। রাজপথে তখন রক্তাক্ত। দাঙ্গায় বিধ্বস্ত কলকাতা। বিধানসভায় সেই অনাস্থা প্রস্তাবে কোনও পক্ষেই ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সিপিআই-র। জ্যোতি বসু আলোচনা করেছিলেন অনাস্থা প্রস্তাবের উপর। দীর্ঘ আলোচনাটির পূর্ণ উল্লেখ এখানে সম্ভব নয়। উদ্ভুত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্য মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস, দু’পক্ষকেই প্রবল সমালোচনা করলেন তিনি। মারাত্মক আক্রমন করলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে। শেষে জ্যোতি বসু বললেন,‘‘আমরা হিন্দু, মুসলমান সকল সাধারন মানুষের কাছে তাদের সকল শক্তি সংগঠিত করতে আবেদন করছি। যাতে তারা বারম্বার না পারস্পরিক খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভেঙে যায়, মজুরি বৃদ্ধির এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতির লড়াই ভেঙে পড়ে, আর ইউরোপীয় অশুভ শাসন শক্তিশালী হয়।’’
দাঙ্গা এবং তার পিছনে থাকা শাসকের রাজনীতি সম্পর্কে স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর — ১৯৪৬-এ, ১৯৯২-এ। তারপরও।


একদিকে গনআন্দোলন, আর একদিকে সংসদীয় ক্ষেত্রে মানুষের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠা — এই বিস্তীর্ণ সময়কালে কমিউনিস্ট পার্টিকে বারবার দুই দুনিয়ার মেলবন্ধনের পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে। সেই অগ্নিপরীক্ষার ময়দানে কমরেড জ্যোতি বসুই ছিলেন সেনাপতি।


অতি সংক্ষেপে এটিই তিনি।
একজন মার্কসবাদী হিসাবে এই পথকে তিনিই ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সংসসীয় রাজনীতি, একটি রাজ্যে সরকার পরিচালনায় পার্টি — এই প্রসঙ্গে আলোচনা, পর্যাচলনা, বিতর্ক চলেছে। একটি গতিশীল পার্টিতে বিজ্ঞানের নিয়মে যা স্বাভাবিক। কমরেড জ্যোতি বসু এই প্রসঙ্গটিকে কিভাবে দেখেছেন? একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।


‘‘আমরা এই রাজ্য সরকারকে এবং সরকারে আমাদের ভূমিকাকে একটি পরীক্ষামূলক বিষয়, মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ বলে মনে করি।’’ জ্যোতি বসু বলেছিলেন ১৯৮৩-র ২ অক্টোবর, এক আলোচনা সভায়। আলোচনার বিষয় ছিল — ‘মার্কসবাদ ও আমাদের অনুশীলনের প্রাসঙ্গিকতা।’ দীর্ঘ আলোচনায় মার্কসবাদের প্রয়োগের বিষয়ে নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেছিলেন তিনি। অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনার প্রসঙ্গে তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন,‘‘অন্যান্য সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো আমরা এই সরকার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছি। জনসাধারনকে সকল সমস্যা এবং বর্তমান পর্যায়ে আমাদের সংগ্রামের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে শিক্ষিত করে আমরা নিজেদের শিক্ষিত করে তুলছি। আমরা কখনও মনে করি না, এই রাজ্য সরকারই আমাদের সমস্ত লক্ষ্য এবং সংগ্রামের শেষ কথা।’’


আমরা তাহলে কী মনে করি? জ্যোতি বসুর শিক্ষা,‘‘আমরা এই সরকারকে অগ্রগতির একটা হাতিয়ার, সংগ্রামের একটা ধাপ হিসাবে মনে করি।’’
উদ্ভুত পরিস্থিতিকে যতদূর সম্ভব মানুষের স্বার্থ ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ‘বামফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার’ — ১৯৭৭-র এই লক্ষ্যকে অক্ষুন্ন রাখা হবেই।
মানুষ আর পার্টির সম্পর্ক কী? কমরেড জ্যোতি বসুর কথায়, ‘‘জনগনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কর্মসূচী রূপায়ণ ছাড়া সংগ্রাম ছাড়া শুধু বক্তৃতা দিয়ে, মাঝে মাঝে সম্মেলন করে আর প্রস্তাব পাঠ করে আমাদের যা করণীয় কাজ তা আমরা করতে পারবো না। প্রতিটি কাজে মানুষকে যুক্ত করতে হবে এবং তাদের পরামর্শ নিতে হবে। আমরা কোন কাজ করতে পারছি না, সীমাবদ্ধতা কোথায় এটা মানুষকে বোঝাতে হবে।’’
২০০৬-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোট প্রবন্ধ ‘ঐতিহ্য অম্লান রাখতে হবে।’ সেখানে বসু লেখেন,‘‘আমাদের পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধিতা করে। আবার রাজ্য সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সেই নীতির পরিধির মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। এই অবস্থার মধ্যে জনসাধারনের স্বার্থকে রক্ষা করেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এটাই আমাদের বিকল্প পথ।’’


তাহলে কী দাঁড়ালো?
‘বিকল্প’ একটি নীতিগত অবস্থান। কঠিন, প্রতিকূল সময়েও সিপিআই (এম)-র সরকার পরিচালনা, বিকল্প হাজির করা একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত।
আর মানুষের ভূমিকা? কমরেড জ্যোতি বসুর কথায়,‘‘একাজে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। সর্বশিক্ষা, সর্বস্বাস্থ্য, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, গ্রামোন্নয়ন সর্বক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা হলো যেখানে গণ-উদ্যোগ তৈরি হয়েছে সেখানে সাফল্য এসেছে। যেখানে তা হয়নি সেখানে যতটা সাফল্য আসা উচিত ছিল, আসেনি।’’


কিন্তু সব সিদ্ধান্তের প্রয়োগে সাফল্য নির্ভর করছে গণ-উদ্যোগ, মানুষের অংশগ্রহণের উপর।