শুধু বর্ধমানের মানুষ নয়, এখানকার রাজ পরিবারের কথা অনেকেরই কম বেশী জানা। বলতে গেলে, তখনকার বাংলাদেশ এর অন্যতম জমিদার পরিবার। সত্যি কথা বলতে কি, ইংরেজ আমলে বাংলার প্রথম শ্রেণীর জমিদার, অর্থ খ্যাতি সন্মান আর প্রতিপত্তির দিক দিয়ে ! কিন্তু, কালের চাকা, কোন রশিতেই থামান যায়না! দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে তা গড়িয়েছে, ক্ষয়ের ঢালু পথে ! তাই, আগের জৌলুশ আজ আর নেই।

লোকের মুখে রয়ে গিয়েছে শুধু অতীত গৌরবের কিছু গল্প! কিন্তু, এই রাজ পরিবার এল কোথা থেকে ! তাঁরা তো বাঙ্গালী নন ! 
     সত্যিই তাই ! আদতে, তো তাঁরা পাঞ্জাবের, কোটলি অঞ্চলের মানুষ! ক্ষেত্ৰী কাপুর পরিবারের! পনের শতকের একেবারে, প্রথম দিকের কথা। দিল্লীর সিংহাসনে তখন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। মাত্র কয়েক বছর আগেই বসেছেন সিংহাসনে। বর্ধমানের জাগিরদার তখনও শের আফগান। সঙ্গম রাই, কাপুর পরিবারের এক সদস্য, এক সন্ধ্যায়, ফিরছেন পুরী থেকে। হয়ে গিয়েছে রাত। রাস্তা ঘাটের অবস্থাও ভাল নয়! তাই, সেই রাতের মত আশ্রয় নিলেন বৈকুণ্ঠপুর গ্রামে। আজকের বর্ধমান শহরের কাছেই। সকালে গ্রামটি দেখে ভারী ভাল লেগে গেল সঙ্গম রাইর! ঠিক করলেন, আর দেশে ফিরবেন না! এখানেই, নতুন করে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করবেন! বলতে গেলে, জাঁকিয়ে বসলেন একেবারে!শুরু করলেন, ব্যবসা আর সুদের কারবার! এমনকি লাঠালাঠিও বাঁধল জাগিরদারের সঙ্গে! যুদ্ধে হেরে গেলেন শের আফগান! মুঘল জাগিরদার শের আফগান যুদ্ধে পরাস্ত, সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারী খুশী এই খবরে! ১৬১০ সালে,তাই পুরষ্কারও দিলেন এই জয়ের জন্য! সঙ্গম রাইকে খেতাব দিলেন ‘চার হাজারী কোতোয়াল’ আর ‘মুনসিফদার’! বর্ধমান রাজ পরিবারের ভিতের প্রথম ইট,সঙ্গম রাই। 

             
      বংশের অষ্টম পুরুষ তিলক চাঁদ রাই পেলেন ‘মহারাজ অধিরাজ বাহাদুর’ খেতাব আর পাঁচ হাজারী মনসবদারী, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৭৬০ সালে। মুঘল সম্রাট আহমদ শাহ ফরমান দিয়ে জারি করলেন এই খেতাব!            
       মহারাজ তিলক চাঁদ এর প্ৰপৌত্র মহারাজ আফতাব চাঁদ এর কোন পুত্র ছিলনা! তাই, তাঁর বিধবা রানী দত্তক নিলেন, মহতাব চাঁদ বাহাদুর এর আত্মীয় বন বেহারি কাপুরের ছেলে বিজয়কে। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হলেন মহারাজ বিজয় চাঁদ মহতাব নামে।।  
        আমাদের গল্প তাঁকে নিয়েই। তাঁর ঘড়ি প্রেমের কাহিনী, বর্ধমানের কারুর অজানা নয়! রাজবাড়ির আনাচে-কানাচে তিনি শখ করে অসংখ্য দেশী-বিদেশী ঘড়ি লাগিয়েছিলেন। তার মধ্যে আঞ্জুমান কাছারির ছাদে যে চার মুখের ঘড়িটি বসিয়ে ছিলেন, তা ছিল সবথেকে জনপ্রিয় ।
     এই বেনসন টাওয়ার ক্লক এর মিষ্টি ঘন্টার শব্দে একসময় বর্ধমানবাসীর ঘুম ভাঙ্গত! ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে কাজে যাওয়া, বিশ্রাম নেওয়া কিংবা আবার রাতে ঘুমোতে যাওয়া, সবই ঠিক হত এই ঘড়ির ঘণ্টা ধ্বনির সঙ্গে! ঘড়িটি এমন জ্যামিতিক কোণে লাগানো হয়েছিল যে কার্জেন গেটের সামনে থেকেও ঘড়ি দেখতে কারুর অসুবিধা হত না । এহেন গুরুত্বপূর্ণ ঘড়ি, ১৯৩২ সালে অচল হয়ে গেল হঠাৎ ! ঘড়ির সঙ্গে সঙ্গে বর্ধমান বাসীর সময়জ্ঞানও গেল অচল হয়ে! মহারাজেরও ভারী মন খারাপ! ঘড়িটির চুপ করে যাওয়া তাঁকে যেন কুরে কুরে খেতে লাগলো! ঘড়িটি মেরামত করার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন সুইজারল্যান্ড এর বিখ্যাত ঘড়ি কোম্পানি “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানির কলকাতার অফিসে।         

কোম্পানির মেকানিক হিসাবে রাজবাড়িতে ঘড়ি সারাতে এলেন তাহের মিঁয়া। পুরো নাম সৈয়দ আবু তাহের। তাহের সাহেবের জন্ম দক্ষিণ দামোদরের বামুনপুকুর গ্রামে। হুগলির চাঁপাডাঙ্গার বিখ্যাত ঘড়ি মেরামতকারী গোপালচন্দ্র কর্মকারের কাছে তাহের সাহেবের ঘড়ি মেরামতি শিক্ষার হাতেখড়ি । গোপালচন্দ্র কর্মকারই তাহের সাহেবকে “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানিতে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন! ঘড়ি মেরামতকারী হিসাবে তাহের সাহেবেরও খুব নামডাক হল সারা বাংলায়! তাঁর হাতের জাদুতে বেনসন টাওয়ার ক্লক এর কাঁটা আবার  ফিরে পেল তার পুরোনো স্পন্দন । টিক টিক টিক! আবার ছড়িয়ে পড়ল ঘড়ির মিষ্টি আওয়াজ!  টিকটিক শব্দে পেল্লাই কাঁটা দৌড়োতে লাগলো, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝিমিয়ে পড়া বর্ধমানের জনজীবনও!   

 রাজামশাই বেজায় খুশি । খুশিতে পাগল হয়ে গিয়ে রাজামশাই তাহের সাহেবকে প্রচুর টাকাপয়সা তো দিলেনই, উপরন্তু তাঁকে বর্ধমানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে বললেন, রাজবাড়ীর ঘড়ি মিস্ত্রী হিসাবে! বর্ধমানে থাকার জমিজায়গা সহ মাসিক ৩০ টাকার চাকরিরও প্রস্তাব দিলেন মহারাজ! কিন্তু, তাহের সাহেব রাজি হলেন না! কারণ তিনি “ওয়েস্ট এন্ড ওয়াচ” কোম্পানিতেও একই টাকা মাইনে পান। কিন্তু, তাঁকে হারাতে চাননা রাজামশাই! তখন তিনি তাহের সাহেবকে “চিফ কোর্ট ক্লক রিপেয়ারার ” পদে নিযুক্ত করলেন। ঠিক হলো মাইনে ৩০ টাকা তো পাবেনই, সঙ্গে রাজবাড়ির সমস্ত ঘড়ি তাহের সাহেবকে মেরামত করতে হবে। তার জন্য পাবেন আলাদা পারিশ্রমিক! শোনা যায়, সেইসময় তাহের সাহেব,নাকি, শুধু রাজবাড়ীর ঘড়ি মেরামত করেই উপার্জন করতেন মাসে দশ থেকে বারো হাজার টাকা!           

আজ বর্ধমানের বি সি রোড চত্বরে যত পুরনো বনেদী ঘড়ির দোকান আছে, তাদের বাপ দাদারা ঘড়ি মেরামত করা শিখেছেন এই তাহের সাহেবের কাছেই । তিনি ছিলেন তখনকার দিনের ভিআইপি ঘড়ি মেকানিক! তাহের সাহেবের পরিবার সুত্রে শোনা, একটি গল্প এখানে না বলে পারলাম না! এক রাতে তাহের সাহেব বি সি রোডের দোকান সবে বন্ধ করছেন, এমন সময় হাজির দুই রাজ পেয়াদা! রাজামশাই তলব করেছেন এখুনি যেতে হবে রাজবাড়ী । খুব টেনশন নিয়ে তাহের সাহেব সেখানে গিয়ে দেখলেন মহারাজ বিজয়চাঁদ হাতে একটি ঘড়ি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে পায়চারী করছেন, রাজবাড়ির লম্বা বারান্দায় । তাহের সাহেবকে দেখেই বললেন ,” এই যে তাহের ! দেখতো ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়িটি চলার সময় খুব সুন্দর একটা শব্দ হয় । এই শব্দ না শুনলে তো রাতে আমার ঘুমই আসবে না। ঘড়িটা এক্ষুনি আমায় সারিয়ে দাও “। রাজার খেয়াল! তায়, আদেশ বলে কথা। তাহের সাহেব আর কি করেন! ঘড়িটি নিয়ে এসে আবার দোকান খুললেন । সারাতে গিয়ে দেখলেনএকটা যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে । লেদ মেশিনে সেই যন্ত্রাংশ তৈরি করে, ঘড়ি ঠিক করে ঘন্টা দুয়েক পরে,আবার, গেলেন রাজবাড়ী । গিয়ে দেখেন রাজামশাই তখনও জেগে! ঘড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন! ঘড়ি পেয়েই রাজামশাইর সেকি আনন্দ! শিশুর মত ঘড়িটা কানে চেপে ধরে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ শুনতে থাকলেন। গাউনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো টাকা বার করে  গুঁজে দিলেন তাহের সাহেবের হাতে ।             

তাহের সাহেব বাড়ী ফিরে টাকা গুনতে গিয়ে, প্রায় অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়! দেখলেন হাতে সাতটি একশ টাকার কড়কড়ে নোট! সেই সময় সোনার ভরি ছিল ১৫ টাকা, আর বর্ধমানে এক বিঘে  জমির দাম ছিল ১৭ টাকা। রাজামশাই রাতে বন্ধ ঘড়ির আওয়াজ শোনার আনন্দে তাঁকে দিয়েছেন ৭০০ টাকা । এমনই ছিলেন রাজা বিজয়চাঁদ । বর্ধমানের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা । যাইহোক তাহের সাহেবের রাজবাড়ির ঘড়িওলার কাজ চলতে থাকলো , সঙ্গে দোকানও চলতে লাগলো রমরমিয়ে । ১৯৪১ এর ২৯ আগস্ট, বিজয়চাঁদ মারা গেলেন । তারপর, রাজা হলেন উদয় চাঁদ । মহারাজা উদয়চাঁদের সঙ্গেও তাহের সাহেবের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো ।  ১৯৫৪ সালে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ হলো! মহারাজ উদয়চাঁদ বর্ধমানে জায়গা জমি সম্পত্তি কিছু বিক্রি করলেন, আর বেশিরভাগ দান-খয়রাত করে চলে গেলেন কলকাতার রাজ প্রাসাদ বিজয় মঞ্জিলে, পাকাপাকি ভাবে । ১৯৫৫ সালে, বর্ধমান ছেড়ে যাওয়ার আগে মহারাজ সমস্ত রাজকর্মচারীদের উপহার দিলেন রাজবাড়ীতে তাদের এত কালের সেবার জন্য! জায়গা-জমি , আসবাব -পত্র , যে যা চেয়েছে মুক্ত হস্তে মহারাজ  দান করে গেছেন ।           

মহারাজ ডেকে পাঠালেন তাহের সাহেবকেও! বললেন, “তুমি এতদিন ধরে আমাদের রাজবাড়ির সব ঘড়ি মেরামত করেছ । তুমি কি চাও তাহের ?” তাহের সাহেবের দুচোখ তখন জলে ভরা! চোখের জল মুছে বললেন ,”  মহারাজ! আজ আমি যা, সবই আপনাদের দানে । বহুকিছু আমি পেয়েছি আপনাদের কাছ থেকে । আপনাদের ভালবাসা আর দানে আমার জীবন সার্থক । নতুন করে আমি আর কিছুই চাইনা। ” কিন্তু মহারাজও ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, “কিছু তোমাকে নিতেই হবে তাহের।” তাহের সাহেব বললেন ,”মহারাজ! যদি কিছু নিতেই হয় তবে আপনার বাবার একটা ছবি দিন আমায় ।” মহারাজ উদয়চাঁদ তাহের সাহেবের হাতে তুলে দিলেন মহারাজ বিজয়চাঁদের একটি দুর্লভ অয়েল পেন্টিং! সেই অয়েল পেন্টিং তাহের সাহেব বুকে করে তাঁর বি সি রোডের দোকানে টাঙ্গিয়ে রাখলেন সসম্মানে । এখন দোকানের খোলনলচে বদলে গিয়ে আধুনিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মহারাজার ছবিটি মর্যাদার সঙ্গে একই জায়গায় টাঙ্গানো আছে আজও। বর্ধমানের এই ঘড়িওলার কাহিনী হয়তো বর্তমান প্রজন্ম ভুলে গেছে, কিন্তু রয়ে গেছে কিছু প্রবীন নাগরিক আর তাহের সাহেবের পরিবারের স্মৃতিতে। নাহয়, স্মৃতিতেই বেঁচে থাক এক মহারাজ আর এক ঘড়ি মিস্ত্রির গল্প!