আজকের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, কল্পনা দত্ত কি দেশদ্রোহী ? রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই তো দ্রোহ ছিল তাঁর। কল্পনা দত্তের জীবন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেছে বারো বছর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশি বই পড়তে আগ্রহী হন। বিপ্লবীদের জীবনী, ’পথের দাবি’—এ ধরনের স্বদেশি বই পড়তে পড়তে তাঁর মনে হতো ব্রিটিশ সরকারকে সরাতে পারলেই দেশের দুঃখ দূর হবে। তাঁর ছোট কাকা তাঁকে আদর্শ স্বদেশ-সেবিকারূপে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিতেন। শৈশব থেকেই কল্পনা ব্যতিক্রমী ছিলেন। শৈশবে তিনি কামনা করতেন সংসারে যেন দুঃখ না থাকে, সবাই যেন সুখে দিন কাটাতে পারে। এই যে চাওয়া এই চাওয়াই তাঁকে দেশের প্রয়োজনে বিপ্লবী করে তুলেছে। তাই মাঝেমাঝে মনে হয় তিনি জীবিত থাকলে আজকের ফ্যাসিস্ত শাসিত ভারতে তাঁর কেমন লাগত? বিজেপি শাসিত ভারতেরই বা এমন বিদ্রোহিণীকে কেমন লাগত? অথবা তাঁকেও কি বলা হত দেশদ্রোহী ? কী প্রতিক্রিয়া হত কল্পনার, যখন তিনি শুনতেন দিলীপ ঘোষ, মোহন ভাগবতরা বলছে নারীর স্থান গৃহাভ্যন্তরে এবং নারীর হাফ প্যান্ট পরা, শার্ট প্যান্ট পরা ভারতীয় সংস্কৃতি নয়! কল্পনা কি হেসে ফেলতেন, না বিরক্ত হতেন? পাহাড়তলিতে অভিযানের সময় তিনি, বা ইউরোপিয়ান ক্লাব অভিযানের সময় প্রীতিলতা তো পরেছিলেন শার্ট প্যান্ট।

আসা যাক কল্পনা দত্তের কথায়। কল্পনা দত্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে লিখেছেন, তাঁকে দেখলে অবাঙালি বলে মনে হতো। সাধারণ বাঙালি নারীদের থেকে অনেক বেশি লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, বলিষ্ঠ ঋজুদেহ; আর হাসি ছিল ভীষণ মিষ্টি। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দুজন নারীর নাম জড়িয়ে আছে, তাঁদের একজন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, অন্যজন কল্পনা দত্ত।

সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে কল্পনা দত্ত যোশী একটি চিরস্মরণীয় নাম। বিপ্লবী কল্পনা দত্ত যোশী, কল্পনা দত্ত নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। অসমসাহসী কল্পনা দত্ত কি বিনম্র ! কি সংযত! কি আত্মপ্রসাদবিহীন! অবশ্য তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী না হলে রায়বাহাদুর ডক্টর দুর্গাদাস দত্তগুপ্তের আদরের নাতনি যে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এত বড় বিদ্রোহিণী হয়ে উঠবেন, একথা সম্ভবত কেউ স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি। কল্পনা দত্তের শেষের দিকে এক সাক্ষাৎকারে ওনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো -“চট্টগ্রামের বিপ্লবী কল্পনা দত্ত” আর “কমিউনিস্ট কল্পনা দত্ত যোশী” — এই দুটি সম্বোধনের মধ্যে কোনটা আপনি বেশী পছন্দ করেন? এ প্রশ্নের কী উত্তর দেব? আমি কিন্তু কখনো নেতা হইনি, আমি সবসময়ই একজন সাধারণ কর্মী। দুটো সম্বোধনই তো ভাল লাগছে! আচ্ছা এরকম বললে হয় না — চট্টগ্রামের কল্পনা দত্ত সে আবার কমিউনিস্ট পার্টিরও মেম্বার। কিন্তু একটা কথা। আমাকে দেবতা বানিয়ে ফেললেই আমি পালাই। আমারও অনেক শর্টকামিংস আছে।” কল্পনা দত্ত ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন সমৃদ্ধ সমাজের। তিনি ভাবতেন, পথ যতই কঠিন হোক না কেন তাকে জয় করতেই হবে ,তবেই দেখা হবে সোনালী ভোরের। কৈশোর বয়স থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিপ্লবীদের প্রতি তার আকর্ষণ ও শ্রদ্ধা ছিল। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, কানাইনালের জীবনী তিনি পড়েতেন।

পড়াশুনায় মেধাবী বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনা চট্টগ্রামের খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯২৯ সালে। মেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হন। কলকাতার ঐতিহ্যসম্পন্ন বেথুন কলেজে এসে ভর্তি হন আই এ প্রথম বর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে। বেথুন কলেজে পড়ার সময়েই তিনি রাজনৈতিক জীবনই তাঁর আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বিপ্লবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা মনে জেগে ওঠে। স্কলারশিপের টাকায় সাইকেল কিনে সকালে সকলের ঘুম ভাঙার আগেই বেথুন কলেজের কম্পাউন্ডের মধ্যে সাইকেলে ঘুরপাক খেতেন। প্রতি রবিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গিয়ে নৌকা চালানোর অভ্যাস করতেন। সূর্য সেনের ইন্ডিয়ান রিপাব্লিকান আর্মি দলের সদস্য হয়ে বিজ্ঞানের ছাত্রী কল্পনা নিজের পড়ার ঘরে বসে বোমার জন্য তৈরি করতেন গান-কটন। তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে কল্যাণী দাসের বিপ্লবী ছাত্রী সংগঠন যুক্ত হন। বেথুন কলেজে হরতাল পালন এবং অন্যান্য আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন বিপ্লবী কল্পপনা দত্ত। এই সময়ে কলকাতাতেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব ছিল। সেই প্রভাবেই তিনি হতে পেরেছিলেন মাস্টারদার প্রিয় পাত্রী, রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিকন্যা’। কল্পনা দত্ত চট্টগ্রাম জেলার শ্রীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিনোদবিহারী দত্ত ও মাতা শোভনবালা দত্ত। গ্রামের বাড়ি বোয়ালখালী হলেও তার শৈশব ও ছাত্রজীবন সূচিত হয় চট্টগ্রাম শহরে। তার দাদু ছিলেন শহরের নামকরা ডাক্তার রায় বাহাদুর দুর্গাদাস দত্ত– পূর্নেন্দু দস্তিদার। ডা. খাস্তগীর স্কুলের শিক্ষিকা উষাদি ছাত্রীদের সাথে নানা বিষয়ে গল্প করতেন, শুনাতেন দেশ-বিদেশের স্বাধীনতার গল্প ,এভাবেই তার আগ্রহ তৈরি হয় স্বদেশ সেবার, স্বাধিকারের জন্য সংগ্রামের। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের নেতা বীর শহীদ সূর্য সেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদারের নামের সঙ্গে যে দু’জন নারীর নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে আছে তাঁরা হলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। বিপ্লবীদের গুপ্ত সংগঠন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখা, মাস্টারদা সূর্য সেনের পরিচালনায় ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রিটিশ সরকারের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণ করে। বিপ্লবী দলের তৎকালীন নেতারা মনে করতেন স্বভাবে দরদী ও কোমল মেয়েরা বিপ্লবী কাজে অনুপযুক্ত। ছেলেমেয়ে পাশাপাশি থাকলে ছেলেদের নৈতিক আদর্শ খারাপ হতে পারে। এই মনোভাবের বিরুদ্ধে কল্পনা দত্ত লিখেছেন, “It was an iron rule for the revolutionaries that they should keep aloof from the women.” সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এই Iron rule-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যারা তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। বোমা, পিস্তল নিয়ে কাজ করার দৃষ্টান্ত তাঁরা রেখে গেছেন। কল্পনার বিপ্লবী যাত্রা খুব একটা মসৃণ ছিল না। বিপ্লবী জীবনের অনিবার্য ঝুঁকি ছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে নিজগুণেই কল্পনা হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী দলের প্রথম সারির কর্মী। বিপ্লবী দলে কাজ করার সময় কল্পনাকে আর্মি রিভলভার চালানোর কৌশল ও কাঠিন্য সম্পর্কে অবহিত করে মাস্টারদা বলেছিলেন, এই রিভলভার আয়ত্তে আনতে হলে অধ্যবসায় চাই। কল্পনা হাসি মুখে উত্তর দিয়েছিলেন, অধ্যবসায়ের ত্রুটি হবে না। বিপ্লবী জীবনের কষ্ট সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করে মাস্টারদা বলেছিলেন যেখানে যেখানে তাঁরা আশ্রয় পাবেন সেখানে কিন্তু আশ্রয়দাতারা যা দেবেন তাই খেতে হবে মুখ বুজে। মাস্টারদাদের মত কষ্টসহিষ্ণু যে মেয়েরাও হতে পারেন, কল্পনা তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ।

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার যুব বিদ্রোহ বা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠণের ঘটনাকে ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা। ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখল এবং ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধের ঘটনায় কল্পনা দত্ত এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে ছুটিতে চট্টগ্রাম আসার পর আর কলকাতায় ফেরেন নি। তখনও মাস্টারদার সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ হয়নি। ১৯৩১ সালের মে মাসে কল্পনার সঙ্গে মাস্টারদার সাক্ষাৎ হয়। ডিনামাইট ষড়যন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল কল্পনা দত্তের। কলকাতা থেকে বোমা তৈরি করার সরঞ্জাম সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের বাড়িতে বসে গান কটন তৈরি করতেন। সেগুলো পাঠানো হতো জেলের ভেতরে। চট্টগ্রাম জেলে অনন্ত সিংদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো কল্পনা দত্তের মাধ্যমে। ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আগের দিনই পুলিশের নজরে আসে কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সে সময় চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি পড়ার অনুমতি মিললেও অন্যত্র যাতায়াত বন্ধ হয় এবং গতিবিধি লক্ষের আদেশ দেয় সরকার। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য কল্পনাকে ডেকে পাঠান এবং কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ওপর দায়িত্ব দেন মাস্টারদা। ইতিমধ্যে সামরিক এলাকা বলে ঘোষণা করা হয় চট্টগ্রামকে। প্রতি গ্রামেই ছিল সামরিক ক্যাম্প। আত্মগোপনে থাকা অত্যন্ত কঠিন। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা ধরা পড়েন। কল্পনা পুলিশের ব্যূহ থেকে পালিয়ে আসেন। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন করতে করতে কল্পনা দত্ত, তারকেশ্বর দস্তিদার, মনোরঞ্জন দত্ত, মনোরঞ্জন দে ও অর্ধেন্দু গুহ সমুদ্রের ধারে গাহিরা নামক গ্রামে আশ্রয় নেন। সেখানে কয়েক দিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৩৩ সালের ১৯ মে ভোরে সেই গ্রামে রাতে আক্রমণ করে মিলিটারি। যুদ্ধ করতে করতে বিপ্লবী মনোরঞ্জন দত্ত নিহত হন। আশ্রয়দাতা পূর্ণ তালুকদারও নিহত হন এবং তাঁর ভাই নিশি তালুকদার আহত হন। বিপ্লবীদের গুলি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই গ্রেপ্তার হন। এই মামলার নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সেকেন্ড সাপ্লিমেন্টারি কেস’। এর চার্জ ছিল রাষ্ট্রদ্রোহ, ষড়যন্ত্র, বিস্ফোরক আইন, অস্ত্র আইন, হত্যা প্রভৃতি। এই মামলার আসামি ছিলেন সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত। মামলার রায়ে সূর্যসেন ও তারকেশ্বরের ফাঁসির আদেশ হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন দীপান্তরের আদেশ হয়। অনেক চেষ্টার পর সেই দীপান্তরের আদেশ স্থগিত হয়। মামলার রায়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জজ বলেন, ‘কম বয়সী মেয়ে বলে কল্পনা দত্তকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা গেল না।’

শাস্তি পাওয়ার পরই কলকাতা হিজলি স্পেশাল জেলে কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছিলেন তিন মাস। তিন-চার বছর পর সব নারী রাজবন্দীদের একত্রে রাখার ব্যবস্থা হয়। সেখানে ‘পরিচয়’ নামের মাসিক পত্রিকা পড়ার সুযোগ হয়। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে তাঁদের কাছ থেকে শুনতেন, জায়াড-এর লেখা, কোলের লেখা বার্নার্ড শ-এর স্যোশালিজম, কমিউনিজম সম্বন্ধে কিছু বইও তাঁদের কাছ থেকে পেলেন। বইগুলোর যুক্তিতর্ক মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি দেখলেন, ‘কমিউনিজমের সঙ্গে বিপ্লবীদের মতের কোনো অমিল নেই।

তার আগে রম্যাঁ রঁল্যার লেখা ‘সোল এনচান্টেড’ ও ‘জা ক্রিস্তোফ’ বই দুটি পড়ে তাঁর লেখার প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। বিনা বিচারে রাজবন্দীদের ছেড়ে দেওহ, রাজনৈতিক বন্দীদের আন্দামান থেকে নিয়ে আসা এবং তাদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বাইরে জনসাধারণের তুমুল আন্দোলন হয়। বন্দীদের আন্দামান থেকে ছাড়া হয় ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে। ১৯৩৮ সালের প্রথম দিকে কল্পনার বাবা জেলে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে শুনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অগ্নিকন্যা কল্পনার মুক্তির আবেদন জানিয়ে গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ১৯৩৯ সালের ১ মে ছাত্র আন্দোলনের চাপে সরকার কল্পনা দত্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সাত দিন পরই কল্পনা চলে আসেন চট্টগ্রামে। কমিউনিস্টদের সঙ্গেই কাজ করেন। সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে কুলিদের পড়াতেন; মালিপাড়া, ধোপাপাড়ায় গিয়ে গোপন সভা করতেন। তিনি জানতে পারেন, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে হলে কোনো একটি গণ-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে, তার মধ্য দিয়েই তাঁকে যাচাই করা হবে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কল্পনা উপলব্ধি করেন, কমিউনিস্ট পার্টিতে নৈতিক শিথিলতার স্থান নেই, স্বার্থপর ও আত্মসর্বস্বদের জায়গা কমিউনিস্ট পার্টিতে হয় না।

১৯৪০ সালে কল্পনা কলকাতায় যান বিএ পরীক্ষা দিতে। জুলাই মাসে বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ওই বছর মুম্বাইতে এক সম্মেলনে কল্পনা দত্ত চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সেখানেই তার পরিচয় হয় পি. সি যোশীর সঙ্গে। পি. সি যোশী তদানীন্তন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৪ সালে যোশীর সঙ্গে কল্পনার বিয়ে হয়। এরপর তিনি ফিরে যান চট্টগ্রামে এবং নিযুক্ত হন দলের মহিলা ও কৃষক সংগঠনকে গড়ে তোলার কাজে। ১৯৪৬ সালে আইনসভার নির্বাচনের কমিউনিস্ট পার্টি থেকে প্রার্থী ছিলেন কল্পনা দত্ত। আর কংগ্রেস থেকে দাঁড়িয়েছিলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনের স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তা।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলো, জন্মভূমি ছেড়ে এলেন ভারতে। কমিউনিস্ট পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করলেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ভারত-সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির প্রতিদিনের কাজে। রুশ ভাষার শিক্ষিকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দেশ ভাগ হওয়ার পরও কিছুদিন তিনি চট্টগ্রামেই থেকে যান। ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে চাকুরি নেন এবং পরবর্তী সময়ে দিল্লিতে বসবাস করেন। রুশ ভাষায় শিক্ষকতা করার সময় নতুন দিল্লির রুশ ভাষা কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভারতের নারী আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মৈত্রী সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চল্লিশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপত্র ‘পিপলস্ ওয়ার’ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে প্রকাশিত তৎকালীন সামাজিক বিষয়ের ওপর তাঁর লেখাগুলি গবেষকদের কাছে মূল্যবান দলিল হয়ে আছে। ১৯৪৫-এ ‘চিটাগাং আর্মারি রেইডার্স রেমিনিসেন্স’ প্রকাশিত হয় বোম্বাই থেকে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণকারীদের স্মৃতিকথা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। ১৯৯০ সালে ‘চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান’নামে ভারত সরকারের উদ্যোগে আর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

১৯৯৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শেঠ সুখলাল কারনানী মেমোরিয়াল হাসপাতালে কল্পনা দত্ত যোশীর ৮২ বছর বয়সে জীবনাবসান হয়। তিনি ছিলেন আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তার জন্মবার্ষিকীতে জানাই রক্তিম অভিনন্দন।