১৯৪৩ সালের ভয়াবহ মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, আকাল, মহামারির সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও সংকট, ১৯৪৬-এর ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা এবং অবশেষে দেশভাগ—এই রক্ত ও অশ্রুপিচ্ছিল পথে এল ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা। পরাধীনতার আর্থসামাজিক দুঃসহ যন্ত্রণার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে অতিরিক্ত সমস্যা হিসাবে যুক্ত হল দেশভাগের কারণে ওপার বাংলা থেকে আসা ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত। যাদের ছিল না অন্নের ও বাসস্থানের কোনো নির্দিষ্ট সংস্থান। এছাড়া পাট চাষের জমির বেশিরভাগই রয়ে গেল ওপারে। এপারে গঙ্গার ধার বরাবর চটকলগুলি কাঁচামালের অভাবে গভীর সংকটে পড়ে গেল। সমাধান হিসাবে সদ্যস্বাধীন দেশের পরিচালকরা উপায় বাতলালেন পশ্চিমবঙ্গের ধানি জমির একাংশে পাট চাষ করতে হবে। খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থার আশ্বাসও দিলেন। কিন্তু যতদিন যেতে লাগল সেই আশ্বাসবাণী ক্রমশ বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যেতে লাগল। স্বাধীনতা পেয়ে জনমানসে তৈরি হওয়া আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বাধীন দেশের শাসকরা যথাযথ সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হতে লাগলেন। একটু একটু করে গরীব মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করল। তাঁরা বুঝতে পারলেন, দেশ স্বাধীন হলেও, বিদেশী শাসকরা চলে গেলেও স্বাধীন দেশের শাসকদের শ্রেণি চরিত্র একই আছে। অর্থাৎ স্বাধীনতার লাভ ভোগ করছে কেবলমাত্র ধনী মালিক, জোতদার-জমিদার, কালোবাজারি মজুতদাররা। গরীব খেটে খাওয়া মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরেই। তাদের খাদ্য নেই, পরনের কাপড় নেই, জীবন ও জীবিকার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওপার থেকে ছিন্নমূল হয়ে আসা মানুষগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় এই বঙ্গের মানুষের ক্ষোভ বাঙ্ময় হয়ে উঠতে লাগল নানা ইস্যুতে সংগঠিত আন্দোলনগুলিতে। ওই পর্বেই একের পর এক সংগঠিত হয় ট্রামভাড়া আন্দোলন-১৯৫৩, শিক্ষক আন্দোলন-১৯৫৪, বঙ্গ বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন-১৯৫৬ এবং ১৯৫৮-৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলন।


বিগত শতকের পাঁচের দশকের গণ আন্দোলনগুলির সাথে খাদ্যের দাবিও বড়ো দাবি আকারে উঠে আসছিল। জেলায় জেলায় এই প্রশ্নে গণবিক্ষোভও সংগঠিত হচ্ছিল। গ্রামে কৃষকের চাহিদা ছিল ফসলের ভালো উৎপাদন ও ভালো দাম। শহরের মানুষের চাহিদা ন্যায়সংগত দামে খাদ্যের নিয়মিত সরবরাহ। এই দুইয়ের মাঝখানে ছিল মজুতদার। যে অল্প দামে ওই ফসল অভাবী কৃষকের কাছ থেকে কেনে, মজুত করে ও পরে চড়া দামে বিক্রি করে। তাই আন্দোলন ছিল মজুতদারির বিরুদ্ধে, সরকারের পক্ষ থেকে অভাবী বিক্রি ঠেকাতে ও মজুতদারির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পালনের দাবিতে এবং পূর্নাঙ্গ সুষ্ঠু রেশনব্যবস্থার দাবিতে। ভূমি সংস্কারের মতো মৌলিক দাবিও উঠে এসেছিল।


১৯৫৮ সাল থেকেই খাদ্য পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। সে বছর ফসল ওঠার পরপরই খাদ্য সংকট দেখা দেয়। রাজ্যজুড়ে শুরু হয় অনাহার ও অর্দ্ধাহার। ক্ষুধার্ত মানুষ ঘটিবাটি বিক্রি শুরু করেন। ধান-চাল সংগ্রহ করে খাদ্য ভান্ডার সৃষ্টি করা, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আরো চাল সরবরাহ, সংশোধিত রেশনিং চালু রাখা ও সম্প্রসারিত করা, বিভিন্ন রিলিফ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রয়োগ ইত্যাদি দাবি তুলে ধরা হয় সরকারের কাছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ফলে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। বছরের শেষ দিকে খাদ্য পরিস্থিতি আরো বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। রাজ্যের সব জেলা ব্যতীত মাত্র কয়েকটি জেলায় কর্ডন আরোপ করার সরকারি ভুল সিদ্ধান্তে চোরাকারবার আরো বেড়ে যায় কর্ডন বহির্ভূত জেলাগুলিতে। একদিকে সরকারি রেশনিং ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনুপস্থিত, অন্যদিকে সরকারের নীরব মদতে চোরাকারবারি ও মজুতদাররা ফূলেফেঁপে উঠতে থাকে। সর্বস্বান্ত হয়ে সর্বনাশের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকে বাংলার কৃষককূল ও শহরের গরীব মজুররা। বহু গ্রামে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়। কৃষক-মজুর-শ্রমজীবী জনতার মধ্যে দেখা দেয় প্রবল বিক্ষোভ। তারা খাদ্যের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। কিন্তু সরকার দাবিগুলো বিবেচনা করার বদলে দমন পীড়নের রাস্তাই গ্রহণ করে।


পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালের মে মাস থেকে সরকারের জনস্বার্থবিরোধী খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। ১৫ই জুন পালিত হল প্রতিবাদ দিবস। ২৫শে জুন রাজ্যব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হল। ১৭ই আগষ্ট বামপন্থী দল ও সংগঠনসমূহের ঘোষণাক্রমে ২০শে আগষ্ট থেকে রাজ্যজুড়ে নতুন উদ্যমে খাদ্যের দাবিতে সংগ্রাম শুরু হল। সরকারের দমন পীড়ন তা বানচাল করতে পারেনি। ২৭শে আগষ্ট পর্যন্ত প্রায় ৭০০০ মানুষ গ্রেপ্তার হন।


এরপর এল ৩১শে আগষ্ট। ওইদিন খাদ্যমন্ত্রীর অপসারণ ও খাদ্যের দাবিতে এবং পুলিশি দমন পীড়নের প্রতিবাদে কলকাতার কার্জন পার্ক (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ পার্ক) থেকে মিছিল এগিয়ে চলল ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে। মিছিলে সামিল কৃষক, কৃষক রমণী, কারো কোলে শিশু। কোঁচড়ে মুড়ি, চিঁড়ে, গুড়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে কর্ডন করে পুলিশ মিছিল আটকাল। শুরু হল গ্রেপ্তার বরণ। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি শেষ হবার মুখে হঠাৎ লাঠি হাতে চারপাশ থেকে ধেয়ে এল প্রচুর পুলিশ। শুরু হল মার। ভয়ংকর, নির্মম, অভূতপূর্ব মার। অতর্কিত আক্রমণে ছত্রভঙ্গ জনতা ছুটল যে যেদিকে পারে। যাদের মধ্যে রয়েছে শিশু কোলে কৃষক রমণী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবী সবাই। কিন্তু উপায় নেই। ডালহৌসি থেকে এসপ্লানেড পর্যন্ত প্রতিটি রাস্তার আনাচেকানাচে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য পুলিশ বেরিয়ে এল লাঠি হাতে। যারা ময়দানের দিকে পালাল রেহাই মিলল না তাদেরও। ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল পুলিশ বাহিনী। মার খেয়ে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দুই হাত জোড় করেও ক্ষমা মিলল না। ঝড়ের বেগে চলল লাঠি বুকে, মুখে, পেটে, মাথায়। অসংখ্য মানুষের আর্ত চিৎকারে অন্ধকার বিদীর্ণ হল, কিন্তু পৈশাচিকতা নিবৃত্ত হল না। শহীদের মৃত্যুবরণ করলেন ৮০ জন নরনারী, নিখোঁজ হলেন দু’শ জন। আহত তিন হাজার। শেষ রাতে পাচার হল প্রচুর মৃতদেহ। একই দিনে লাঠি চলল মেদিনীপুর, তমলুক, ঘাটাল, বর্ধমান, বহরমপুর, গঙ্গারামপুরে।


এই হিংস্র পুলিশি তান্ডবের প্রতিবাদে পরদিন ১লা সেপ্টেম্বর সংঘটিত হল ছাত্র ধর্মঘট। ধর্মঘটী ছাত্রদের মিছিলেও পুলিশ গুলি চালাল। খন্ডযুদ্ধ বেঁধে গেল পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের। সেদিনের গুলিচালনায় আরো ৮ জন নিহত হল। আহত হল ৭৭ জন। ২রা সেপ্টেম্বর সরকার কলকাতায় সেনা নামাল। ১লা ও ২রা দু’দিনে কলকাতায় ১২ জন, হাওড়া ও ২৪ পরগনায় ১৫ জন নিহত হল পুলিশের লাঠি গুলিতে। আহত হল ১৫০ জন। ৩রা সেপ্টেম্বর হল সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল। ওইদিন কলকাতা, হাওড়া, ২৪ পরগনা মিলিয়ে তিরিশ জায়গায় গুলি চলে। ৮ই সেপ্টেম্বর ছাত্র শহীদ দিবস পালিত হল। ১০ই সেপ্টেম্বর হল ঐতিহাসিক মৌন মিছিল, উত্তর কলকাতার দেশবন্ধু পার্ক থেকে দক্ষিনের দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত। মিছিলে এক বিরাট ব্যানারে লেখা ছিল—‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?’ আর একটি বড়ো লাল শালুতে লেখা ছিল—‘নারীঘাতী শিশুঘাতী কুৎসিত বীভৎসা ‘পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন’। হাজার হাজার মানুষের নীরব পদভারে মূর্ত হয়ে উঠল যেন সরব সোচ্চার প্রতিবাদ।


১৪ই সেপ্টেম্বর গুলি চালনার তদন্ত দাবি করে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নাগরিক সভা, ২২শে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লনে শহীদ স্তম্ভ স্থাপন ও ছাত্রদের আইন অমান্য, ২৪ ও ২৫শে অন্যান্য সংগঠন ও শ্রমিকদের সত্যাগ্রহ এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর ওয়েলিংটন স্কোয়ার (অধুনা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার)-এ স্থাপিত হল শহীদ স্তম্ভ। যে শহীদ স্তম্ভ আজো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে শহীদের রক্তঋণ শোধে আমাদের প্রেরণা দেয়। বামপন্থী দল ও সংগঠনগুলি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রতি বছর ৩১শে আগষ্ট দিনটি শহীদ দিবস হিসাবে পালন করার। সেই থেকে প্রতি বছর ৩১শে আগষ্ট শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। একই সঙ্গে পরের দিনটি অর্থাৎ ১লা সেপ্টেম্বর দিনটি ছাত্র শহীদ দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।
গণ আন্দোলনের চাপে সরকার চার একরের কম জমির কৃষকের জন্য সংশোধিত রেশন, ১৪৪ ধারা বাতিল, বন্দিমুক্তি এসব দাবি মেনে নেয়। কিন্তু বাকি দাবিগুলি মানা হয়নি।
১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় রক্তের অক্ষরে লেখা থাকবে। এই আন্দোলন ছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বে প্রকৃত পক্ষে জনগণের আন্দোলন। কোনো মিডিয়াসৃষ্ট কৃত্রিম আন্দোলন নয়। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলনের বর্তমান প্রজন্মের কর্মীদের কাছে খাদ্য আন্দোলনের মতো ইতিহাস সৃষ্টিকারী আন্দোলনের শিক্ষা আন্দোলনমুখী মানসিকতা গড়ে তুলতে ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার দৃঢ়তা অর্জনে প্রাণিত করবে।
যেমন ইতিহাস তৈরি হয়েছে এই আন্দোলনে, পরবর্তী অধ্যায়ে ইতিহাস তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে এই আন্দোলন। সেই অধ্যায় হল ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন ও ‘৬৭-র বেনাম জমির আন্দোলন।
আজ এত বছর পরেও কৃষকের ওপর শোষণ আরো বেড়েছে।কর্পোরেট পুঁজির তীব্র ও নির্দয় শোষণে কেবল কৃষক নয়, সকল অংশের শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা। সার, বীজ, ডিজেল, বিদ্যুৎ মাশুলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে চাষের উৎপাদন খরচ বেড়ে চলেছে, উল্টোদিকে ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না কৃষক। সরকারের ভূমিকা অনুপস্থিত। ফলে কর্পোরেট পোষিত ফড়ে দালালরা কৃষকের হাড়মাস কালি করে দিচ্ছে। অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে কৃষক। কেউ দেনার দায়ে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ, কেউ রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে। কিন্তু তথ্য বলছে রাজ্যের ৪৯ শতাংশ মানুষ এখনো পর্যন্ত রাজ্য সরকারের রকমারি নামের প্রকল্পের কোনো সুযোগ সুবিধা পায় নি। অর্থাৎ প্রচারের মেঘ যতটা গর্জাচ্ছে ততটা বর্ষাচ্ছে না। সম্প্রতি আবার রাজ্যের শাসক দলের নেতা মন্ত্রীদের বিপুল চুরি ও পাহাড় প্রমাণ সম্পদের তথ্য সামনে এসেছে এবং তজ্জনিত মামলা মোকদ্দমা থেকে বাঁচতে তারা ব্যস্ত। ফলে কৃষকের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় তাদের কোনোদিন ছিলনা, আজও নেই। তাই সংগ্রাম ছাড়া কোনো পথ নেই। দিল্লির কৃষক সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ব না এই মনোভাব নিয়ে, ‘৫৯-এর খাদ্য আন্দোলন থেকে প্রেরণা নিয়ে কর্পোরেট হাঙরদের হাত থেকে কৃষি ও কৃষককে রক্ষার লড়াই চলবে।এর জন্য গড়ে তুলতে হবেকৃষক-ক্ষেতমজুর সহ গ্রামীণ শ্রমজীবীদের ব্যাপকতর ঐক্য।