বিরাট আয়োজন, খেলা হবে। হৈ হৈ করে মাঠে নেমে পড়েছে দুদল। মাঠ কানায়কানায় পূর্ণ। দর্শকও রেডি, রেফারিও রেডি। উন্মাদনার পারদ চরচর করে বাড়ছে। বাজলো বাঁশি…খেলা হচ্ছে…বিরতির একটু আগে একজন বয়স্ক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। কিন্তু কি আশ্চর্য! কেউ ওনাকে বললেন না বসে পড়তে! তবে কি কেউই খেলা দেখছেনা? একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠলো, এটা কি খেলা? দুপক্ষই তো একই দিকে গোল দিতে চাইছে! এত তোড়জোড় করে যে খেলার আয়োজন তাতো দেখছি পুরোটাই জুমলা!

পশ্চিমবঙ্গে এমনই এক খেলা দেখছি আমরা। সরকারী-বিরোধী একই দল! দুদলেরই কমন শত্রু বামপন্থীরা। খেলাটা আসলে কে কত বড় কমিউনিস্ট বিরোধী তা প্রমাণ করার খেলা। এই খেলায় তারাই জিতবে যারা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি হিংসাত্বক হয়ে উঠতে পারবে। তাই কমপিটিশন চলছে…ত্রিপুরা বনাম পশ্চিমবঙ্গ। প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষ কোপানোর খেলা। একটা মানুষকে মারলে কত মানুষকে ঠান্ডা করে রাখা যায়?

খারাপ তখনই খারাপ বলে প্রমাণিত হয় যখন, সমাজের বেশিরভাগ মানুষ তাকে মন থেকে পুরোপুরি খারাপ বলে মেনে নেন। অর্থাৎ জনশক্তিই একমাত্র হাতিয়ার যা খারাপকে খারাপ বলবার হিম্মত যোগায়। এই শক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত অর্জন না করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত খারাপ বহালতবিয়তেই থেকে যায়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে। আপনি যদি খারাপকে পরিজিত করবার মতো শক্তিমান না হন তাহলে সেই খারাপটাকে আপনি মেনে নেন। মানিয়ে নেন…নিজেকে…নিজের মনকে…ধীরে ধীরে আপনি খারাপটাকেই ভাল বলে ভাবতে শেখেন এবং তার হয়ে প্রচার করেন। এভাবে দিনের পর দিন খারাপটাকে ভাল বলে ভাবতে ভাবতে ভালোর প্রতি আকাঙ্খাটাই আর থাকে না।

পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের ভাল আর মন্দ বাছাই করবার রাস্তাটাই সংকুচিত করে রেখেছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই আমাদের কাছে চয়েজ খুব কম থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা একগাদা পচা আলুর মধ্যে থেকে তুলনামূলক কম পচা আলুটা বেছে নেওয়ার মতোন।

খেলার নিয়মখেলার আবেগ

ছেলেবেলায় একবার ইডেন গার্ডেনে মোহনবাগান-মাহামেডানের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। এদিকে আমি হলাম কাঁট ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। বসেছি গিয়ে মোহনবাগান গ্যালারিতে। লীগ টেবিলে ইস্টবেঙ্গল তখন মোহনবাগানের থেকে মাত্র দু’পয়েন্টে এগিয়ে। মনেপ্রাণে চাইছি মোহনবাগান এই ম্যাচটা হারুক। খেলা তখনও শুরু হয়নি। দুরুদুরু বুকে মনে সমস্ত উৎকন্ঠা চেপে বসে আছি…এমন সময় মাঠ কাঁপিয়ে মোহনবাগান দল মাঠে নামলো। গ্যালারির সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকলো। অত লোকের মধ্যে বসে নিজেকে চেপে রাখতে পারলাম না…আমিও উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকলাম। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে ফিরে পেলাম। খেলা শুরু হলো…মোহনবাগান গ্যালারিতে বসে মোহনবাগানের হার চাইছি…হটাৎ…বাইশ মিনিটের মাথায় মহামেডানের জামশিদ নাসিরির গোল! আর নিজেকে আটকাতে পারিনি, আবেগে হাততালি দিয়ে উঠেছি…গ্যালারির সবাই আমাকে এই মারে কি সেই মারে…ছোট বলে হয়ত খুব বেশি মারধোর করেনি কিন্তু বাকি খেলাটা আর আমাকে বসে দেখতে দেয়নি ওরা। ঠিক এর উল্টোটা ঘটেছিল আমাদের পাড়ার বিকাশদার সাথে। ডায়মন্ড সিস্টেমের দিন বিকাশদা গিয়ে ঢুকেছে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে। এদিকে বিকাশদা পার মোহনবাগান সমর্থক। ব্যাস! আর যায় কোথায়…প্রত্যেকটা গোলে বিকাশদাকে নেচেকুদে আনন্দের বহিপ্রকাশ করতে হয়েছিল। পরে আমি বিকাশদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি মোহনবাগানের সমর্থক হয়েও ইস্টবেঙ্গলের গোলে নাচলে? বিকাশদা বলেছিলো, কি করুম বল? অমন না করলে ওরা কি আমারে ছাড়তো? বুকটা আমার ফাইট্টা যাইতা ছিল। এটাই হলো খেলার আবেগ। এই আবেগেই ভাসছে বাংলা। বাংলার মানুষ।

খেলা শেষ

খেলাতো একদিন না একদিন শেষ হবেই। সেই নিয়ম অনুযায়ী নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের খেলাও শেষ হলো। ঘটা করে বিজয় উৎসবও হলো। সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন। কিন্তু তারপর হটাৎ একদিন ভাবতে শুরু করলেন, এ কেমন জয়? যে কারণে লড়াই তার তো কিছুই সুরাহা হলো না! কংক্রিটের উপর সর্ষে বীজ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। খেলা শেষ হলেও শেষ হলো না চৌত্রিরিশ বছরের গরুর রচনা লেখা। সরকার পক্ষ, বিরোধি পক্ষ সময় সুযোগ পেলেই একবার করে সেই গরুর রচনাটা শুনিয়ে নেন। যাচাই করে নেন, কমিউনিস্ট বিরোধী জনমত। মনে করিয়ে দেন, রক্তে হলদি নদীর জল লাল হয়ে ওঠার কথা, ছোট ছোট শিশুদের টেনে ছিঁড়ে ফেলার কথা…আরও কত কি!

খেলা শেষ এবার অন্য খেলা

Ruling Class-এর একটা নিজস্ব মতবাদ থাকে, তারা সেই মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে একটা উপরিকাঠামো তৈরি করে। রাষ্ট্র হলো সেই উপরিকাঠামো। যেহেতু Ruling Class-এর মতাদর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, সেহেতু রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো শাসক শ্রেণীর আধিপত্যতে বজায় রাখা। এই আধিপত্য কার উপর বজায় রাখে? আধিপত্য বজায় রাখে Working Class-এর উপর। Ruling Class মানে বিজেপি, কংগ্রেস বা তৃণমূল নয়, Ruling Class মানে হলো উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা স্বত্ব যার হাতে আছে। আর Working Class মানে হলো উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানা স্বত্ব যাদের হাতে নেই। স্বাভাবিক কারণেই সংখ্যার বিচারে ‘Ruling Class’ ‘Working Class’-এর ধারেকাছেও আসে না। তাহলে ‘Ruling Class’ ‘Working Class’-এর উপর আধিপত্য বজায় রাখে কি করে? এক কথায় যদি এর উত্তর দিতে হয় তবে বলবো- ছলে, বলে এবং কৌশলে। ‘ছলে’ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক পিরণের মাধ্যমে। ‘বলে’ অর্থাৎ রাষ্ট্র শক্তিকে ব্যবহার করে আর ‘কৌশলে’ অর্থাৎ মগজধোলাইয়ের মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের শ্লোগানকে সামনে রেখে যে কাজটা খুব দক্ষতার সাথেই করতে পেরেছিল। যার পুরস্কার স্বরুপ হিলারি ক্লিন্টন নিজে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যান আর এস এস-এর দুর্গা মমতা ব্যানার্জিকে।

তারপর হলদি নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। হলদি নদীর তীরে মমতা ব্যানার্জি তারই তৈরি বিশ্বস্ত সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরেছেন। অভিষেককে আড়াল করতে এক এক করে গোটা শিক্ষা দপ্তরটাকে জেলে পাঠিয়েছেন। দার্জিলিঙ থেকে দীঘা বান্ডিল বান্ডিল টাকার ছবি মোবাইলে মোবাইলে ঘুরপাক খেয়েছে। বীরভূমের বাঘ তিহার জেলে খাবিখাচ্ছে। একদা “বাংলায় আগুন জ্বালিয়ে দেবো”  বলে হুঙ্কার দেওয়া পার্থ চ্যাটার্জিকে দেখলেই “চোর-চোর” বলে শ্লোগান উঠছে আর উনি মাথা নীচু করে পালাচ্ছেন। –এই খেলাটাও বাংলার মানুষ বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন।

কাজের সুবাদে বিভিন্ন যায়গায় ঘুড়ে বেড়াতে হয় আমাকে। সেদিন গিয়েছিলাম নিউ টাউনে। একটা চায়ের দোকানে বসে ঘরোয়া মেজাজে আলোচনা হচ্ছিল… দোকানে বসে থাকা কম বয়সী এক মুসলিম যুবক আর চা বিক্রেতা বয়স্ক চাচা দুজনেই ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছিলেন। ওদের কথা শুনে সত্যি সত্যিই আমি অবাক হয় যাচ্ছিলাম। ঠিক একই কথা কিছু দিন আগেই শুনেছি আন্দুলের গাড়ি মেকানিক আব্দুলের মুখে, পাথরপ্রতিমার সামিম-তাপসের মুখে…ওদের নাম ,বাড়ি আর কাজগুলিই শুধু আলাদা আলাদা; কিন্তু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সব্বার এক। আসলে ওরাতো সবাই একই নৌকার যাত্রী…