সংকটের আগুনে জ্বলছে কৃষি ও কৃষক

                             ৩য়  পর্ব

                          ভাস্করানন্দ রায়

কৃষি ও কৃষকের নিজস্ব চরিত্র বজায় রাখতে হলে, কৃষককে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতেই হবে, না হলে এ দেশের কৃষকের টিকে থাকা ও বেঁচে থাকা  খুবই সমস্যাসংকুল হয়ে উঠবে। কৃষকদের জীবনে, শোষক ও শাসক শ্রেণীর তৈরি করা- এই সমস্যাসংকুল থেকে বাঁচতে কৃষককে রাস্তায় নামতেই হবে। ঘরে বসে থাকলে সরকার ঘরে এসে কৃষককের যে মূলগত সমস্যা  তার সমাধানও করবে না আর ফসলের  দামও দিয়ে যাবে না। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যাহ্য দামের দাবি ও অধিকার কৃষককেই বুঝে নিতে হবে। তার জন্যই  রাষ্ট্রশক্তির  চোখে চোখ রেখে কৃষককে রাস্তায় নেমেই লড়াই করতে হবে। তবেই কৃষকের দাবি আদায় সম্ভব হবে এবং কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত হবে। তার জন্যই শুরু হয়েছে তীব্র কৃষক আন্দোলন।কৃষিফসলের লাভজনক দামসহ অন্যান্য দাবীতে এবং কৃষকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে আগামী ৫ ই এপ্রিল ২০২৩ সংসদ অভিযানের ডাক দিয়েছে —- কৃষক আন্দোলনের মাটি থেকে গড়ে ওঠা, ৫০০টি কৃষক সংগঠনের সম্মিলিত জোট “সংযুক্ত মোর্চা”। ইতিমধ্যেই পেঁয়াজের দাম না থেকে শুরু হয়েছে কৃষকদের ঐতিহাসিক লংমার্চ। জনসমুদ্রের ঢেউ তুলে লংমার্চ এগিয়ে চলেছে মুম্বাই শহরের দিকে। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কৃষকের দাবিকে ছিনিয়ে নিতে হবে।

কর্পোরেট বিশ্বায়ন, কৃষি ব্যবস্থাকে– কিভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা অতীতের কিছু তথ্য দেখলেই বোঝা যাবে। তার জন্য মাঝে মধ্যেই আমাদের স্মৃতি চর্চা করতে হয়। তবেই বর্তমানে কি ঘটে চলেছে তা বোঝা যায়। ফিরে যাই, অতীতের কৃষি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দলিল বা নথিতে।কৃষকের অর্থনীতির অধোগতি এবং খাদ্যের উৎপাদন কমে যাওয়া শুরু হয় মূলত ১৯৯০ এর দশক থেকে। ঐ তথ্য দেখলেই বোঝা যায়, কর্পোরেট বিশ্বায়ন –, কৃষিতে কিভাবে থাবা বসিয়েছে এবং সেই থাবা কিভাবে ছড়িয়ে গেছে কৃষি ব্যবস্থাতে। তার তথ্যগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করলে প্রায় প্রত্যেকেরই উপলব্ধি হবে, কৃষি ক্ষেত্রে আক্রমণ কত সুদূরপ্রসারী। সুতরাং কৃষি ব্যবস্থা ও কৃষককে যদি বাঁচাতে হয়, রক্ষা করতে হয় , তাহলে আন্দোলনই একমাত্র পথ। আর সেই আন্দোলনে শ্রমিকসহ সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তুলতেই হবে।এ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ২০১৪ সালের একটি কৃষি বিষয়ক পত্রিকায় প্রকাশিত ,কৃষি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি তথ্য সংকলন করে পাঠকবর্গের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। তিন দশক ধরে কৃষি ও কৃষকের উপরে আক্রমণের ধারা বহুগুণ বেড়েছে। *বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বহুগুণ বেড়ে গেছে।খাবারের জন্য ৩৩ টির বেশী দেশে দাঙ্গা হয়েছে।ভারতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। বর্তমানে মূল্যবৃদ্ধি লাগাম ছাড়া, সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা*:—

খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার দ্রুত কমছে। বৃদ্ধির গড় হার ছিল বার্ষিক ৩.২৭ শতাংশ। ২০০০–২০০৭ সাল — হার কমে ১.৭৪ শতাংশ হয়েছে। ২০১১-১২ শস্যবর্ষে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল ২৫ কোটি ৯৩ লক্ষ, টনেরও বেশি। ২০১২–১৩ শস্যবর্ষে কমে হয়েছে ২৫ কোটি টনের একটু বেশি। ৯০ লক্ষ টন উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রের  কৃষি মন্ত্রক। কমের পরিমাণ ৩.৪ শতাংশ। তথ্য কি বলছে দেখা যাক :—আগের শস্য বর্ষে (জুন –জুলাই ) চাল উৎপাদন হয়েছিল ১০ কোটি ৫৩ লক্ষ টন। ২০১২ -১৩ তে হয়েছে ১০ কোটি ১৮ লক্ষ টন।আগের বছর গম উৎপাদন হয়েছিল ৯ কোটি ৪৮ লক্ষ টন। খাদ্যশস্য বহির্ভূত উৎপাদনেও উদ্বেগজনক অবনতি। ২০১২-১৩ তে আখের উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ কোটি ১০ লক্ষ টন। এবারে হয়েছে ৩৩ কোটি ৪৫ লক্ষ টন। ২০১৩-১৪ তে হয়েছে ৩৩ কোটি ৪৫ লক্ষ টন।। *১৯৯১ থেকে ২০০১ –১০ বছরে দেশে ৮০ লক্ষ কৃষক চাষ ছেড়েছেন।  মানুষ যখন খেতে পায় না তখন খোলা আকাশের নিচে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বর্তমানেও তাই হচ্ছে এবং মোদি সরকার আবার এই উদ্বৃত্ত চাল থেকে মদ তৈরি করে বাড়তি আয় করছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে আনুমানিক ৬০ লক্ষ টন শস্য নষ্ট হয়ে যায়। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড়শ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি– অন্তত এক কোটি ৯০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য নষ্ট হবে।

বীজের দাম বিনিয়ন্ত্রণের ফল। ১০ বছর আগের দাম আর ২০২৩-এর সবজী বীজের দাম দেখলে চোখ কপালে উঠবে। চাষীর জ্বালা, “আচ্ছে দিন ওয়ালারা” বোঝে! চাষীরা কেন চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তা সকলেই বোঝার চেষ্টা করুন:–  *গমের বীজ তিন বছরে ৬৮০ টাকা কেজি থেকে  বেড়ে হয়েছে দুই হাজার টাকা কেজি।, *ধান ও জোয়ার বীজ  ৪১ থেকে ১২০ শতাংশ বেড়েছে। সবজী বীজের ক্ষেত্রেও তাই :- বেগুন বীজ ২০১১-১২ও ২০১২-১৩ তে এক কেজির দাম ছিল ১৭৬০ টাকা। ২০১৩-১৪ তে বেড়ে হয়েছে ৯৭৩০ টাকা ২০২৩ এ পাঁচ গ্রাম বেগুন বীজের দাম ২৫০ টাকা,৫০,০০০টাকা কেজি।, ঢেঁড়সের দাম ১৭০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪২৫ টাকা এখন দাম ৬৫০০টাকা কেজি। ঝিঙে বীজ ১০০ গ্রামের দাম ৭০০ টাকা করোলা ১০০ গ্রামের দাম ১৪০০ টাকা। কুমড়ো ১০ দশ গ্রামের দাম ৬০ টাকা। বীজ বিনিয়ন্ত্রণের ফলে বীজের দাম প্রতিবছর বাড়ছে।এই বীজ বন্ধ্যা। প্রতি বছরই চাষীকে বীজ কিনতে হবে উচ্চমূল্যে।

দেশীয় জাতের বীজ ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এটাই ব্যবসায়িক কৌশল। এইভাবেই বীজের বাজারটাকে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো দখল করে নিচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে এবং উৎপাদন কমেছে। জুন ২০১০ থেকে মে ২০১১– কৃষিতে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে ৪৫.৮৩  শতাংশ হারে। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০১০-১১ সালে ধানের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। তুলোর খরচ বেড়েছে ১৮.৭৮ শতাংশ। ডালের খরচ বেড়েছে– নয় থেকে বারো শতাংশ। তৈল বীজের দাম বেড়েছে– ৩০ শতাংশ। ঠিক এই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতা একবার দেখুন। এই সরকার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে–?? তথ্য কি বলছে দেখা যাক। গত ১৪/০৩/২৩ তারিখে লোকসভায় কৃষি, পশুপালন, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি, একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। সেই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি মন্ত্রক দপ্তর ৪৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০– ২১ অর্থর্বর্ষ থেকে এ পর্যন্ত তিনটি আর্থিক বছরে যথাক্রমে ২৩৮২৪ কোটি ৫৪ লক্ষ, টাকা, ৪২৯ কোটি ২২ লক্ষ টাকা এবং ১৯, ৭৬২ কোটি ৫ লক্ষ টাকা কোষাগারে ফিরিয়ে দিয়েছে কৃষি মন্ত্রক। মূলত উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি– তফসিলি জাতি সাব প্ল্যান এবং আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার সাব প্ল্যানের অর্থ খরচই হয়নি। কিন্তু চলতি অর্থবছরে কৃষিমন্ত্রক ২২,২৪৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত বাজেটের দাবি পেশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯,৭৬২ কোটি টাকা খরচই করা হয়নি। এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই বিপুল পরিমাণ টাকা তফসিলি জাতি ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় খরচ হল না, তারজন্য সরকারের অপদার্থতা বলা যাবে –নাকি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। খুব সচেতনভাবেই রাজনৈতিক কারনেই, ইচ্ছকৃতভাবেই ঐ টাকা খরচ করা হয়নি। আর তার জন্যই কৃষক ও দিনমজুরের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণত তফসিল জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই দিনমজুরের সংখ্যা বেশি। 

আমাদের দেশে যত মানুষ আত্মহত্যা করেন তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন দিনমজুর। সম্প্রতি সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯–২০২১ সালের উক্ত তথ্য পেশ করেছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো যে তথ্য পেশ করেছে,তা হলো ২০১৪ সাল থেকেই দিনমজুরদের আত্মহত্যার সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এই আত্মহত্যা বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১সালে প্রতিদিন গড়ে ১১৫ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করছেন। ২০১৯ এর তুলনায় ২০২১ এ আত্মঘাতী শ্রমিক এর সংখ্যা বেড়েছে ১২ হাজার। ২০১৬ সালের পর এনসিআরবি কৃষকদের আত্মহত্যার কারণ এবং তার সংখ্যা দেখানো বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কৃষকদের ও খেতমজুরদের আর্থিক সংকট ও ঋণগ্রস্ততা আত্মহত্যার প্রধান কারণ এটা বলা যেতেই পারে। দশজনে ছয়জনই সেই কারণেই আত্মঘাতী হয়েছেন। কবে এই আত্মহত্যা বন্ধ হবে? আর এস এস পরিচালিত বি জে পি সরকার কৃষকদের স্বার্থরক্ষা তো করেই নি, উপরন্তু কৃষি ক্ষেত্রে আক্রমণের গতিধারা ক্রমশ বাড়ছে। এই আক্রমণের গতিধারাকে রুখতেই হবে।

      [তথ্য সংগৃহীত]