সালকিয়ার বামপন্থীদের শান্তিমিছিলে পুলিশের হামলা করার পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতি না বোঝার কোন কারণ নেই। সাম্প্রদায়িক অশান্তির বিরুদ্ধে  প্রায় সাতহাজার মানুষের মিছিল ধর্মের নামে বিদ্বেষমূলক বিভাজনের রাজনীতির মুখোশ খুলে দিতে  রাস্তায় নেমেছেন -এই ব‍্যপারটা প্রত‍্যাশিত ছিল না তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। সাগরদিঘীর উপনির্বাচনে সাম্প্রদায়িক তাসের ব‍্যর্থতা যে নেহাতই ব‍্যাতিক্রমী ঘটনা নয় তা পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে ৯ ই এপ্রিলের হুগলী জেলার  কোন্নগর থেকে উত্তরপাড়া এবং ১০ ই এপ্রিলে হাওড়া জেলার  সালকিয়া মোড় থেকে পিলখানা মোড় পর্যন্ত মিছিলের জমায়েত দেখেই বুঝতে পেরেছে শাসকদল আর সেই কারণেই সিপিআই(এম) এর পলিটব্যুরোর সদস্য তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে এগিয়ে চলা  মিছিল শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ব‍্যারিকেড রেখে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। মিছিলে ঝাণ্ডা লাগানো ম‍্যাটাডোরের কাচ লাঠি দিয়ে ভেঙে দেয় শাদা ইউনিফর্ম ও হেলমেট পরা সরকারি শান্তি রক্ষকরা।

মহম্মদ সেলিম কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়,লাঠি চালানো হয় বামকর্মীদের ওপর! প্রতিবাদে পথে বসে পড়ে অবরোধ করেন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁরা ছিলেন মিছিলের অন‍্য অংশে। এমনিতেই মিছিলের বিপুল জনসমাগমে এলাকায় সাড়া পড়েছিল তেমনি এই প্রতিবাদী  অবরোধেও চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে পথচলতি মানুষের মধ‍্যে।

অনুমতি থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কোন যুক্তিতে মিছিল আটকালো এই ক্ষোভ শুধু মিছিলে অংশগ্রহণকারী বামকর্মীরা নন সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করা শুরু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ৩০শে মার্চ শিবপুরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেওয়ার দু দিন পরে ২রা এপ্রিল শিবপুরে বামপন্থীদের শান্তি মিছিল আটকে দেওয়া হয়।

পেটে ভাত যোগানোর নিশ্চয়তা না থাকলে কি হবে,পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল ও কেন্দ্রের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি আধাপেটা বা ভুখা পরিবারের উনিশ বছর বয়সী ছেলের হাতে পিস্তল তুলে দিয়ে ধর্মীয় মিছিলে হাঁটিয়ে দিতে পারে,ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে হিংসা ছড়িয়ে দিতে। রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তী তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির কর্মসূচির মধ‍্যেই অন্তর্ভুক্ত। মানুষকে আঘাত করে রক্তপাত ঘটাতে পারে এমন অস্ত্র নিয়ে মিছিল তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনে পরিবর্তিত পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে  বিজেপির কল‍্যাণে দেখা গেছে। পুলিশ সে সব মিছিলে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে  বাধা দেয়নি। ক্বচিৎ কদাচিৎ প্রশাসন আপত্তি করলেও দিলীপ ঘোষ শুভেন্দু অধিকারী,সুকান্ত মজুমদারেরা তাতে পাত্তা দেন নি। তাঁদের প্ররোচনায় গেরুয়া পোশাকের রক্ততিলক কপালে রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদীদের  হিংস্র সাম্প্রদায়িক শ্লোগানও বাজারি  মিডিয়া প্রচার করে। গত রামনবমীর দিনেও তার অন‍্যথা হয়নি। অস্ত্র নিয়ে বিশ্বহিন্দু পরিষদের পতাকাধারী বিজেপি ও আর এস এস কর্মীদের মিছিলে বাধা দেয়নি পুলিশ। সালকিয়ার তরুণ সুমিত সাউ যে কখনও তৃণমূল কখনও বিজেপির ছত্রছায়ায় থাকে, তাকে পিস্তল হাতে শিবপুরের  রামনবমীর মিছিলে দেখা গিয়েছিল। পিস্তল হাতে সুমনের ছবি ভাইরাল হতেই সে পালিয়ে যায় মুঙ্গেরে। কি আশ্চর্য তৃণমূল মুখপাত্ররা মুঙ্গেরের সশস্ত্র বাহিনী এসে শিবপুরে অশান্তি করেছে এই মর্মে সাংবাদিক সম্মেলন করার কয়েক ঘন্টার মধ‍্যেই দেখা গেল ৪ঠা এপ্রিল মুঙ্গের থেকে গ্রেফতার হয়েছে সালকিয়ার ছেলে সুমিত সাউ। “রাজনৈতিক চাপান উতোর “বলতে বাজারি মিডিয়া যা ই বুঝে থাকুক, আমরা দেখলাম সুমন সাউয়ের কাছে পাওয়া পিস্তলটি “খেলনা ” বলছেন বিজেপির রাজ‍্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এবং সুমিতের মা। এবং আরও অবাক করা কাণ্ড যে, সুমিতের মা বলছেন তাঁর ছেলে তৃণমূল কংগ্রেস করে অথচ তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ, রাজ‍্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা সুমিতকে বিজেপি কর্মী বলছেন এবং সুকান্ত মজুমদারও যেন সে কথাই সমর্থন করছেন। কিন্তু মোটের ওপর দেখা গেল ৩০শে মার্চ শিবপুরেও যেমন গরীব নিম্নবিত্ত এলাকায় রামনবমীর অস্ত্রমিছিল করতে বাধা দেয়নি পুলিশ তেমনি রামনবমী পেরিয়ে গেলেও ২রা এপ্রিল  রিষড়ায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে রামনবমীর নামে  মিছিল গরীব শ্রমিক বসতি দিয়ে যাওয়ার সময় প্ররোচনামূলক পরিস্থিতি তৈরি হয় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার কারণেই। সম্ভবত দিলীপ ঘোষ যাতে গরম গরম বিবৃতি দিতে পারেন।

গতকাল সালকিয়াতে অবরোধ থেকে বক্তব্য রাখার সময় প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু যথার্থভাবেই স্মরণ করেছেন প্রয়াত কিংবদন্তি জ‍্যোতি বসুর সেই অমোঘ সত‍্য ভাষণ “সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয়না! তাঁর অভিজ্ঞ চোখে যা ধরা পড়েছে স্থানীয় মানুষও তাই বলেছেন, ;রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে বলেই অশান্তি ছড়িয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের জমে ওঠা ক্ষোভ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন‍্যই সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরিকল্পনা সন্দেহ নেই। গত ৯ ই এপ্রিল কোন্নগরের সভায়  মহম্মদ সেলিম ব্রিটিশ আমলে  কানপুরের চটকলের শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন করলে মালিকপক্ষ ও সরকারের উস্কানিতে ধাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ঐ একই সভায় বিমান বসু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সাতষট্টি সালে তেলেনিপাড়ায় সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় তৎকালীন উপ মুখ‍্যমন্ত্রী জ‍্যোতি বসু গভীর রাতে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দাঙ্গাবাজদের গুলি চালাতে। পঞ্চান্ন বছর  পরে বিপুল সংখ‍্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার চালানো মুখ‍্যমন্ত্রী দাঙ্গাবাজদের হাতে সংবেদনশীল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে সংবাদ মাধ‍্যমে বিবৃতি দিচ্ছেন দাঙ্গাবাজেরা বন্দুক পিস্তল বুলডোজার ট্র‍্যাকটর নিয়ে মিছিল করেছে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে  পুলিশী ব‍্যর্থতা থিনি স্বীকার করে নিয়েছেন। যা বলেন নি তা হল, এই ব‍্যর্থতাও ঘটেছে তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই। নয়ত বিজেপিকে এই পশ্চিমবঙ্গে বাঁচাবে কে?