‘ক্ষুধার চরম জ্বালায় বেপরোয়া হয়ে উপোসি মানুষ রুটি ছিনতাই করলে তাকে রাজনীতি বলা হতে পারে কিন্তু তার মুখের খাবার কেড়ে নেওয়া যত বড় রাজনীতি তার চেয়েও কুৎসিত রাজনীতি খাবারের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা। গত ৪ ঠা নভেম্বর ধর্মতলায় গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বঞ্চিত যোগ‍্য চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিবাদী অবস্থানের ছশো দিনের মাথায় তাঁদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এই লড়াই না জিতে তাঁরা ফিরবেন না!  বিশেষত মহিলা চাকরি প্রার্থীদের  রাজ‍্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল তা রীতিমতো বিস্ময়কর মনে হচ্ছিল। কারণ মাত্র কয়েক বছর আগে এঁদের কেউ কেউ নিয়োগ নিয়ে  মুখ‍্যমন্ত্রীর  সামান্য আশ্বাসেই সংবাদমাধ্যমের ক‍্যামেরার সামনে জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন।  অভিজ্ঞতা তাঁদের শিখিয়েছে মমতা ব‍্যানার্জি ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের পুরো রাজনীতিটাই প্রতারণার। 


একটু দেরিতেই বঞ্চিত টেট ও এস এস সি উত্তীর্ণ  চাকরি প্রার্থীদের জন‍্য বামপন্থীদের সংহতি মিছিল শুরু হয়েছিল শুক্রবার দুপুরে। সপ্তাহের শেষে পুরো কাজের দিন তাই একটি বড়ো অংশের ছাত্র যুব এবং বিভিন্ন পেশায় যুক্ত কমরেডদের পৌঁছাতে একটু সময় লেগেছিল। সকালেই খবর এসেছিল ছাত্র আন্দোলনের প্রাক্তন নেতা কমরেড ডাঃ অনির্বাণ হাজরার অকাল মৃত্যু সংবাদ। যুব কমরেডদের অনেকেরই মুখে বিষাদের ছায়া। তা সত্ত্বেও  সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের অবস্থানে যাওয়ার জন‍্য মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন সবাই। অবশ্যই বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে  দাবি সম্বলিত প্লাক‍্যার্ড বিলি করছিলেন কমরেড ইন্দ্রজিৎ ঘোষ,প্রথম থেকেই যিনি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গী। মিছিল শুরু হতেই চেনা শ্লোগান “চোর ধরো জেল ভরো!” এবং “অবিলম্বে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগপত্র দিতে হবে -” “ধরছো ধরো চুনোপুঁটি আসল চোর হাওয়াই চটি “! ছাত্রছাত্রীদের শ্লোগান শুনে মুচকি হেসে যাদবপুরের এক প্রাক্তন যুব নেতা বললেন,”এইসব তাৎক্ষণিক শ্লোগানের ভাষা সময়ের সঙ্গে পাল্টাচ্ছে।” পাশ থেকে এক মধ‍্যবয়স্কা মহিলা কমরেড মন্তব্য করলেন, এই কথাটা এখন তৃণমূল কর্মীরাও জানে, নবান্নের চৌদ্দতলায় দুর্নীতির আসল উৎস।” অপেক্ষাকৃত তরুণ এক কমরেড বললেন “কতগুলো মামলা হল বলুন তো! সব ক টা মামলায় হার তবুও কি সংশোধন হল কেউ?”


মামলার পাহাড় কাকে বলে শুধুমাত্র শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোগ‍্যতা থাকা সত্ত্বেও  চাকরি প্রার্থীদের করা বিভিন্ন মামলার সংখ‍্যা দেখে বোঝা যায়। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসবার পর পশ্চিমবঙ্গে তিনবার টেট পরীক্ষা হয়েছে। ২০১২ সাল, ২০১৪ সাল ও ২০১৭ সাল। ২০১২ সালের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টেট পরীক্ষা হয় সে বছরেই,২০১৪ সালের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে টেট পরীক্ষা হয় ২০১৫ সালে এবং ২০১৭ সালের বিজ্ঞপ্তি জারি করে টেট পরীক্ষা হয় ২০২১ সালে। প্রথম দুর্নীতির অভিযোগ আদালতে আসে ২০১৮ সালে। ২০১৪ সালের ফলাফলের দ্বিতীয় দফার তালিকার  দুর্নীতি নিয়ে মামলা হয় সে বছর। মামলাকারীরা অভিযোগ করেছিলেন সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ভুল ছিল।  পরবর্তীকালে সেই ভুল প্রশ্নের উত্তরে নম্বর দেওয়া হলেও নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন  নিয়ম মানা হয়নি। বহু অযোগ্য প্রার্থীকে নম্বর বাড়িয়ে যোগ‍্য বানিয়ে দেওয়া হয়। মোট ২৭৩ জনকে বাড়তি নম্বর দিয়ে এই বাড়তি এক নম্বর দিয়ে নিয়োগ করা হলেও অভিযোগ ওঠে বহু যোগ‍্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন এবং অনেকেই শাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। অবস্থানরত চাকরিপ্রার্থীদের মুখেই শোনা যাচ্ছে পার্থ চ‍্যাটার্জী ও মানিক ভট্টাচার্যের দুর্নীতির কথা।পার্থ চ‍্যাটার্জী যে একশোজন এজেন্ট মারফত টাকা তুলে চাকরি দিতেন এ কথা এখন হাওয়ায় ভাসছে।

দমদমের পার্টিনেত্রী গোপা দাশগুপ্ত বিস্মিত অবস্থান স্থলে ২০০৯ সালের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের দেখে। জানা গেল ক্ষমতায় আসার পরেই ২০০৯ সালের  বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা হয় এবং ২০১৪ সালে নতুন করে তাঁদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। অন‍্যান‍্য জেলাতে নিয়োগ হলেও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় নিয়োগ হয়নি। ১৩ বছর যাবৎ সরকারের আশ্বাস নিয়ে এই চাকরিপ্রার্থীরা বসে আছেন। মিছিলে আসা  একজন ছাত্রী মন্তব্য করলেন, এই দাদা দিদিরাও নিশ্চয়ই মমতা ব‍্যানার্জিকে বার বার সমর্থন করেছেন, ওঁর কোন কৃতজ্ঞতাবোধ বা দায়বদ্ধতা নেই। ” ঠিক তখনই ছোট ম‍্যাটাডরেশোনা গেল সিপিআইএম এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য সম্পাদক কমরেড  মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য ” আমরা বামপন্থীরা এই অবস্থানে না এলে মুখ‍্যমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রী কেউ আসতেন না এই চাকরিপ্রার্থীদের কাছে।  কোর্টের অনুমতি নিয়ে এই অবস্থানে বসতে হয়েছে  যোগ‍্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত এই ছেলেমেয়েদের।”
উত্তাল শ্লোগান চলছিল ছয়শো দিনে পা রাখা এই অধিকার বুঝে নেওয়া অবস্থান স্থলে। কমরেড বিমান বসু অভিভাবকের মতোই বসেছিলেন ওঁদের পাশে। মিছিল পৌঁছনোর অনেক আগে থেকেই  এখানে ছিলেন কমরেড মহম্মদ সেলিম। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী পক্ষের  সব রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরাই কম বেশি এই অবস্থানে এসেছেন। কিন্তু বামপন্থীরা যেভাবে বিশাল মিছিল নিয়ে সংহতি জানাতে বার বার অবস্থানে  এসেছেন তা প্রকৃতপক্ষে নজির বিহীন। 


কিন্তু মুখ‍্যমন্ত্রী ও শাসকদলের নেতা নেত্রীরা  তো বার বার বলেছেন তাঁরা নাকি এই আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল? ঝাঁঝিয়ে উঠলেন এক চাকরিপ্রার্থী, সহানুভূতিশীল হলে কখনও মাঝরাতে পুলিশ দিয়ে টেনে হিঁচড়ে তুলে দিতেন করুণাময়ীতে? সহানুভূতিশীল হলে অভিষেক ব‍্যানার্জীর অফিসের সামনে আমরা পুলিশের মার খেতাম? কিছুই ভুলিনি আমরা।” ২০১৩ সাল থেকে এস এস সি চাকরিপ্রার্থীরা প্রেস ক্লাবের সামনে অনশনে বসেছিলেন ২৯ দিনের জন‍্য। মুখ‍্যমন্ত্রী মমতা ব‍্যানার্জী তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জীকে নিয়ে সেই অনশনস্থলে পৌঁছে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিতে অনশন প্রত‍্যাহার করেন আন্দোলনকারীরা। তার পরেও দু বার মুখ‍্যমন্ত্রী চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনবারেই নিয়োগপত্র পান নি বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা। ঘুরে ফিরে আসছিল আইনজীবী  বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য,ফিরদৌস শামিম ও বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম। স্পষ্টই বললেন আন্দোলনকারীরা, এঁরা না থাকলে নিয়োগ দুর্নীতি সামনে আসত না। সারদা রোজভ‍্যালি, নারদা ঘুষ কাণ্ডের মতোই সিবিআই তদন্ত মাঝপথেই চাপা পড়ে যেত। একেবারে শেষে অবস্থানস্থলে অভিনীত হল ভারতীয় গণনাট‍্য সংঘ লোক ও শিল্পী শাখার পথ নাটক “সাইরেন “তখন সূর্য ডোবার পালা। কিন্তু দীর্ঘ যুদ্ধের পাঞ্চজন‍্য বেজে উঠেছে বঞ্চিত যৌবনের আন্দোলনে। সাইরেনের আওয়াজের মতোই সচকিত করছে এই সময়ের নাগরিকমননকে।