এস ইউ সি দলের নেতা দেব প্রসাদ সরকার প্রয়াত  হয়েছেন ।বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ ৩৪  বছর শাসনকালের  সময় ধরে তিনি তাঁর দলের প্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য  ছিলেন ।দীর্ঘ ৩৪  বছরে এস ইউ সি দলের পক্ষ থেকে কখনো প্রবোধ পুরকাইত বিধায়ক হয়েছেন , আবার খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর প্রবোধ পুরকাইতের জেল ইত্যাদি ঘটনার প্রেক্ষিতে দেবপ্রসাদ বাবুকে একাই বিধানসভার অভ্যন্তরে তার দলের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়েছে।                   

বিধানসভা কক্ষের অভ্যন্তরে তিনি বামফ্রন্টের সমালোচনায় মুখর থেকেছেন।ফ্লোর  এডজাস্টমেন্টের  ক্ষেত্রে কংগ্রেস দলের সঙ্গে কখনো যে তিনি যান নি এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না ।তবে বিধানসভা কক্ষের ভেতরে কখনো বামফ্রন্ট সরকারকে রুচিহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ একটিবারের জন্য তিনি করেননি ।শীর্ণদেহী ,  ধুতি-পাঞ্জাবি পড়া দেবপ্রসাদ বাবু একটু খারখরে  গলায় সরকারের সমালোচনা করছেন , সেই সমালোচনা কিন্তু জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রত্যেকটি মন দিয়ে শুনছেন– এটা বাম আমলের বিধানসভার একটা অভ্যস্থ চিত্র ছিল।               

আসলে বিধানসভা টা তখন ছিল মূলত বিরোধী কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হওয়ার একটা জায়গা। সরকারপক্ষ বিধানসভা কে দলীয় কার্যালয়ে আজকের মত সেদিন কিন্তু পরিণত করেন নি। সেই কারণেই বামফ্রন্ট সরকারের বা সেই ফ্রন্টের প্রধান শরিক সি পি আই(এমে) র দোর্দণ্ডপ্রতাপ ঘিরে যতই গল্পকথা থাকুক না কেন, ওই দীর্ঘ ৩৪  বছরে নির্বাচনী সংগ্রামের ক্ষেত্রে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ কতখানি বজায় ছিল ,তার জ্বলন্ত প্রমাণ হল, কোনরকম ধারাবাহিকতা তে চ্ছেদ  না করেই দেবপ্রসাদ বাবুর একটানা নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা।             

এই গণতান্ত্রিক পরিবেশ বামফ্রন্ট সরকারের  আগেও কখনো কল্পনা করতে পারা যেত না , আর আজ বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তো এটা একটা স্বপ্নীল মায়া ।বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে কতখানি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বামফ্রন্টের আমলের  প্রথম স্পিকার সৈয়দ মনসুর হাবীবউল্লাহ বা পরবর্তী  দীর্ঘসময়ের  স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম ,তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলেন এই দেবপ্রসাদ সরকার ।               

সেই সময়ের বিধানসভার  অধিবেশন প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে ,  তাঁদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে যে, এস ইউ সি  দলের একজন মাত্র প্রতিনিধি  বা কখনো কখনো দুজন প্রতিনিধি থাকা সত্বেও ,সেই দলটির জন্য সময় বরাদ্দের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বিধানসভার কোন স্পিকারই এতোটুকু কার্পণ্য করেননি। জানিনা আজ সংযুক্ত মোর্চার   ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী কে বর্তমান অধ্যক্ষ সেদিনের মত সুযোগ আইনসভার কক্ষের মধ্যে দেন কিনা।               

গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো বজায় রাখবার যে প্রক্রিয়ার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন দেবপ্রসাদ বাবু , সেই প্রক্রিয়াকে তিনি বা তাঁর দল বামফ্রন্টের আমলে ই হোক বা পরবর্তীকালে হোক, কখনো সেভাবে যোগ্য মর্যাদা ,যোগ্য স্বীকৃতি দেননি ।তাঁরা স্বীকৃতি না দিলেও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে আইনসভার ভেতরে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে , সরকারের গঠনমূলক সমালোচনার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা বামফ্রন্টের আমলে  স্পিকারেরা নিয়েছিলেন তা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ইতিহাসে একটা বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকবে ।                 

বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে কংগ্রেস সহ সমস্ত বিরোধী দলই নির্বাচনী সংগ্রাম নিয়ে অনেক ধরনের গাল গল্পের অবতারণা করে থাকে। সেইসব গালগল্পের যথার্থ এবং যোগ্য জবাব হলেন এই দেবপ্রসাদ সরকার ।বামফ্রন্ট সরকারের আমলে সীমিত রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়েও এস ইউ সি  এর মত একটি ছোট রাজনৈতিক দল ,যাঁরা বামফ্রন্ট বিশেষ করে সি পি আই(এমে)র সমালোচনাকে ই  তাঁদের একমাত্র রাজনৈতিক মূলধন করেছিলেন,  তাঁরাও যে অঞ্চলে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি ছিল,  সেই অঞ্চল থেকে কি দ্বিধাহীনভাবে নির্বাচনী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে ,ধারাবাহিকতার সঙ্গে বিধানসভার সদস্য করতে পেরেছিলেন ।সেই দৃষ্টান্তটি পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক সীমারেখাকে অতিক্রম করে গোটা ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরকালের জন্য ।আজ যখন কেন্দ্রে শাসক আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি বা তাদের গোপন বন্ধু, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার ধারক ও বাহক তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধী বিহীন রাজনীতিকে গণতন্ত্রের একমাত্র পরিকাঠামো হিসেবে তুলে ধরছে ,  তখন দেবপ্রসাদ বাবুর মৃত্যু অব্যবহিত পরে বামফ্রন্টের দীর্ঘ ৩৪  বছর শাসন কালে র ধারাবাহিকতার সঙ্গে ,দেবপ্রসাদ বাবুর জয়নগর কেন্দ্র থেকেও ধারাবাহিক ভাবে  জয়লাভ করবার ঘটনাটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হিশেবেই চিহ্নিত করতে হয়।