আবার মিথ্যাভাষণ! শিলিগুড়ির কাছে কাওয়াখালিতে বুধবার বিজয়া সম্মেলনীর অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণে দাবী করলেন, “টাটাকে আমি তাড়াইনি, সি পি এম তাড়িয়েছে।’। ২০০৮ এর ৪ অক্টোবর আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় হেডলাইন “ন্যানো নেই রাজ্যে, মমতার জন্যই সিঙ্গুর ছাড়লাম রতন টাটা”। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ এত বছর পর সিঙ্গুরের কারখানার প্রসঙ্গে কেন এই কথা বললেন? উদ্দেশ্য একদমই রাজনৈতিক। খুব সচেতনভাবেই তিনি এই কথা বলেছেন। কারণ, মমতা ব্যানার্জীর সরকারের এখন যা হাল, বিশেষ করে, শিক্ষা দপ্তরটাই এখন প্রায় জেলবন্দী। ঝাড়-জল উপেক্ষা করে চাকরীপ্রার্থীরা আন্দোলন চালিয়েই যাচ্ছেন। রাজ্যে বিক্ষোভ আন্দোলন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝেই তিনি ঐ কথার অবতারণা করলেন মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য। বহুদিন আগে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলে গেছেন, “মিথ্যারও মহত্ব আছে, হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্য সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।”
সচেতন নাগরিক হিসাবে সরকারি প্রতিশ্রুতি ও মিথ্যাচারকে খণ্ডন করে সত্যিটা মানুষের সামনে উপস্থিত করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি সেইজন্যই কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। নাহলে মমতার এই মিথ্যা কথাটাই মানুষ বিশ্বাস করবে। নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের বিষয়ে গভীর চক্রান্ত করে মিথ্যার জাল বিস্তার করা হয়েছিল।

সেই চক্রান্তকে দেখানোর অপচেষ্টা করা হয়েছিল জনগণের আন্দোলন হিসাবে। কিন্তু স্বচ্ছ ভাবমূর্তির জননেতা, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচাৰ্য্য, বিরোধী নেত্রীর দাবী মেনে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ তদন্তের পর সিবিআই যখন চার্জশীট পেশ করে, সেই সময়ের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। চার্জশীট ইতিমধ্যে স্যোশ্যাল মিডিয়ায় ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে যা সুপারিশ ছিল, মুখ্যমন্ত্রী সচেতনভাবে সেটাকে উপেক্ষা করে গেছেন। তৎকালীন সময়ে যা প্রচার করা হয়েছিল, চার্জশীটের বয়ান অনুযায়ী, তা সর্বৈব মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ এখন সত্যটা ক্রমশ জেনে যাচ্ছেন। তাই নতুন টোটকা হিসাবে মমতার ঐ মিথ্যা ভাষণের আমদানী।


২০০৮ এর ২৮ আগষ্ট, সন্ধ্যাবেলায় বহিরাগতদের দিয়ে টাটা প্রকল্পের গেট আটকে কর্মরত ইঞ্জিনীয়ার ও কর্মীদের নিগৃহীত করে হুমকি দেওয়া হয়, পরদিন থেকে তাঁরা যেন কাজে না আসেন। আর, তার জেরেই প্রকল্পের গেট চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। “পুলিশ দিয়ে তো প্রতিদিন কারখানা চালানো যায় না”- বলে টাটারা চলে যান গুজরাটে। কিন্তু কার স্বার্থে সেদিন মমতা ট্রিগারে চাপ দিয়েছিলেন? ৬ অক্টোবর ২০০৮, আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হয়েছিল, “কৃষকের স্বার্থ, অথবা কৃষির প্রতি অকৃত্রিম প্রেম, কোনটিই তাঁহার ছিল না……। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও দায়িত্বের রাজনীতি করেন নাই।” রাজনীতির হাতেখড়ি থেকেই তিনি দায়িত্বহীন ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালীন ২ এপ্রিল ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির উপর হামলা হয়েছিল। নেতৃত্বে তৎকালীন ছাত্রনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি অনুযায়ী)। উনি যদি দায়িত্বশীল হতেন, তাহলে ছাত্রী নেত্রী থাকাকালীন তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণের গাড়ির হুডে, কখনও দাঁড়িয়ে কখনও বসে বিকৃত মানসিকতা নিয়ে অঙ্গভঙ্গী করতে পারতেন না। একেবারেই বলা যায়, ঘটনাটি অসভ্য, সৌজন্যহীন ও বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক। ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ৭০ বার বাংলা বনধ ডেকেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার উনিই এখন বন্ধের বিরোধিতা করেন। আপাদমস্তক দ্বিচারিতা পূর্ণ। বিধানসভায় ঢুকে সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ভাঙচুর এর যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন তা সভ্যতার কলঙ্ক। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও অনেকবার অভব্য আচরণ করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন, তা দায়িত্বহীন তো বটেই। ওনার দায়িত্বহীনতার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।


সিঙ্গুরে সেইদিন যে দায়িত্বজ্ঞানহীন (টাটাকে তাড়িয়ে) কাজটা মমতা করলেন, সেটা কার স্বার্থে? জমি ও কৃষকদের প্রতি প্রেমে পড়ে, কৃষকদের জন্য মমতা ব্যানার্জীর দরদ উথলে উঠেছিল? প্রকৃত প্রেম ও দরদ কাদের প্রতি ছিল সে সম্পর্কে ‘দ্য টাইমস অব ইণ্ডিয়া, ২৯ আগষ্ট ২০০৮’ প্রকাশিত এক খবরে লেখা হয়েছিল, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিঙ্গুর ধর্ণা-অবরোধ কর্মসূচীতে যোগদানের জন্য প্রতিদিন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন যানবাহনে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে আসা ও ফিরে যাওয়া, তাদের খাওয়া-দাওয়া, তার জন্য রান্নার যাবতীয় ব্যবস্থা করা, মঞ্চ-বাঁধা ও চেয়ার-টেবিলের বন্দোবস্ত করা, মাইক ভাড়া – সবকিছু মিলিয়ে ইতিমধ্যে দশ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে, আরও হবে।” এই সংবাদেই প্রশ্ন ছিল, “কে বা কারা যোগাচ্ছে এই টাকা?” দ্য টাইমস অব ইণ্ডিয়া-র উপরোক্ত সংবাদে তার স্পষ্ট ইঙ্গিতও পাওয়া গিয়েছিল। রতন টাটা নিজেও সেই সময় এক সাংবাদিক বৈঠকে একই ইঙ্গিত করেছিলেন।


এর থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়, টাটা মোটরসকে বাংলা ছাড়া করার জন্য মমতা সেদিন যে ট্রিগার টিপে দিয়েছিলেন, তার উদ্দীপক ছিল সিঙ্গুরের জমিহারা কৃষকরা নন, ছোট গাড়ির বাজার হারানোর ভয়ে ভীত টাটার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এক ছোট গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানী। আরও একটি কারণ হল, বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার নীতির ফলে কৃষির বিকাশ যেভাবে ঘটেছিল, তার সাথে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সহ সার্বিক অগ্রগতির ফলে দ্রুত গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটছিল। সেই সময়েই ২৭ হাজার কোটি টাকার শিল্প সামগ্রী কেনার চাহিদা বেড়েছিল। ফলে, শিল্পের বিকাশের জন্য এবং কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে সিঙ্গুরের টাটা মোটরসের কারখানা শুরু হল। কারখানাটি যদি হতো, তাহলে, বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হতো, শিল্পায়নে গতি আসতো এবং পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় বামফ্রন্ট সরকারের জনপ্রিয়তা আরও বাড়তো, সঙ্গে সঙ্গে তার স্থায়ীত্ব আরও বেড়ে যেত এবং অন্যান্য রাজ্যেও এর প্রভাব পড়তো। ফলে সঙ্কটে পড়তো বিভেদকামী স্বার্থান্বেষী দুষ্টচক্রের চক্রান্তের জাল বিছানোর কাজ। এই রাজনৈতিক কারণেই একচেটিয়া পুঁজিপতিশ্রেণি ও ভূস্বামীরা এবং তার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মিলিতভাবে আমাদের দেশের চরম প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী শক্তি, সাম্প্রদায়িক শক্তি, এমনকি অতি বাম মাওবাদীরা পর্যন্ত এই কারখানার বিরুদ্ধে, জমি অধিগ্রহণকে ইস্যু করে কমিউনিষ্ট বিদ্বেষ থেকেই হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেছিল। বেছে নিয়েছিল বামভেকধারী মমতা ব্যানার্জীকে। আর এবিষয়ে খুল্লমখুল্লা সঙ্গত করেছিল বামফ্রন্টেরও দু-একটি শরিকদল।

এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধের কথা উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। সর্বভারতীয় সংবাদপত্র ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় ১৭ আগষ্ট ২০১২ তারিখের নিবন্ধের শিরোনামে “ম্যাকার্থিজম মমতার স্টাইল’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘মমতার ম্যাকার্থিবাদ’। ১৯৫০-৫৪ যোসেফ ম্যাকার্থি আমেরিকার উইসকনস্টিন প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সেনেটর বা সাংসদ ছিলেন…….. ১৯১৭ সালে ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’-এর পর আমেরিকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ওই রাশিয়ানরা আসছে…………. দ্বিতীয়বার যোসেফ ম্যাকার্থি তীব্র কমিউনিষ্ট বিদ্বেষ থেকে প্রচার শুরু করে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন যে, মানুষ সত্য-মিথ্যা বিচারের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। যেকোনো প্রতিবাদকে দেশদ্রোহী, আতঙ্কবাদী আখ্যা দিয়ে কণ্ঠরোধ করা হত। যুক্তিহীন, আদর্শহীন, মানবতাবিরোধী ভয়ঙ্কর এই প্রচারের প্রধান পুরোহিত ছিলেন সেনেটর ম্যাকার্থি। একসময় এই প্রচারের শিকার ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, পল রবসন এবং পল সুজি প্রমুখ সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ্‌গণ। এই প্রসঙ্গে লেখক অধ্যাপক বদ্রী রায়না মনে করিয়েছেন, ট্রুম্যান-এর বিখ্যাত উক্তি, — একটা স্বাধীন দেশে মানুষের শাস্তি পাওয়া উচিত তাঁর অপরাধের জন্য, কিন্তু কখনই তাঁর বিশ্বাসের জন্য নয়।”
এর পরই লেখক মমতার ম্যাকার্থিজিমের দিকে ফিরেছেন। উল্লেখ করেছেন, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার। মন্তব্য করেছেন, “মনে হয়, বৃদ্ধ ম্যাকার্থি তাঁর ব্যাটনটি আমাদের মমতাদির হাতে দিয়ে গেছেন।” তিনি উল্লেখ করেছেন, সরকারের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজের প্রশ্নের ঘটনা, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের বিষয় এবং সর্বশেষে গরীব কৃষক শিলাদিত্য গ্রেফতারের ঘটনা। কীভাবে গত নির্বাচনের আগে মমতা বললেন, ‘মাও ফাও কিছু নাই………। তাঁর মতে বিচার ব্যবস্থা ও বিভিন্ন কমিশনকে আক্রমণ সম্ভবত ম্যাকার্থি মানসিকতার সর্বোচ্চ নিদর্শন এবং এগুলোর সবটাই ঘটেছে ও ঘটছে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই।”


লেখক যথার্থভাবেই মমতা ব্যানার্জী সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনদিনই যুক্তি-তর্ক, নৈতিকতা ও সত্যের ধার ধারেন না। উনি যেটা বোঝেন, সেটাই বলেন ও করেন। সরকারও সেইভাবেই চলছে। বশংবদ ও চাটুকাররা সেভাবেই হাত তুলে যান। সেই জন্যই তো মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক প্রকাশিত অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে স্থান পায়-“কৃষি জমির অধিকার : সিঙ্গুর গণ আন্দোলন” এই অধ্যায়ে শিশু-কিশোরদের পড়ানো হচ্ছে মিথ্যাচারের কল্পকাহিনি। পরের পর্বে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়া ‘কৃষিজমির অধিকার : সিঙ্গুর গণ আন্দোলন’ নিয়েই বিশ্লেষণসহ সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
 (তথ্য সংগৃহীত)