২০১৯ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা ছিল ৮৮। স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল আগামী বইমেলায় সগর্বে সেঞ্চুরি হাঁকাবেন। যা বলেন, একটু বেশীই করেন। ২৭শে জানুয়ারী, ২০২০, রাত দশটা। টলিনালার টালি প্যালেসের উঠোনে পায়চারি করছেন প্রকাশক। দু ঘন্টা দূরে মঙ্গলবার। বুধবার বইমেলা। মঙ্গলের ঊষা, বুধে পা, যাহা ইচ্ছা লিখে যা। ঘরের ভিতর লম্ফ জ্বলছে, উথলে ওঠা বুকের বেদনা নিব বেয়ে ঝর্ণার মত নামছে। এত জ্ঞান, এত কথা, সামান্য নিবে কি নিভতে পারে? বছরের শেষ বইটা লিখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দরজা খুলল। এক ফালি আলো ছিটকে এল নাবাল উঠোনে। পান্ডুলিপি হাতে বেরিয়ে এলেন। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনা। মন্দিরের দুয়ার খুলে বেরিয়ে এলেন দেবী। ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রকাশক। ২৯শে জানুয়ারী, ২০২০, বুধবার, বই হিসাবে সিজারিয়ান ডেলিভারি হল। এতটা চমৎকারিত্ব তিনিও আশা করেননি। উদ্বেল তিনি। সেঞ্চুরি পার করে এক, ১০১। ৬টি বাংলা, ৬টি ইংরাজী এবং ১টি ঊর্দুতে, মোট ১৩টি কিতাব।

যত দূর মনে পড়ে রুশ রাষ্ট্রদূত কুদাশেভ নিকোলাই রিশাতোভিচকে রুশ ভাষায় সম্ভাষণ করলেন। রাজীব গান্ধীর সাথে রাশিয়ায় আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে গিয়ে ভাষাটা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন। খুব সম্ভব এখনও তিনি রুশ ভাষায় পুস্তক রচনা করেননি, তার কারণ এটা নয় যে তিনি রুশ ভাষা জানেন না। তাঁর রাজ্যে রুশ ভোটার নেই। মঞ্চে বিদেশী লেখক লেখিকারা উপস্হিত। তাঁরা মোবাইলে হিসাব করে ফিসফাস করছেন ২৮.০৭। অর্থাৎ গড়ে চার সপ্তাহে একটি বই লেখেন। তিনি সরকারী কোষাগার থেকে মায়না নেন না। রয়ালটিতে যেটুকু আয় হয় তাতে ভাত ভাত জুটে যায়। পেশাদার লেখকের এটা নিয়তি। আশ্চর্যের বিষয়, অবসরে তিনি গল্ফ না খেলে মুখ্যমন্ত্রীত্ব করেন। অথচ সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি দিবারাত্র পরিশ্রম করেও জনগনের অ্যাকাউন্টে পনেরো লাখ টাকা ফেরাতে পারেননি। নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরীকে তিনি বইমেলার বিবর্তন নিয়ে রম্য রচনা লিখতে বললেন। রবীন্দ্রনাথকে টপকে যাবেন এই ক্ষণজন্মা মহিয়সী। ২০১৭ সালে ৪১তম বইমেলায় মেলার পিঠে ৪১ ঘা হাতুড়ি মেরেছিলেন তিনি।

তারপর কোভিডের ভীতিতে প্রাঙ্গনে যাওয়া হয়নি। শুনেছি ৩ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরো ৩৫টি সোনার ডিম পেড়ে ১৩৬ নট আউট। মাঝে বিধানসভা ভোট থাকলেও সৃষ্টি সুখের উল্লাসে গড় মোটের উপর অব্যাহত ছিল। এবছর দেড়শো হবে ধরে নিয়েছিল আম জনতা। খুব সম্ভবতঃ সিবিআই, ইডি ও আদালতের মাননীয় বিচারকদের তৎপরতায় দলনেত্রীর উৎকর্ষতায় ঘাটতি থাকতে পারে। এবছর তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭টি। ফলে বাকি মাত্র ৭টি বই লিখলে দেড়শোর গন্ডী ছুঁয়ে ফেলবেন। মোদী দিল্লীর মসনদে থাকলে, সেটিং যথাযথ জারি থাকলে অবশ্যই আগামী বইমেলায় নিরলস সাহিত্যসেবী বাঙালির মুখে হাসি ফোটাবেন। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন। বিশ্ব সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার ভিন্ন এই প্রতিভার যথাযথ মর্যাদা রক্ষা অসম্ভব। আপামর বাঙালি সেই দিনটার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন। আমাদের মনে হয়, যখন কেউ ১.৮৪ কোটি টাকা দিয়ে তাঁর ছবি কেনেন, নিশ্চই তা দুর্মূল্য। যে মূল্য ঠাহর করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তেমনই তিনি নিরহঙ্কারী স্বর্ণপ্রসবা।

আমি যে এলাকায় থাকি, তার গলিঘুঁজি চিনি না। আজন্ম বাস করা মহানগর তো অনেক দূরের কথা। আজও নগরের প্রাচীণ গল্প শুনলে হাঁ করে শুনি। গুটি কয়েক দিন হেঁটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষিত ভাবে লন্ডনের প্রতিটি রাস্তা চিনে ফেলেছেন। তিনি যে দেশে পা দিয়েছেন, সেই জনগোষ্টীর ভাষা কন্ঠে ধারণ করেছেন সাবলীল ভাবে। বুঝতে পারা বা না পারা, শ্রোতার দুর্বলতা। হয়ত তিনি আগামী কালের ভাষায় কথা বলেছেন। যে কাজটা আমরা ভাবতেই পারি না, তিনি অনায়াসে করতে পারেন। সরণী ধরণী হয়ে যায় অবলীলায়। আমাদের চেয়ে এতটাই এগিয়ে আছেন যে রাজ্য-সঙ্গীতের সময়ে উঠে দাঁড়াতে হবে কিনা আমাদের মত অর্বাচীনরা সংবিধানের মোটা বইতে খুঁজছেন। অথচ সহজ সমাধান আছে হাতের মুঠোয়। শেখ শাহজাহানদের মত অন্তরের অন্তঃস্হল থেকে বিশ্বাস করতে হবে, তিনিই সংবিধান। অহং দেব অস্মি। তিনটে শব্দে দেবতা হওয়া যায়। একটাই সমস্যা, তার আগে লজ্জা, ঘৃণা ও ভয় ত্যাগ করে সন্যাস ধর্ম পালন করতে হবে। কোন সমালোচনা কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না।

আমাদের মধ্যবিত্ত চেতনা ও মনন লক্ষ্মণের গন্ডীর ভিতর আবদ্ধ করে রেখেছে। সীমাবদ্ধতায় ভাবতেই পারি না, রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর পরেও গান্ধীজীকে লেবুজল খাওয়াতে পারেন। সরকারী নথি অনুযায়ী ঘটনা সত্য, নয়ত সংশোধনী প্রস্তাব আসত। সরকারকে যদি মানতেই হয়, ঘটনাটাও প্রশ্নাতীত ভাবে স্বীকার নৈতিক দায়িত্ব, নয়ত দেশদ্রোহী। আমার পরিচিত বৃত্তে একজন ব্যক্তিকেও খুঁজে পাইনি যিনি ১৪৩টি পুস্তকের অন্ততঃ একটি আদ্যান্ত পড়েছেন। তাহলে বেস্ট সেলারের তালিকায় বইগুলি স্হান পায় কী করে? অর্থাৎ দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার পরিচিত সমাজ, যাঁদের প্রজ্ঞাবান ভাবতাম, তা সর্বৈব ভুল। গোড়ায় গলদের জন্য আজ কূপমন্ডূক হয়ে আছি। ইসরোর বিজ্ঞানীরা চন্দ্রযান আবিষ্কার করতে পারেন, কারণ মানুষ সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আবিষ্কার করা কাকে বলে জানেন। কিন্তু শুভনন্দন করতে আন্দোলনের লগ্নে জন্মাতে হয়। তাহলেই বাংলাদেশ ইজ দ্য বর্ডার অব পাকিস্তান হতে পারে। যে সাপ ফোনা তোলে তাকে কার্বলিক অ্যাসিডিটি দিলে কিস্যু হবে না। ভীরু জনতা ফোনা তোলাকে যমের মত ভয় পায়।

জন্মাবার সময়ের মায়ের ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেখবেন, ওজন দেড় হাজার কেজির কম হলে আপনার প্রতিভা নেই। কপালকুন্ডলা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র মাহেশের রথে রাধারাণীকে হারিয়ে ফেলেন। বাঙালি কুন্ডলিনীর দয়ায় কপাল হারাবে, আশ্চর্যের কী আছে? বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছেন শুধু নয়, রাস্তায় পোঁতা শিলাফলক দেখে মাইলও আবিষ্কার করেছিলেন। পূর্বের মানুষ হাত দিয়ে রাস্তা মাপত। শুনেছি, আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক সযত্নে রক্ষিত আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেন, সিপেমের আক্রমণে তিনি শতচ্ছিন্ন ও দেহের সর্বত্র অপারেশনে বিদ্ধ। বহু দেহাংশ বাদ দিতে হয়েছে। যদি ভাগ্যক্রমে মস্তিষ্ক থেকে যায়, তা রক্ষিত হোক। সেই মস্তিষ্ক ডিকোড করতে পারলে জানা যাবে, মস্তিষ্কের কোন অংশের বৈদ্যুতিন প্রক্রিয়ায় লজ্জানুভুতির উদ্রেক হয়। এতদঞ্চলে তার কাটা থাকবে। চাটুকাররা যেমন ঢোঁক গিলতে গিলতে হাসেন, তা অর্থবহ। একটি শিশুও বুঝবে ওরা মস্করা করছেন। কিন্তু নিরলস সাহিত্যসেবী এ সকল পার্থিব ভাবনার অনেক উপরে বাস করেন স্বর্গের কাছে।

ছোট বেলায় অমাবস্যার রাতে যত পেত্নী দেখা গেছে, সবাই সাদা শাড়ি পরে। পত্নীরা রঙীন। তারা সব পারেন। হেঁসেলে বসে হাত বাড়িয়ে লেবু গাছ থেকে লেবু পেড়ে আনে, কাঠের বিকল্পে উনুনে ঠ্যাং গুঁজে আগুন জ্বালায়। তারা সব করে দিতে পারে। এই লজিকটা এমন চরিত্র না দেখলে স্পষ্ট হত না। তবে স্বচক্ষে তেমন পেত্নীর দর্শন হয়নি। আমরা দেখিনি বলেই যে নেই, তেমনটা ভাবাও অনুচিত। ১৪৩টি বইয়ের কোন পান্ডুলিপি কি দেখেছেন? ২০২০ সালের ২৭শে জানুয়ারী যে প্রকাশক হাতে নিয়েছিলেন, সেটা কী ছিল? মাত্র ৩৬ ঘন্টায় একটি সম্পূর্ণ বাঁধান বই হয়ে স্টলের শোকেসে উবু হয়ে বসেছিল। প্রয়োজনে বইয়ের থেকেও পান্ডুলিপি বানানো যেতে পারে। হাতের লেখা যে মিলতে হবে, তেমনটাও নয়। শুনেছি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত একাধিক শ্রুতিলেখকের সাহায্যে এক সাথে বহু কাব্য রচনা করতে পারতেন। সুকুমার সমাজপতি ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক, ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্হ আধিকারিক ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তবু কোনটিতেই শীর্ষে ছিলেন না। তেমন উদাহরণ বিশ্বে কেবল মাত্র একটি আছে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাশের কর্তাব্যক্তিটির থেকে শেষ খবর নিয়ে কিন্তু বইয়ের সংখ্যা বলেন। বারো হাজারি বই থেকে সত্তর টাকার বই পাবেন। এক পলকে এক ঝলকে মজার ছড়া, আজব ছড়া। তবে যেটুকু শুনেছি সবটাই মজার, সবটাই আজব। বাংলা ছাড়াও ঊর্দু, সাঁওতালী, পাঞ্জাবী ও ইংরাজিতে বই লিখেছেন। ইংরাজীতে মমতা সংকলন পাবেন – Best of Mamata; দুটো পাঁচশ টাকা দিলে এক টাকা ফেরৎ পাবেন। ওটা যত্ন করে রাখবেন, নয়ত সবটাই ফক্কা। সাথে রেফারেন্স বই রাখতে পারেন। প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সংগ্রাম যেমন দেখেছি, নেত্রীর সাথে জনতার পাশে। বইরাজ্যে নৈরাজ্য। মৃদু রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না। প্রেসিডেন্সি জেলের গারদ খুব সম্ভবতঃ লোহার। তমান্না হলে ইনসাফের হিম্মতের খুশবু পাবেন। সবটাই ঊর্দুতে, পার্থ জানেন না। নেত্রী যখন ঊর্দিস্তানে গিয়েছিলেন, তখন শিখে নিয়েছেন। কুণালের ভরসা তিনি ২০৩৬ অবধি মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন। মানে লিখবেন। আর কয়েক বছর তিনি সচল থাকলে এই বইমেলা অচল হয়ে মমতামেলা হয়ে যাবে।

ভিড় ঠেলে খোঁজ করি, উডাবার্নে অতিথিসেবা- বইটা আছে? দোকানাদার না ঘাবড়ে কর্মচারীকে হুকুম দিলেন, লিখে রাখ। আমাকে বললেন, আগামী বছর পেয়ে যাবেন। খদ্দের যেমন চান, তেমনটাই নাকি লিখে ফেলেন। তিনি জনতার পাল্স বোঝেন। মেঘালয়ের ভাষা খুব সুন্দর। আজও কানে বাজে- কাঁকুঁউঁ। খাসী ভাষায় বই নেই? গোয়ানিজ? এ বছর আমরা একটা স্প্যানিশ ভাষার বই আশা করেছিলাম, কিন্তু শিল্পের মতই ভ্যানিশ হয়ে গেল। পাঞ্জাবী ভাষায় যে বই লিখেছেন, সেটার পাঞ্জাবী অনুবাদও পেয়ে যাবেন। মূল বইয়ের ভাষা নাকি পাজামা। ১৪৩ সংখ্যাটা মাথায় নিয়ে ফিরলাম। যোগ করলে দাঁড়ায় ৮। ২০২৪এর যোগফলও ৮। তাহলে আগামী বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন বইয়ের সংখ্যা হবে ৮। দেড়শো অতিক্রম করে এক বেশী। যা বলেন, তার চেয়ে বেশী দেন। বইমেলায় অন্যান্য লেখকদেরও কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। হ্যালোজেনের তলায় মোমবাতির মত। ঠিক যেমন মোমবাতি নিয়ে সুশীলরা রাজপথে মিছিল করতেন। মোমবাতির যুগ আর নেই। যমবাতি জ্বলছে। মাথার উপর জ্বলছেন তিনি।