অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। দেশের সংসদ কোন ভাষায়, কোন পক্ষের হয়ে কথা বলবে তা ঠিক হবে এই নির্বাচনে। আদানী, আম্বানীর পায়ে নাকখত দিয়ে তাদের দালালি নাকি শিরদাঁড়া সোজা রেখে খেটেখাওয়া মানুষের স্বার্থরক্ষা? কী হবে দেশের সরকারের নীতি অভিমুখ? ঠিক হবে এই ভোটে।

      হাওয়ায় পরিষ্কার বার্তা— মোদীকে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে ভারতবর্ষকে গুটিকয়েক কর্পোরেটের খাসতালুকে পরিণত করার স্বপ্ন আপাতত কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে হবে। এবং নিঃসন্দেহেই কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িকতার এই সাজানো বাগানে আগুন ধরাবে বামপন্থীরা। ধুপ ধুনোর গন্ধ ছেড়ে সংসদ ঘুরবে ঘামের গল্পে, শ্রমিক কৃষকের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে কেঁপে কেঁপে উঠবে সংসদ ভবন। সড়কের দাবি মেনেই আইন বানাবে সংসদ। প্রাকশর্ত একটাই, পার্লামেন্টে বামপন্থীদের জোরালো উপস্থিতি।

     বছর কুড়ি আগের কথা, ২০০৪। চতুর্দশ লোকসভা নির্বাচনে ৬১ জন বামপন্থী সাংসদ জয়লাভ করেন। তাদের ছাড়া সরকার গঠন অসম্ভব। মন্ত্রীত্ব নয়, সমর্থনের শর্ত ছিল ভিন্ন। আগে তুলে দিতে হবে বিলগ্নীকরণ মন্ত্রক। জনগণের সম্পত্তি জনগণের হাতে থাকবে, কোনো ব্যক্তি পুঁজির হবে না। সে শর্ত মেনেই তৈরি হল প্রথম ইউপিএ সরকার, বাইরে থেকে সমর্থন করলেন বামপন্থী সাংসদরা। ইউপিএ-১-এর সেই পর্বে সংসদে বামপন্থীরা ৬১; সংসদে জোরালো আমজনতার কন্ঠস্বর। সংসদের আলোচনার ইস্যু কর্মসংস্থান, রুটি, রুজি। সংসদে বামপন্থীরা ৬১ মানে কৃষিঋণ মকুব। আলোচনায় স্বামীনাথন কমিশন। মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ। রুগণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনরুজ্জীবন। সংসদে বামপন্থীরা শক্তিশালী মানে সংসদে একশো দিনের কাজের আইনি স্বীকৃতি, অরণ্যের অধিকার থেকে তথ্যের অধিকার আইন। গার্হস্থ্য হিংসা রোধে আইন। গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েদের শিশুশ্রমিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়ে স্কুলমুখী করার উদ্যোগ; কচিকচি খালি-পেটে দুমুঠো খাবার। মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু। সংসদে বামপন্থীরা শক্তিশালী মানে, উঁচু উঁচু চেয়ার টেবিল স্তম্ভগুলোকে মাথা নীচু করে মাটির কথা শুনতে বাধ্য করা। সংসদে বামপন্থীরা শক্তিশালী মানে যে আলো আজ আদানী, আম্বানী ও তাদের পোষা দালালদের, যে সামাজিক নিরাপত্তা আজ ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তির চারমাসের নাতির, সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া। সংসদে বামপন্থীরীরা শক্তিশালী মানে খেটে খাওয়া দিনমজুরের ঘরের ছেলে মেয়ের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখার সাহস। সংসদে বামপন্থীরা শক্তিশালী মানে আঁধারের দেশে জ্বলতে থাকা আলোর মশাল। 

     তাই এই লোকসভা নির্বাচন কেবল বিজেপিকে হারানোর নির্বাচন নয়। কেবলই দেশের সংবিধানকে,  দেশকে বাঁচানোর নির্বাচন নয়। দেশকে গড়ারও লড়াই। দেশের শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের রুটি, রুজি, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের  দাবিতে সংসদববনের কোনায় কোনায় হুল্লোড় লাগিয়ে দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টে বামপন্থী সাংসদের দাপুটে প্রত্যাবর্তনের লড়াই। এই নির্বাচন ঠিক করবে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ। এই নির্বাচন ঠিক করবে ভারতবর্ষের বাড়তে থাকা বেকারদের ভবিষ্যৎ। এই নির্বাচন ঠিক করবে সুইগি, যোম্যাটোয় কাজ করা লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের জব সিকিউরিটি নিয়ে সংসদে আলোচনা হবে কিনা। কর্পোরেট ত্যালানো নয়া শ্রম কোড লাগু হবে না বাতিল হবে, তা ঠিক করে দেবে এই নির্বাচন। এই নির্বাচন ঠিক করবে জ্বালানী, বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় মাসকাবারি জিনিসের মূল্য আরও বাড়বে কিনা। এই নির্বাচন ঠিক করবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে রেল, টেলিকম, ডাক, বিমার মতো সরকারি সংস্থাগুলি সম্পূর্ণ বেসরকারি হাতে চলে যাবে কিনা। এই নির্বাচন ঠিক করবে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পাবে কিনা। এই নির্বাচন ঠিক করবে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষে কেউ দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিক হয়ে থাকবে কিনা। এবং এই সব প্রশ্নেই বিকল্প বামপন্থা। বামপন্থীরা। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সদ্য প্রকাশিত নির্বাচনী ইস্তেহারেই তা স্পষ্ট।

b66fc52e-4af8-4fcb-a7a4-d3729a6cdaa7.png

      ইস্তেহারের প্রথমেই বলা হয়েছে প্ল্যানিং কমিশন ফিরিয়ে আনার কথা। মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই প্ল্যানিং কমিশন তুলে দিয়ে নিতি আয়োগ স্থাপন করে যার মাথায় বসেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। এমনভাবে এর কার্যপদ্ধতি ঠিক করা হয় যাতে বিভিন্ন রাজ্যের উন্নয়নের জন্য ব্যয়বরাদ্দের প্রায় খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তও কেন্দ্রের সরকার নিতে পারে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। তাছাড়া কেন্দ্রের সরসার রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় অবিজেপি রাজ্যগুলিতে প্রাথমিকভাবে টাকা পয়সা আটকে রেখে অসুবিধেয় ফেলার যে চেষ্টা করে তা নিতি আয়োগের উপস্থিতিতে আরো সহজ হয়। যদিও কেরালা বা রাজস্থানের সরকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়ে টাকা ছিনিয়ে এনেছে, পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু দেখা যায়নি। তবে প্ল্যানিং কমিশন ছাড়াও দেশের আয়কর ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চেয়েছে সিপিআই(এম)। ভারতের ১% মানুষের কাছে দেশের মোট সম্পদের ৪০.১% আছে। অথচ মোট সংগৃহীত করের ক্ষেত্রে চিত্রটা উল্টে যায়। সরকার পুঁজিপতিদের ছাড়ের পর ছাড় দিয়ে যান, সেই অর্থে তারা মোচ্ছব করেন, আম্বানীরা ৮০০ কোটি টাকার ওপর খরচ করে সন্তানের প্রি-ওয়েডিং পালন করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ পেট্রল, ডিজেল, জীবনদায়ী ওষুধে ক্রমবর্ধমান করের বোঝায় সন্তানদের নিয়ে ধুঁকতে থাকেন। কৃষকরা ঋণের দায়ে দিশেহারা হয়ে আত্মহত্যা করেন। এই তেলা মাথায় ত্যালানোর রকমফিরি বদলাতে হবে, কর ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠা এবং তাতে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা মানে কর্পোরেট কর বাড়ানো। আলাদা করে কর বসবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির উপর। হিসেব পরিষ্কার — কেউ বাঁচবে কেউ বাঁচবে না, তা হবে না, তা হবে না। অতিধনীদের বাড়তি টাকা অন্যান্য দল ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে নিজেদের পকেটে ঢোকায়, সিপিআই(এম) -এর দাওয়াই, কর্পোরেটদের বাড়তি টাকা কর্পোরেট করের মাধ্যমে  সরকারি কোষাগার অব্দি পৌঁছে দেওয়া হবে। সেই কোষাগার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে কেরোসিন তেল, রান্নার গ্যাসে। শক্তিশালী করা গণবন্টন ব্যবস্থা। শক্তিশালী সরকারি কোষাগারের ওপর নির্ভর করে ১০০ দিনের কাজকে ২০০ দিনের করা হবে। বাড়ানো হবে মজুরি। শিক্ষাখাতে, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। জীবনের মান বাড়বে, কমবে বেকারত্বের সমস্যা। তাছাড়া ছোটো ও মাঝারী শিল্পে জোর দেওয়া হবে। এই শিল্পগুলি অসংখ্য কর্মসংস্থান তৈরী করতে সক্ষম। শুধু তাই’ই নয়, শক্তিশালী, স্বনির্ভর সরকারি কোষাগারের ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগের অভাবে, অবহেলায় বা কর্পোরেটের হাতে বেচে দেওয়ার ধান্দায় ধুঁকতে থাকা সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিতে পুনরায় বিনিয়োগ হবে। সরকারে সমস্ত শূন্যপদে নিয়োগ হবে। স্থায়ী ধরণের কাজে স্থায়ী নিয়োগ। অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে সম কাজে সম মজুরি। সার্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণ।  

 তবে কেবল চাকরি পাওয়া নয়, তার গুনগত মানও একইসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। নয়া শ্রম কোডের পর শ্রমিকদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে অর্জিত অধিকারগুলি, মালিকের মর্জিমতো শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে এই অবস্থা আরও করুণ। তাঁদের প্রায় কোনোরকম সুরক্ষা নেই। এই খেলার প্রান্তবদল চায় সিপিআই(এম)। তাই বিকল্প সরকার গড়ার সাথে সাথে শ্রম কোড বাতিলের দাবি আছে এই ম্যানিফেস্টোতে, দাবি আছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য নির্দিষ্ট আইনের, তাদের সামাজিক সুরক্ষার। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের, বিশেষত যুব সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের, নিরাপত্তার গ্যারান্টি নির্বাচিত সরকারকে দিতে হবে, তাদের বিনিদ্র রজনী, মনঃকষ্ট, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে, তাদের ঠোটের কোণে মুছতে থাকা হাসি, চোখে নীভু নীভু স্বপ্ন— সব বামাল ফেরত দিতে হবে। তাই সিপিআই(এম) দাবি জানিয়েছে বেকার ভাতার, দাবি জানিয়েছে কাজ করার অধিকারকে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে।

      ম্যানিফেস্টোতে জোরালো সওয়াল আছে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মেনে ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্যের জন্যে। বীজ, সার প্রভৃতি প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর জন্যে। দাবি, আগামী দু’বছরের মধ্যে চাষাবাদে সরকারি বিনিয়োগ দ্বিগুণ করতে হবে। তাছাড়াও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফসলের কালোবাজারি রুখতে হবে, পেট্রোল সহ অন্যান্য জ্বালানীর দাম কমাতে হবে।

    মজার কথা, এইসবই ‘করছি’/’করব’, ‘হচ্ছে’/’হবে’ থেকে ‘করতেই হবে’/’হতেই হবে’তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যদি সংসদের ভিতরে বামেদের শক্তিশালী করা যায়। প্রথম ইউপিএ সরকার তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ।

   তাই কেবল বিজেপি-বিরোধী বিকল্প সরকার গঠনই এই মুহূর্তের একমাত্র দাবি নয়; দেশ বাঁচানোর সাথে সাথে দেশ গড়ার জন্যে চাই বিকল্প নীতি। সংসদে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধিই সেই বিকল্প নীতি প্রণয়নের একমাত্র গ্যারান্টি। আর কে না জানে, এদেশের সংসদে বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করার প্রশ্নে পশ্চিমবাংলার গুরুত্ব কতখানি! ঐতিহাসিকভাবেই এদেশের বামআন্দোলনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি এরাজ্য। এ বাংলার মাটিতেই তাই আবার লড়াই আজ। বামপন্থার পুনর্জাগরণের লড়াই, লড়াই দুর্জয় ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের।

    আজকের ভারতের তীব্র আঁধারে আশার আলোক সিপিআই(এম)-এর নির্বাচনী ইস্তাহার। দেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনগনের আকাঙ্খা ভাষা পেয়েছে এই ইস্তাহারে, এবার তাকে মূর্ত রূপ দেওয়ার লড়াই। এ যুদ্ধে হারার অপশন নেই।