সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার সুযোগ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি দু বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন যতটা প্রত‍্যাশিত ছিল গান্ধীহত‍্যার দিন হত‍্যাকারী নাথুরাম গডসের মূর্তিতে মালা দেওয়া এবং একই সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত শহীদদের স্মরণের জন‍্য সারা দেশে দু মিনিট নীরবতা পালনের আহ্বান করে ২০২৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি গান্ধী। হত‍্যার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপন করার আয়োজন করা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামোতে তারচেয়ে অনেক বেশি অপ্রত‍্যাশিতভাবে চূড়ান্ত আঘাত।  নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন যোগাযোগ ছিল না। হিন্দুত্বের দোহাই পেড়ে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের অনুগামী নাথুরাম গডসে হত‍্যা করেছিল গান্ধীজিকে। 

সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘই নিয়ন্ত্রণ করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতীয় জনতা পার্টি।  ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিনায়ক দামোদর সাভরকরের ব্রিটিশ বিরোধিতা না করার মুচলেকা দেওয়ার ঘটনাটি বাদ রাখলেও ভাজপা র রাজনৈতিক আদর্শের সাংগঠনিক উৎসমুখ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও হিন্দু মহাসভা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেয়ে এদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক সংগ্রাম করতে বেশি আগ্রহী ছিল। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ধর্মপ্রাণ হিন্দু হলেও মুসলমান,খ্রীষ্টান, শিখ,বৌদ্ধ,পার্শীদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাসী ছিলেন এবং জননেতা হিসাবে সর্বস্তরের ভারতীয়দের মধ‍্যে তাঁর অপরিসীম গ্রহণ যোগ‍্যতা নিয়ে সংঘীদের অস্বস্তি প্রথম থেকেই ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ‍্যবাদী সরকারের ভারতবর্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রয়োগ অসম্ভব হতো যদি না সংখ‍্যাগুরু মৌলবাদের প্রতিনিধি হিসাবে ১৯২৫ সালে সংগঠনের সূচনাপর্ব থেকেই আর এস এস সংস্কৃতিচর্চার নামে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের প্রচার শুরু করতো। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির মাধ‍্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করার লক্ষ্যে আর এস এস ও হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিকল্পনা করে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল। তারা প্রচার করছিল সুলতানি ও মোগল আমলেই ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থে পরাধীন ছিল এবং মুসলমানরা ভারতবর্ষে নিতান্তই বহিরাগত। যদিও শোনা যায় যে শিক্ষাবিদ ভারতবর্ষে সংখ‍্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করেছিলেন বলে হামেশা অভিযোগ করা হয়, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা  সেই স‍্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁ নাকি বলতেন, হিন্দু কোন ধর্মীয় শব্দ নয়, ভৌগোলিক শব্দ। যিনি ভারতের মাটিতে জন্মেছেন,”ভারতীয় নদীর জল খেয়েছেন তিনিই হিন্দু!” অতি সম্প্রতি কেরালার বিজেপি বান্ধব রাজ‍্যপাল আরিফ মহম্মদ খান তিরুবনান্তপুরমে হিন্দু কনক্লেভে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিজেপির সাম্প্রদায়িক চরিত্র আড়াল করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

এই বিভ্রান্তি ছড়ানোর রাজনীতি অবশ‍্য আর এস এস ও বিজেপির বহু পুরোন। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ‍্য অঙ্গ। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো অবিসংবাদী জননেতার হত‍্যাও এই ষড়যন্ত্রের ফল। নিতান্ত আকস্মিক ঘটনা হলে তড়িঘড়ি গান্ধীহত‍্যার কিছুদিন আগেই রাজনৈতিক মতভেদের অজুহাতে নাথুরাম গডসে আর এস এস ছেড়ে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিতেন না। আর এস এস ও গান্ধী হত‍্যার পরে লোক দেখানো শোকপ্রকাশের জন‍্য তাদের শাখাগুলির কাজকর্ম তেরোদিনের জন‍্য বন্ধ রাখতেন না। তাতে অবশ‍্য শেষরক্ষা হয়নি। গান্ধীহত‍্যার ফলে উদগিরিত  জনরোষ আছড়ে পড়েছিল আর এস এসের বিভিন্ন কার্যালয়ের ওপর ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় আর এস এসকে। কেননা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরু সহ অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ নেতাই সঠিকভাবে সন্দেহ করতেন গান্ধী হত‍্যার ঠিক আগে সারাদেশে যে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তার পিছনে আর এস এসের বড়ো ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু কি করেছিল আর এস এস? ১৯৪৭ সালের যথাক্রমে ১৪ই আগষ্ট ও ১৫ ই আগষ্ট পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ এর মধ‍্যে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী হিসাবে কাজ করে এবং ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক জিগির ও প্রত‍্যক্ষ সংগ্রামের ডাকের পরোক্ষ মদতে নিজেদের সদস‍্য সংখ‍্যা প্রায় ছয় লক্ষে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। ক্রিষ্টোফ জেফ্রেলট লিখেছেন দেশভাগের পর সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লির দাঙ্গায় যেমন আর এস এস মুসলমানদের ওপর হামলায় যুক্ত ছিল তেমনি উদ্বাস্তু অঞ্চলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন করার সময়ও সংখ‍্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্ররোচনায় জড়িয়ে পড়েছিল। গান্ধীজি তাদের অনুরোধ করেছিলেন দিল্লিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে  সরকারকে সহযোগিতা করতে। ১৯৪৭ সালের ৭ ই ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে যে বিরাট জনসভা হয়েছিল তাতে সরসংঘ চালক মাধব সদাশিবরাও গোলওয়ালকর সহ শিল্পপতি জে কে বিড়লা, গোকুলচাঁদ নারাং এর মতো বিশিষ্ট শিল্পপতিরা হিন্দুত্বের সেবায় আত্মোৎসর্গ করার জন‍্য আর এস এসের স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশংসা করেন। এই প্রশংসার অন‍্যতম কারণ হল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দু ও শিখদের সঙ্গে দিল্লির মুসলমান বাসিন্দাদের উত্তেজনায় ইন্ধন যুগিয়েছিল স্বয়ংসেবকরা।

এরই পাশাপাশি পাকিস্তান কে পঞ্চান্ন কোটি টাকা দিতে নাকি গান্ধিজী ভারত সরকারকে বাধ‍্য করতে চেয়ে অনশন করেছেন এমন রটনাও শুরু করা হয়েছিল আর এস এস ও হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে। গান্ধীজিকে খুন করার পর আদালতে বিচারাধীন থাকার সময় লিখিত ভাবে এই রটনাকেই তথ‍্য হিসাবে আদালতে পেশ করে। এবং জানায় যে এই পঞ্চান্ন কোটি টাকা পাকিস্তান কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার  “অপরাধেই” সে গান্ধীজিকে হত‍্যা করেছে। কিন্তু ঘটনা এটাই যে,১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকেই গান্ধিজীকে হত‍্যা করতে মরীয়া হয়ে উঠেছিল গডসে। সে প্রকাশ‍্য জনসভাতেই বক্তৃতা দেওয়ার সময় ঘোষণা করেছিল,” গান্ধীজিকে দীর্ঘদিন বাঁচতে দেওয়া হবে না। ” ১৯৪৪ সালের মে মাসে নাথুরাম পঞ্চগণিতে একবার গান্ধীজিকে খুন করার চেষ্টা করে ব‍্যর্থ হয়। ১৯৪৮ সালের ২০শে জানুয়ারি বিড়লাভবনে আবার সদলবলে সে উপস্থিত হয়েছিল গান্ধীজিকে হত‍্যা করতে কিন্তু সেই চেষ্টাও ব‍্যর্থ হয়। ততদিনে এটুকু জানাজানি হয়ে গেছে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  সর্দার বল্লভভাই প‍্যাটেলকে লর্ড মাউন্টব‍্যাটেন মারফত গান্ধীজি জানিয়ে দিয়েছেন  পঞ্চান্ন কোটি টাকা দেওয়ার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটির সঙ্গে তিনি একমত নন। যদিও তাঁর মতামতের কোন প্রভাব এই সরকারি সিদ্ধান্তে পড়বার কোন সম্ভাবনা ছিল না তবুও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারবারিরা মিথ‍্যাচারে কোন খামতি দেয়নি। তারা ১২ ই জানুয়ারি প্রার্থনাসভায় গান্ধীজির দুই দেশের  সমস্ত ধর্মের মানুষের কাছে সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়া বক্তৃতায় প্রমাদ গণে এবং গণতান্ত্রিক ব‍্যবস্থার সার্থকতা কেবল সংখ‍্যা লঘুর নিরাপত্তায় এই মর্মবাণী প্রতিষ্ঠার জন‍্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে শেষবারের মতো অনশনে বসার ঘোষণায় বুঝতে পারে গান্ধিজীর এবারের “ডু অর ডাই ” শ্লোগান সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাত করবে। ১৪ই জানুয়ারির প্রার্থনাসভায় গান্ধীজি আবার হিন্দু মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববোধে গুরুত্ব দেন। ১৫ ই জানুয়ারির ক‍্যাবিনেট মিটিংয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ৫৫ কোটি টাকা পাকিস্তান সরকারের হাতে চুক্তি মত তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার পর শ‍্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ‍্যায় ও বল্লভভাই প‍্যাটেল সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন জানার পরেও  নাথুরাম গডসে এই সিদ্ধান্তের জন‍্য গান্ধীজিকে দায়ী করার মিথ‍্যাচার করে চলে এবং এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও অনশনরত গান্ধীজির সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে যায় যদিও গান্ধিজী কখনও এই টাকা আদানপ্রদান বিষয়ে কোন কথাই কোন বক্তব্যে বলেন নি।

আসলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সামনে গান্ধীজিই প্রধান বাধা হিসাবে আর এস এস ও হিন্দু মহাসভার কাছে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। দুই দেশের মৌলবাদীদের কাছেই সাম্প্রদায়িক অশান্তি সীমান্ত সংঘর্ষ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব‍্যবহার করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ উদ্বাস্তু সমস‍্যা অর্থনৈতিক সংকট যেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটাতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। গান্ধীহত‍্যার  ষড়যন্ত্র তাই অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৮সালের ৩০শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে সেই পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করেছিল।