“সচ্ছল এক ধনীর বাড়িতে বিয়ের উৎসব ,অন্দরমহল থেকে শানাই-এর সুর ভেসে আসছে ।হাসির লহর তুলে একদল তরুণী বেরিয়ে আসে বাড়ির ফটকের ভেতর থেকে।আইনে নির্দিষ্ট করাপঞ্চাশ জনের পরিবর্তে একহাজার জনকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ,কালোবাজারের সুবিধাবা ভোগ করে এখানে এই রাজসিক ব্যাপার চলছে।ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে অতিথিদের সম্ভাষন জানাচ্ছেন বাড়ির বড় কর্তা।    গেটের বাপাশে অর্ধবৃত্তাকার ডাস্টবিন কুঞ্জ-রাধিকা উচ্ছিষ্ট কলাপাতার স্তূপ ঘেঁটে খাবারের জোর সন্ধান চালায়।ডাস্টবিনের পাশে ক্রুদ্ধ কুকুরের গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে।বাড়ির ফটক থেকে খানিকটা দুরে দাঁড়িয়ে বড়ো বাড়ির দিকে হাত তুলে কাতর চিত্তে প্রধান কে খাবার প্রার্থনা করতে দেখা যায়।   

ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলতে গিয়ে কুঞ্জ হাতে কুকুরের কামড় খেয়ে রক্তাক্ত হয়।প্রধান কাতর কন্ঠে পেটের জ্বালায় ভাতের জন্য  চেঁচায়-‘তোমারা কী সব বধির হয়ে গেছ বাবু-কিছু কানে শোন না?অন্তর কী সব তোমাদের পাষান হয়ে গেছে বাবু!তোমাদের কী প্রান নেই বাবু?’           নবান্ন (বিজন ভট্টাচার্য)      ২য় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা  ফ‍্যাসিজমের উত্থান, সাম্রাজ‍্যবাদের আগ্রাসন, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, কালোবাজারিতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত ও নিপীড়িত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে  গণনাট‍্য সংঘের সভ‍্য হিসাবে বিজন ভট্টাচার্য এ ‘নবান্ন’ নাটকটি লেখেন।
সেদিন’ নবান্ন’  নাটকের চরিত্র প্রধান প্রশ্ন করেছিল অন্তর কী সব পাষান হয়ে গেছে বাবুরা !সত্যিই আজ কলকাতার বাবুরা মূক বধির এবং অন্ধ হয়েছেন। হারিয়ে ফেলেছেন তাদের বিবেক। তাই তো তাদের চোখে পড়ল না জলগুড়ির ওই মানুষ গুলির সলিল সমাধি।কেন বিসর্জন দিতে এসে উৎসব মুখর এই পরিবার গুলির জীবনে নেমে আসলো মৃত্যু শোকের ছায়া।যারা প্রতিমা নিরঞ্জনে এসেছিলেন তাদের পরিবারকে বহন করতে হলো প্রিয়জনের শবদেহ।দায় কার?দায় অবশ্যই এই তৃণমূল সরকারের। মাল নদীতে বাঁধ দিয়ে  করা হয়েছিল প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা।পাহাড়ি উঁচু অঞ্চল দিয়ে বয়ে আসা নদী যখন বৃষ্টির জলে পুষ্ট হয়ে নীচের দিকে নামে তখন যে তীব্র গতির সৃষ্টি হয় তা থেকে হরপা বান আসাটা স্বাভাবিক। বৃষ্টির জলে যে মাল নদী খড়স্রোতা হয়েছে এবং তার থেকে যে হরপা বানের সৃষ্টি হতে পারে তা তো তৃণমূল পরিচালিত স্থানীয়  পৌরসভার অজানা ছিল না।তাহলে কেন ওখানেই বিসর্জনের ব্যবস্থার করা হলো ,কেন গ্রহন করা হলো না উপযুক্ত ব্যবস্থা।আসলে জনগনকে ফূর্তিতে ডুবিয়ে রেখে এই সরকার তার সমস্ত অপকর্ম ঢাকতে চায়।মানুষে যত উৎসবে মাতবে তত সুবিধা হবে এদের দুষ্কর্ম ঢাকা।তাতে যদি মানুষের প্রান যায় যাক।আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও সরকারী উদাসিনতায় ঝরে গেল এতো গুলো তাজা প্রান।       

এত মানুষের মৃত্যুতে যখন কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ গোটা বাংলা জুড়ে শোকের আবহওয়া তৈরি হয়েছে ।সেই সময় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মেতে উঠলেন উৎসবে।শোক কিসের, ‘উৎসব করবো নাকি শ্রাদ্ধ করবো’।      এখনও মাল নদীর হরপা বানে মৃত পরিবারগুলির চিতার আগুন ঠান্ডা হয়নি!তাদের পারোলৌকিক ক্রিয়া হিসেবে শ্রাদ্ধ ও হয়নি তার মধ্যেই উৎসব।      রেড রোডের কার্নিভাল রাস্তা দিয়ে শোভা যাত্রা সহকারে প্রতিমা নিয়ে হেঁটে যাবে কলকাতার নামী পুজোর উদ্যোক্তারা ।যে পুজোর উদ্যোক্তাদের হাতে রাজ্যবাসীর করের টাকা থেকে ষাট হাজার করে দিয়েছিলেন উনি রাজ্যের মালকিন হিসেবে ।অনুগত ভক্তের ন্যায় পুজো কমিটি গুলি ও হাজির কার্নিভালে,হাত নেড়ে স্বাগত জানালেন মাননীয়া আনন্দ উপভোগ করবেন কার্নিভালের।মিডিয়ার মাধ্যমে দেখাতে চাইলেন  এ বাংলার নাগরিক জীবনে কোথাও কোনও অসন্তোষ, অভাব, ক্ষোভ নেই তার রাজত্বে রয়েছে অনাবিল সুখের পরিবেশ ,আর আছে উৎসব আর দেদার আনন্দ। গরু ,কয়লা,শিক্ষকদের চাকরি চুরি সহ একাধিক কেলেঙ্কারিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত এই সরকারের কাছে এবারের কার্নিভাল টা হয়ে পড়েছিল কার্যত নিজের ক্ষমতা দেখানোর মঞ্চ। যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে উনি প্যারেড করালেন ওনার অনুগত দের।দেখালেন আমার সঙ্গেই আছে জনগন ।গরু,কয়লা ,চাকরি চুরি মিথ্যা মিথ্যা।কার্নিভালের ঝা চকচকে আয়োজনে ঢাকতে চাইলেন সব কিছু।   

শবদেহ ঢাকা হয় সাদা কাপড়ে এটাই রিতী ,কিন্তু এই শহরে  প্রায় ছশো দিন ধরে নিজের হকের দাবিতে ধর্নায় বসা  জীবন্ত চাকরি প্রার্থীদের ধর্না মঞ্চ ঢেকে দেওয়া হলো সাদা কাপড়ে।এদের চাকরি চুরি করে সরকার ইতিমধ্যেই এদের জীবন্ত লাশে পরিনত করেছিল আজ সেই জীবন্ত লাশ গুলি উপর ঢাকা দেওয়া হলো সাদা কাপড়।উৎসব প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী চান না ধর্নায় বসা চাকরি প্রার্থীদের মুখ দর্শন করতে তাই এই ব্যবস্থা।    কার্নিভালে মাননীয়া মাটির মাতৃ মূর্তি দেখে আনন্দ উপভোগ করছেন,কিন্তু ওই শিক্ষকদের ধর্না মঞ্চে কোলে সন্তান নিয়ে আন্দোলনে সামিল হওয়া রক্ত মাংসের মায়ের মুখ আপনার হৃদয়ে যন্ত্রনা সৃষ্টি করেনা।আপনি নাকি এ বাংলার শ্রেষ্ঠ মানবিক মুখ্যমন্ত্রী।এই আপনার মানবিকতার পরিচয়?      দোষ কেবল আপনার নয় মাননীয়া দোষ আমরাও ,আমাদের ও ।কেননা আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।আমাদের প্রতিরোধের আগুন আজ নিভে গেছে।এ শহর পরিনত হয়েছে আজ এক প্রানহীন শহরে।একদা সারা-দেশেরপ্রতিবাদের ,প্রতিরোধের কেন্দ্র আমার এই প্রিয় শহরে আজ তার সহনাগরিকের মৃত্যুর শোকও স্পর্শ করে না।বিপ্রতীপে সে মেতে ওঠে কার্নিভালে।একবার ও গর্জে ওঠে না একথা বলে  বাতিল করো শোকের আবহওয়াতে এই আনন্দের শোভাযাত্রা।যদি বাতিল না করো তাহলে বাতিল আমরা করবোই।না হৃদয় হীন এ শহরের বাবুদের মুখ দিয়ে এ কথা বেরোইনি। সত্যিই বাবুরা তোমাদের বিবেক আজ হারিয়ে গেছে।