
করোনাকালে রেড ভলান্টিয়ারদের উজ্জ্বল ভূমিকা উপেক্ষা করতে না পারলেও বহুদিন যাবৎ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম বামপন্থীদের বিবৃতি ও মতামত এড়িয়ে চলে। কারণ একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচিতেই ধারাবাহিকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সে বিষয়ে সামাজিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। আসলে, মুনাফার লোভ পুঁজিবাদী শাসনে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদরক্ষার গুরুত্ব। দীঘার সমুদ্রতটের সৌন্দর্যায়ন দেখে যাঁরা উন্নয়নের জয়গান করেন, প্রকৃতির সাজানো সমুদ্রতটে অ্যাশফল্টাম ফেলে ঝাউগাছ সহ সবুজ ধ্বংস করার বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে লাভ নেই। বেশি বৃষ্টিপাত জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবছর দীঘা ভাসলেও গেলেও তাঁদের চেতনা ফিরবে না। গত ৫ ই অক্টোবর জলপাইগুড়ির মালনদীতে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের সময় হড়পা বানে একলহমায় আটজন দর্শনার্থীর মৃত্যু এবং প্রায় চল্লিশজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবরে শিউড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশকর্মী হিসাবে বেদনাহত চিত্তে এই সত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, বালি পাথর ফেলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য জল বাড়ানোর পরিকল্পনার ফলে এমন দুর্ঘটনাকে কার্যত আমন্ত্রণ করা হয়েছিল জনসাধারণ ও প্রকৃতির নিরাপত্তার কথা বিবেচনা না করেই। ডুয়ার্স এলাকার নদীর চরিত্র যাঁরা জানেন, তাঁরা এই ভুল পদক্ষেপ নিলেন কেমন করে কে জানে? মাল নদীতে হড়পা বানের প্রবণতা রয়েছে। কয়েকমাস আগেই এই নদীর চড়ায় ট্রাক ডুবে গেছে হড়পা বানেই। মাল নদীর ব্রীজের নীচে থাম ঘেঁষে নুড়িপাথর ও বালি ফেলে চড়া তৈরি করলে বিপত্তি হতে পারে আবহওয়ার পূর্বাভাসে বোঝা উচিত ছিল প্রশাসনের। সতর্কতাও নেওয়া হয়নি কোন। ভুটান পাহাড় থেকে প্রবাহিত নদীগুলি হঠাৎ খরস্রোতা হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও বিসর্জনে যোগ দেওয়া অগণিত সাধারণ মানুষের জন্য সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা আটজন ছিলেন কেবল দড়ি নিয়ে। লাইফ জ্যাকেট, বোট কিছুই ঘটনাস্থলে ছিল না। ছিল না পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা।
এদিকে মন্ত্রী উদয়ন গুহ বিবৃতি দিয়েছেন,কোথাও কোনো বাঁধ তৈরি করা হয়নি। অথচ স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর বলেছেন পৌরসভার উদ্যোগে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে জলপাইগুড়ির জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেছেন, বিসর্জনের জন্য চ্যানেল করে নদীর স্রোত ঘুরিয়ে দেওয়া হলেও বাঁধ দেওয়া হয়নি। পরস্পরবিরোধী এই বিবৃতিতে প্রশাসনের নড়বড়ে অবস্থান সহজেই বোঝা যায়। পৌরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য অবশ্য স্পষ্ট,বাঁধ না দিলে তো বিসর্জন দেওয়াই যেত না। স্থানীয় মানুষ বিশেষত যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন তাঁরা বাঁধ তৈরি এবং প্রশাসনিক গাফিলতির কথাই বলেছেন। বাস্তবিক সাড়ে আটটায় দুর্ঘটনা ঘটার পরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সিপিআইএম কর্মী ও নেতারাই উদ্ধার কার্যে হাত লাগিয়েছিলেন। পরদিন অর্থাৎ ৬ ই অক্টোবর সকাল ন টার আগে কোন সরকারি কর্মীর দেখা মেলেনি। এই চাপান উতোরেই ভিন্নতর মাত্রা দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে তিনি দুর্ঘটনাগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গের ক্ষতিপূরণের টাকার অঙ্কের বৈষম্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন বগটুইকাণ্ডের প্রেক্ষিতে। দুঘটনার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের মালবাজার সফরের খবর টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদমাধ্যমে উঠে এলেও আশ্চর্যজনকভাবে দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরে ত্রাণকার্যে সিপিআইএম কর্মীদের ভূমিকা সম্পর্কে বৃহৎ সংবাদ মাধ্যম নীরব। তেমন গুরুত্ব পায়নি সরাসরি প্রশাসনের মদতে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ তোলা সিপিআইএমের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বিবৃতি।
গত এক দশক ধরে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের দোহাই পেড়ে উত্তরাখণ্ড থেকে ডুয়ার্স প্রাকৃতিক সম্পদ যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তার খেসারত মাঝে মাঝেই হড়পা বানে অসংখ্য জীবনহানি এমনকি জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনার মাধ্যমে মেটাতে হয়। উত্তররাখণ্ডে পাহাড়ের কোলে হোটেল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবুও মুনাফার লোভে এই ধ্বংসলীলা চলতেই থাকে। মাল নদীকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার ভয়ংকর পরিণতির পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হুঁশ ফিরবে কি?