![](https://www.leftsquad.in/wp-content/uploads/2022/07/ch-1024x512.jpg)
‘‘বলুন, চুরি করবেন না। কেউ অন্যায় করলে আটকাবেন।”বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। বড় বড় লিখেছিল পত্রিকাগুলি। তৃণমূলের ‘২১শে জুলাই’-র সমাবেশে সেদিনই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ভাষণ দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেদিনই তাঁর চুরি না করার, অন্যায় আটকানোর নির্দেশ।দিনটি ছিল ২১শে জুলাই, ২০১১। তার মাত্র দু’ মাস আগে মুখ্যমন্ত্রীত্বের বহু কাঙ্খিত চেয়ারে পৌঁছেছেন তৃণমূল নেত্রী।তারপর এগারো বছর পেরিয়েছে। তাঁর সেই নির্দেশের হাল কী? ভাদু বলবে। বলবেন আমজাদও। শেখাবে বগটুই। লুটের বখরা নিয়ে সংঘর্ষের জেরে খুন হয়েছে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য ভাদু সেখ। তিনি মুসলমান। আমজাদ সেখও। দুজনেরই বাড়ি সেই গ্রামে। ব্রাহ্মণী নদীর বুক থেকে তোলা এক গাড়ি বালির দাম অন্তত ২৬০০ টাকা। আসলে দাম হওয়ার কথা ৭০০ টাকা। ভাদু, ভাদুর নেতারা তোলা নেয়। তাই ৭০০ টাকার বালি অন্তত ২৬০০ টাকায় কিনতে হয় রামপুরহাটের সব ‘সাধারন’ মানুষকে। নদী ভাদুর। নদী আমজাদেরও। ব্রাহ্মণীর তীরে বসে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় হাওয়া খাওয়া, ওপারের গাছের মাথায় চোখ রেখে উদাস হওয়ার সুযোগ সবার। কারন এসবের উপর তৃণমূলের কাটমানি, তোলা বসেনি এখনও।
কিন্তু বালির মালিক ভাদু। ভাদুরা। ধর্ম এক বলে আমজাদের জন্য কোনও ছাড় নেই। ছিল না। কখনও হবেও না। ভাদু সেখ দুষ্কৃতী। তার বিশাল বাড়ি জাতীয় সড়কের কাছে, মূল গ্রামের কিছুটা দূরে। আমজাদ সেখের বাড়ি বগটুই গ্রামে। তাঁর বাড়ির পাশেই অজেমা বিবির বাড়ি। তাঁরা দুজনেই তৃণমূলের ২১ মার্চের গণহত্যার সময় বাড়িতে ছিলেন। যে বাড়িতে ৯জনকে পুড়িয়ে মেরেছে তৃণমূলের কর্মীরা, আমজাদ সেখ আর অজেমা বিবির বাড়ি সেই বধ্যভূমির পাশে। তাঁদের দু’জনেরই সাধ্য নেই গ্রামের কিছুটা বাইরে জমি কিনে বড় কিংবা ছোট বাড়ি করার।কারন? ভাদু সেখ তোলবাজ। বেআইনি পথে বালি, গোরু, পাথর, কয়লা পাচারে যুক্ত ছিল। আমজাদ সেখ? তাঁর চারটি গোরু আছে।
গোরুগুলিকে তিনি পরম মমত্বে দেখভাল করেন। গোরুগুলির দুধ বিক্রী তাঁর একমাত্র আয়ের পথ। কী আশ্চর্য! এগুলি সেই জীব, যাদের পাচার থেকে প্রতিদিন মোটা টাকা কামানোর দলে হিন্দু আছে, মুসলমানও আছে। তবে সবাই তৃণমূলের। আবার সেই গোরুকে লালন করার দলে মুসলমানও আছে। হিন্দুও। তাঁরা চুরি করেন না। দুধ বিক্রী করে সংসার চালান। তাঁরা ভয়ে আছেন। এই রাজ্যে তাঁদের শান্তি নেই। দুর্বৃত্ত ভাদু সেখ তৃণমূলের নেতা। আমজাদ সেখ? নেতা নন, কর্মী নন। খুব নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, তিনিই তৃণমূলেরই সমর্থক। বগটুইয়ে ২০১১ থেকে তৃণমূলের আধিপত্য। বিরোধীদের নাম ও নিশান রাখেনি তৃণমূল ওই গ্রামে। ফলে ‘গ্রামের সবাই তৃণমূল’ — ভোটের হিসাবে। তৃণমূলের বিরোধিতা করবে কে? ভাদু আছে না!এটাই ‘বদলে যাওয়া’ পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির আশেপাশের প্রায় ৩৫টি প্লটের মালিক তাঁর আত্মীয়রা। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী বোলপুরে কিনে ফেলেছেন কৃষিজমি। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো, দলের দু’ নম্বর অভিষেক ব্যানার্জির বিরুদ্ধে কয়লা পাচারে যুক্ত থাকার অভিযোগ। তৃণমূলের নেতারা ত্রাণের চাল, ত্রিপল চুরি করতে ছাড়ে না। চাকরিও চুরি করে তারা — যোগ্যতমকে বাদ দিয়ে ঘুষ নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেয় অযোগ্যকে। সারদার কোটি কোটি টাকা তো অনেক বড়!সারদা কেলেঙ্কারীতে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার লুট হলো। তৃণমূলের নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। ১৪০জনের বেশি এজেন্ট, আমানতকারী আত্মঘাতী হলেন। কয়েক লক্ষ পরিবার সর্বস্বান্ত হলেন। মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘যা গেছে তা গেছে।’ মনোরঞ্জন মালিককে মনে আছে? সিঙ্গুরের বাসিন্দা। তাপসী মালিকের বাবা। যে তাপসী মালিকের পোড়া দেহের ছবি দেখিয়ে সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে জঘন্য প্রচার করেছিল মমতা ব্যানার্জির দল। রহস্যময় সেই মৃত্যুর ঘটনায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পার্টি নেতা সুহৃদ দত্তকে। সেই তিনি, তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী মনোরঞ্জন মালিক সারদায় টাকা রেখেছিলেন। তার টাকাও মার গেছে। সেদিন,২০১১-র ২১জুলাই আর কী বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি?বলেছিলেন, “নিজেরা অন্যায় করবেন না। আপনাদের সঙ্গে সব সময় দেখা না-হলেও সব খবর আমার কাছে আসে। বিশৃঙ্খলা কিন্তু বরদাস্ত করা হবে না।’’অথচ সেই মমতা-শাসনে তৃণমূলীদের অন্যায় শুধু বরদাস্তই হয়েছে। প্রায় প্রতিটি সরকারী প্রকল্পের সুযোগ পেতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের ‘কমিশন’, ‘তোলা’ দিতে হয় গ্রামবাসীদের। মুখ্যমন্ত্রীর বর্তমান দাওয়াই কী?মুখ্যমন্ত্রীর মতে ‘‘চুরি আটকাতে হবে। তাই তাদের মানোন্নয়ন ঘটাতে হবে।’’ এই মানোন্নয়ন মানে কী? মমতা ব্যানার্জির মতে ‘‘ভাতা বাড়ানো।’’ ২০১৭-র ৩রা ফেব্রুয়ারি, নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পঞ্চায়েত রাজ সম্মেলনের মঞ্চে মমতা ব্যানার্জি পঞ্চায়েতের সদস্যরা যারা চুরি করেন, কেন করেন — তার ব্যাখ্যা দেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মুখ থেকে সেদিন শোনা যায়,‘‘শুধু বলবে ও’ চোর ও’ চোর। আরে চুরি করবে না কী করবে? ওদের সুযোগ তো দাও।’’‘অন্যায়’ স্বীকৃতি পেয়ে গেল।পশ্চিমবঙ্গে এখন বিশৃঙ্খলাই আইন। নৈরাজ্যই নিয়ম।উদাহরণ? অনেক। একটি দেওয়া যাক। ২০১১-র শীত। ৬ নভেম্বর। সদ্য ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল কংগ্রেস। ভবানীপুর থানা কয়েকজন দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করেছিল। খোদ মুখ্যমন্ত্রী সেই থানায় ঢুকে পুলিশকে শাসিয়ে অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে ধৃত দলীয় কর্মীদের ছাড়িয়ে আনেন। এরপর বিধানসভার ‘কালোদিন।’ দিনটি ছিল ২০১২-র ১১ই ডিসেম্বর। বিধানসভার মধ্যে সিপিআই(এম) বিধায়ক দেবলীনা হেমব্রমকে পাঁজাকোলে করে তুলে, মাটিতে আছড়ে, চুলের মুটি ধরে যেমন ইচ্ছা কিল, চড়, ঘুঁষি মারা হয়েছিল। আর এক সিপিআই(এম) বিধায়ক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জিকে মাটিতে পেড়ে ফেলে মারা হয়েছিল বেধড়ক। তাঁর রক্ত চলকে পড়েছিল শাসক দলের বিধায়কের পাঞ্জাবীতে। আহত, রক্তাক্ত হয়েছিলেন বামফ্রন্টের আরো কয়েকজন বিধায়ক, বিধানসভার মধ্যে, শাসক দলের হামলায়।উত্তর ২৪পরগণার কামদুনিতে ধর্ষণের প্রতিবাদ করায় গ্রামের গৃহবধূদের নামে পুলিশ ফৌজদারি মামলা দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। কামদুনিতে মুখ্যমন্ত্রীকে অভিযোগ জানাতে গেছিলেন গৃহবধূরা। মমতা ব্যানার্জি তাঁদের ‘মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করেন।
মধ্যমগ্রামের ট্যাক্সি চালকের ধর্ষিতা মেয়ের মৃতদেহ রাস্তায় শববাহী গাড়ি থেকে পুলিশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। মিডিয়ার নজর এড়িয়ে মৃতদেহ ছিনিয়ে দাহ করতে গিয়েছিল পুলিস (১লা জানুয়ারি ২০১৪)। অবশ্য পারেনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝরাতে আলো নিভিয়ে পুলিস দিয়ে পেটানো হয়েছে। বহু জায়গায় সিপিআই (এম) কর্মীদের হত্যা করে প্রকাশ্য উন্মত্ততায় ফূর্তি করেছে তৃণমূলের ভৈরব বাহিনী। থানা পরিণত হয়েছে তৃণমূলের আখড়ায়।বিধানসভার মধ্যে, ২০২১-এ তৃণমূলের বিধায়ক সিপিআই(এম)-র তৎকালীন বিধায়ক জাহানারা খানকে বলেছিলেন,‘‘ধর্ষণ করিয়ে দেবো।’’ তৃণমূল ওই বিধায়ক নিজেও মহিলা। নাম নার্গিস বেগম। এক অন্যায়ের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। অথচ ১১বছর আগে সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি এঁকেছিলেন মমতা ব্যানার্জি।