সঙ্ঘের পরামর্শেই মমতার কংগ্রেস প্রশংসা – গৌতম রায়

ইন্দিরার জীবনের শেষ পর্যায়ে কংগ্রেসের ভিতরে আর এস এস নোতুন করে যে থাবা বসাচ্ছিল তা চরম হয় রাজীবের আমলে।সেই থাবার ই ফসল অরুণ নেহরু, অরুণ সিং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কংগ্রেসের ভিতরে নিজেদের লোকেদের আর এস এস ভাঙিয়ে আনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে।কংগ্রেসকে নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে সরাতে আর এস এসের যে চেষ্টা তার সাফল্য তারা পায় মমতাকে দিয়ে কংগ্রেস ভাঙিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করবার পর।

সেই মমতাই এখন আর এস এসের নোতুন কৌশলে কংগ্রেসকে পুরোপুরি সাম্প্রদায়িক করে তুলতে মোদিকে শংসা পত্র দেওয়ার পর ,কংগ্রেস সম্পর্কে নোতুন করে ইতিবাচক মূল্যায়ণের অভিনয় শুরু করেছেন।

মমতার আগে ও পরে কংগ্রেসে থাকা অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরই কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসে অবস্থান করে নিজেদের রাজনৈতিক জীবন তৈরি করে নেওয়ার পর নানা ধরনের ব্যক্তিগত সংঘাতের কারনে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে অজয় মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নীলাম সঞ্জীব রেড্ডি, প্রণব মুখোপাধ্যায় ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে ।মমতা এখন যাঁর সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্বের অভিনয় করছেন ,সেই শরদ পাওয়ারের কথাও বলা যেতে পারে এই উদাহরণ হিশেবে। কিন্তু মমতার মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কি কংগ্রেস নেতাদের অতখানি ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন?

মমতা যখন কংগ্রেস ত্যাগ করেন তখন যে ভাষায় তিনি কংগ্রেস দলের তৎকালীন সভাপতি সীতারাম কেসরীকে আক্রমণ করেছিলেন, সেটা কোনো রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। যে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন তিনি সীতারামকে কেশরীর প্রতি করেছিলেন, সেটা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে মানায় না। পরবর্তীকালে মমতার যত আরএসএসের নির্দেশে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ঘনিষ্ট হয়েছেন ,ততই কংগ্রেসের প্রতি অরাজনৈতিক, ব্যক্তিগত আক্রমণকে একেবারে কলতলার খিস্তি খেউরে পরিণত করেছেন।

সেই মমতাই আবার দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকারের শরিক হয়েছেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বারামকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সব রকম ভাবে ব্যবহার করেছেন ।পাশাপাশি আরএসএস -বিজেপিকেও সমানভাবে ব্যবহার করেছেন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারকে উৎঘাট করবার লক্ষ্যে।

পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন হয়ে কংগ্রেস দলকে নিজের সরকারের শরিক করে কয়েক মাসের মধ্যেই কংগ্রেস দলকে সেই সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। তারপরও মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে মরাটরিয়াম নিয়ে কেন্দ্ররাজ্য সংঘাতের অভিনয়ের নাম করে কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত করেছেন।প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংয়ের বাচনভঙ্গিকে ভেঙিয়েছেন পর্যন্ত।

কার্যত আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসবার পথ আরো মসৃণ করে দিয়েছেন এইভাবেই মমতা।পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখল করবার পর বিরোধী ঐক্যকে ভাঙাবার লক্ষ্যে কংগ্রেসকে অরাজনৈতিকভাবে আক্রমণ করে নানা ধরনের রাজনৈতিক সুযোগ করে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িক শিবিরের পক্ষে। অতিসম্প্রতি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে মমতার যে উঁচু দরের অভিনয় সমৃদ্ধ ভূমিকা, তা থেকে খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আরএসএসের নির্দেশে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে মসৃণ ভাবে রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সঙ্ঘ নির্দেশিত প্রার্থীকে যে তাকে মমতা চেষ্টা ত্রুটি করেননি।

সেই মমতা আজ হঠাৎ করে কেন কংগ্রেস দলের প্রতি আবার একটা লোক দেখানো নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন? মাত্র দুই-তিন দিন হয়েছে রাজ্য বিধানসভার অভ্যন্তরে মমতা প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি প্রশংসার ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন ।যে মোদিকে মমতা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে চরম ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করেছিলেন, কোমরের দড়ি পড়িয়ে ঘোরানোর হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন , সেই প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে একটা উপরে কুস্তি, ভিতরে দোস্তির অভিনয় মমতার দীর্ঘদিন ধরে করে চলেছেন।

আজ আর এস এসের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের পর আর এস এসের পরম মিত্র মমতা নোতুন ঈরে মোদিকে প্রকাশ্যে শংসাপত্র দিলেন।এই শংসাপত্রের উদ্দেশ্য যে সিবিআই -ই ডি ইত্যাদি র অভিযানের থেকে নিজে, নিজের পরিবারকে মমতার বাঁচাবার তাগিদেই, সেটা একটি শিশুও বুঝতে পারছে।
সিবিআই , ইডি র অভিযানের দায়টা সম্পূর্ণভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর উপরে এবং বিজেপির উপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন মমতা। এটা মমতার একটা নতুন রাজনৈতিক কৌশলের পথ। অতীতে অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় থাকাকালীন আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্কের বিন্যাসের ওঠাপড়ার দরুন,’বাজপেয়ী ভালো’ , ‘ আডবাণী খারাপ ‘- এই তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন মমতা।

সেই আদবানির সঙ্গে মমতার সম্পর্কে পুনর্বিন্যাস, তার পেছনে যে সংঘের অদৃশ্য হাত আছে, তা আর নতুন করে বলে দিতে হবে না। সেই কারনেই যখন মমতার কাছে মোদি যখন খারাপ ছিলেন ,তখন অতীতের ‘খারাপ’ আডবানী মমতার কাছে ভালো হয়ে উঠেছিলেন ।আর এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচন (২০২৪) উপলক্ষে কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা দেশের গোটা পূর্বাঞ্চলে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে, আরএসএসের নির্দেশেই যে মমতা মোদির প্রতি ইতিবাচক কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলছেন, আর মোদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রতি বিষোদগার করছেন ,তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।

এইরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে বিরোধী রাজনীতির মধ্যে বিভ্রান্তি আনবার লক্ষ্য নিয়েই কংগ্রেস ঘিরে নতুন করে ইতিবাচক কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন মমতা। কংগ্রেসের ভেতরে অতীতের আরএসএস পন্থীদের সঙ্ঘবদ্ধ করবার জন্য আরএসএস নতুন করে মমতাকে আবার দায়িত্ব দিয়েছে কিনা, এমন সংশয়ও মমতার এই হঠাৎ বোধোদয়ের মত কংগ্রেসের প্রশংসা ঘিরে উঠতে শুরু করেছে। মাত্র দুই তিন মাস আগে রাষ্ট্রপতি ,উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরএসএসের নিজস্ব লোকজনদের জেতাতে মমতা যে ধরনের চোর পুলিশে খেলা খেলেছিলেন গোটা বিরোধী শিবিরের সঙ্গে, সেই মমতা ই হঠাৎ করে কংগ্রেস সম্পর্কে আবার ইতিবাচক কথাবার্তা প্রকাশ্যে বলছেন– এটা মমতার কোনো রাজনৈতিক বোধোদয়ের বার্তা নয়। এটা মমতার সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক শঠতার নতুন করে পরিচয়।
আরএসএসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ জগদীপ ধনকরে সঙ্গে একটা লোক দেখানো ঝগড়া ঝগড়া খেলা মমতা বেশ কিছুদিন ধরে খেলেছেন। কলকাতায় রাজ্যপাল হিসেবে ধনকার রাজভবনকে কিভাবে আরএসএসের কার্যত অঘোষিত অফিসে পরিণত করেছিলেন, সে খবর তো মমতার না জানবার কথা নয়। আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব কলকাতায় এলে কিভাবে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধানকারের সঙ্গে গোপনে শলা পরামর্শ করতেন ,সেসব খবর ও মমতার না জানবার কথা নয়। কিন্তু এইসব সম্পর্কে মোহন ভাগবতের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব নেওয়া মমতা একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি ।বিজেপি ঘনিষ্ঠ হিসেবে জগদীপ ধনকারকে একাধিকবার চিহ্নিত করলেও ধনকারের সঙ্গে আরএসএসের সম্পর্ক নিয়ে কিন্তু মমতা আশ্চর্যজনক নীরবতা পালন করে গিয়েছেন ।

সেই জগদীপ ধনকর কে উপরাষ্ট্রপতি করবার লক্ষ্যে দার্জিলিঙে আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে গোপন বৈঠক পর্যন্ত মমতা করেছেন ।প্রকাশ্যে যে বৈঠককে তিনি সৌজন্যের চা চক্র বলে দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। তাই এই মমতার কংগ্রেস সম্পর্কে হঠাৎ করে নতুন ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভেতরে আরএসএসের আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে বিরোধী ঐক্যের মধ্যে কিভাবে বিচ্ছিন্নতা আনতে পারা যায় ,সেই কৌশলের একজন আড়কাঠি হিসেবে মমতা ভূমিকা উঠে আসতে শুরু করেছে।

এনডিএ নামক নীতি বিহীন ,সুবিধাবাদী জোটের আওতা থেকে বিহারে নীতীশ কুমার বেরিয়ে আসার পরে হিন্দি বলয়ে যে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি হয়েছে ,সেই বিন্যাসকে ভেস্তে দেওয়ার লক্ষ্যেই মমতাকে দিয়ে আরএসএস ,কংগ্রেস স্তুতি উচ্চারণ করিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের ভেতরে নতুন করে বিভ্রান্তির পরিবেশ তৈরি করতে সমস্ত ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেছে।