
একলহমায় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আবার কিছুক্ষণের জন্য মমতা ব্যানার্জী বিতর্কের শিরোনামে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বৃহৎ সংবাদ মাধ্যম শুধুমাত্র তাঁর কর্মসূচি, বক্তব্য গতিবিধি অনুসরণ করার জন্য একজন করে সাংবাদিক মোতায়েন করেছে। তারা গত ১৯শে অক্টোবর শিলিগুড়ির বিজয়া সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে “সিঙ্গুর থেকে টাটাকে আমি তাড়াইনি,সিপিএম তাড়িয়েছে ” -শুনে হেডলাইন থেকে সন্ধ্যা বেলার টক শো অবধি সম্প্রচারের আয়োজন করে ফেলেছে। খরচ হচ্ছে বেশ কিছু নিউজপ্রিন্ট। যেখানে বিবৃতির পাল্টা বিবৃতি ছেপে লেখা হচ্ছে “জমে উঠেছে রাজনৈতিক তরজা “! কিন্তু মাসে লাখটাকা মাইনের দুঁদে সাংবাদিকদের কারুর বুকে এইটুকু সাহস নেই যে ক্যামেরার সামনে আঙুল তুলে মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন বা প্রধান সংবাদে লেখেন ,”আপনি মিথ্যা কথা বলছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী!” তাঁকে সরাসরি মনে করিয়ে দেওয়ার সাহস নেই যে, কৃষকের স্বার্থের কথা বলে সিঙ্গুরে মোটরগাড়ি কারখানার নির্মাণ বন্ধ করিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথমে পঞ্চায়েত,তারপরে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। অবশ্যই মিডিয়ার এবং বিজেপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল,বিদ্বজ্জন, কর্পোরেটের সহায়তা প্রাপ্ত এন জি ও র সহায়তায় মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের একটি বড়ো অংশের মানুষকে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআইএম কে “কৃষক বিরোধী ” সাজিয়ে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন বামফ্রন্ট সরকার কৃষিজমি “কেড়ে নিয়ে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেবে”। মমতা ব্যানার্জীর রাজনৈতিক গুরু প্রয়াত সুব্রত মুখার্জীর সংবাদ পত্রে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল এরকম,”পশ্চিমবঙ্গে শাসকদল কারখানা তৈরি করে বাহবা নেবে আর আমরা বিরোধী দল বসে বসে দেখব?” এবং এটাই ঘটনা মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর কোন শিল্পসংস্থা যেমন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি তেমনি ২০২০ সালের ২৭শে নভেম্বর ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি না পেয়ে আন্দোলনরত কর্মপ্রার্থীদের ” তোমাদের সবার চাকরি হবে” বলে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার প্রায় দুই বছর পরেই ২০২২ সালের ১৮শে অক্টোবর তাঁর নিযুক্ত এবং অনুগত প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান গৌতম পাল ঢোক গিলে বলেছেন, “এই কর্মপ্রার্থীদের চাকরির দাবি বেআইনি!” ঠিক পরেরদিন ১৯শে অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গুর নিয়ে ডিগবাজি বক্তব্যে কিছুক্ষণের জন্য এই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কিছুক্ষণের জন্য আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু নিয়োগপত্রের দাবি করে কলকাতার বিধাননগরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ কার্যালয়ের সামনে অবস্থানে বসা আন্দোলনরত কর্মপ্রার্থীরা পিছু হটেন নি। কারণ তাঁরা এবং পশ্চিমবঙ্গবাসী জেনে গেছেন, টাকার বিনিময়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের নির্দেশে তাঁদের প্রাপ্য চাকরি দিয়ে দেওয়া হয়েছে অযোগ্যদের।

ইতিহাস রচিত হয় রাজার ইচ্ছায় কিন্তু মানুষের ভাষায় লেখা ঘাম, রক্ত ও বঞ্চনার ইতিহাস রাজা গায়ের জোরে পাল্টাতে পারেন না! রোমের ইতিহাসে সম্রাট নীরোর নিষ্ঠুরতা নিয়ে যত শব্দ লেখা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃতভাবে রয়েছে হেনরিক সিনকিউইজ এর লেখা উপন্যাস “ক্যুয়ো ভাদিস ” এ। যদিও যিশু খ্রীষ্ট ও খ্রীষ্ট ধর্মের মহিমা প্রচার করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল এই উপন্যাস। তবুও লিউ ওয়ালেস রচিত “বেন হার” এর মতো এই উপন্যাসেও প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আর্থসামাজিক চিত্র এবং অভিজাত সমাজে প্রচলিত নিষ্ঠুরতা বিশেষত প্রজাদের প্রতি সম্রাটদের অমানবিক ব্যবহার ও বঞ্চনার জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের শেষ পনেরো বছরের রাজনৈতিক আবর্তে যে প্রতারণা ও নৈরাজ্যের আবহ দেখা গেছে তা খুব দ্রুত এক স্বৈরাচারী শাসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে। দায়িত্ববোধ শূন্য উচ্চাকাঙ্খী রাজনীতি একটি কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করার জন্য বিধানসভা ভাঙচুর করা থেকে ছাব্বিশ দিন অনশনের ছলে হাইওয়ে অবরোধ কর্মসূচি হয়ে সরকার পরিবর্তনের পরে প্রায় সত্তর শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যাওয়া একটি অত্যাধুনিক গাড়ি কারখার কাঠামো গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ করে শাসকের ব্যক্তি অহংকারকে তুষ্ট করায় শেষ হয়।
এই ঘটনাপ্রবাহকে ” কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস” হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠ্যক্রমে যুক্ত করে দেওয়াও এই অহংকারী শাসকের আধিপত্যবোধের প্রকাশ। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী কর্পোরেট সংস্থাগুলির স্বার্থের সংঘাতকে পুরোপুরি নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ব্যবহার করে “অনিচ্ছুক কৃষকদের দাবি”র নামে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পায়ন নীতির রূপায়ণ করার পথে বিরাট বাধা তৈরি করতে পেরেছিলেন। অধিগ্রহণ করা ৯৯০ একর জমির মধ্যে চারশ একর জমি ফিরিয়ে না দিলে কারখানা করতে দেওয়া হবেনা, এই শ্লোগান তুলে শুরু করা মমতা ব্যানার্জীর আন্দোলন কার্যত “কৃষিজমিতে শিল্প হলে কৃষকরা খাবে কি আমরা খাব কি?” এই প্রশ্নে কারখানার প্রকল্প বাতিল করার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কারখানার জন্য সিঙ্গুরের জমিদাতা কৃষকদের ওপর যেমন হামলা করেছিল মমতা ব্যানার্জীর দল তৃণমূল কংগ্রেসের দলবল তেমনি আক্রান্ত হয়েছিলেন টাটার কর্মীরাও। একাধিকবার নির্মীয়মান মোটর কারখানার চত্বরে তৃণমূলের গুণ্ডারা হামলা করেছিল। মমতা ব্যানার্জীর চিহ্নিত তথাকথিত ” অনিচ্ছুক কৃষকদের” অনেকেরই কোন জমিই ছিল না। তারা সরকারি উদ্যোগে শিল্পের জন্য কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ,ক্ষতিপূরণ কোনটাই চাইছিল না নিজস্ব ব্যবসায়িক স্বার্থে। ২০০৮ সালের ২৪ শে আগস্ট সিঙ্গুরে নির্মীয়মান কারখানার সামনে জাতীয় সড়কে অবস্থানে বসার সময় মমতা ব্যানার্জী বক্তৃতায় বলেছিলেন,”টাটারা অন্য রাজ্যে চলে যাক। ” ২০০৮ সালের ৩ রা অক্টোবর মহাকরণে সিঙ্গুরে কারখানা না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান রতন টাটার মুখে সেই স্মরণীয় খেদোক্তি শোনা গেল,”মমতা ব্যানার্জী তো ট্রিগার টিপে দিলেন।”৭ ই অক্টোবর টাটা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে গুজরাটের সানন্দে মোটর কারখানা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
২০০৬ সালে ১৮ই মে মহাকরণের রোটাণ্ডায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের উপস্থিতিতে রতন টাটা সিঙ্গুরে মোটর গাড়ির কারখানা তৈরির কথা ঘোষণা করার পরে কৃষিজমিতে শিল্প না করার দাবি নিয়ে ৫ ই অক্টোবর,৯ অক্টোবর এবং ১ লা ডিসেম্বর তিনটি বাংলা বনধের ডাক দেন মমতা ব্যানার্জী। তাঁকে নিগ্রহ করা হয়েছে এই অজুহাতে ৩০শে নভেম্বর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে থেকে সংবিধানের বই হাতে নিয়ে মমতা ব্যানার্জী নিজের দলের বিধায়ক ও নেতাদের দিয়ে ভাঙচুর চালান। ৩রা ডিসেম্বর থেকে ধর্মতলায় শুরু হয় তাঁর ছাব্বিশ দিনের সেই বহু আলোচিত ও বিতর্কিত অনশন। তারই মধ্যে ১৮ই ডিসেম্বর সিঙ্গুরে পাওয়া যায় তাপসী মালিকের অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি করে ধর্ষণ ও খুনের মিথ্যা অভিযোগে সিপিআইএম এর প্রবীণ নেতা সুহৃদ দত্তকে গ্রেফতার করানো হয় পরে তিনি ছাড়া পেয়ে গেলেও তাঁর এবং সিপিআইএম সহ সিঙ্গুরের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। দু বছর পরে টাটার মোটর গাড়ি কারখানা তৈরির প্রকল্প পাকাপাকিভাবে বাতিল হওয়ার মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের আধিপত্য ও শিল্প সম্ভাবনার মৃত্যু ঘন্টা বাজানো নিশ্চিত হয়েছিল। ২০১৬ সালের ১৯শে কলকাতা পুরসভার যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে মোটর কারখানার নির্মীয়মান শেড গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছিল।
এই ঘটনায় মমতা ব্যানার্জী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল তার জেরেই তিনবার নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করলেও কোন বড়ো শিল্প সংস্থা কারখানা তৈরির জন্য বিনিয়োগ করেনি পশ্চিমবঙ্গে। শিল্পসম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সামনে প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন ঘটেনি। কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়নি। এরই পাশাপাশি টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ,প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সহ শিক্ষা দপ্তরের ছয়জন কর্তাকে ইডি সিবিআই য়ের হেফাজতে থাকা মমতা ব্যানার্জীর বিশ্বাসযোগ্যতায় বিরাট ধাক্কা দিয়েছে সন্দেহ নেই। একদিকে ধর্মতলায় বিভিন্ন জায়গায় টানা অবস্থান করছেন বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীরা অন্যদিকে সল্টলেকে প্রতিশ্রুতিমত নিয়োগ না পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সামনে অনশনে বসেছেন ২০১৪ র টেট উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীরা। বিব্রত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার করে সাময়িকভাবে মুখরক্ষা করার অন্য উপায় ছিল না।