এখন আর চোখে পড়ে না “সততার প্রতীকের “–এর কোন কাট আউট। এই “সততার কাট আউট -ই” ২০০৮ এর পর থেকে ২০১২ -১৩ পর্যন্ত রাস্তার ধারে ,মোড়ে, নানান জায়গায় শোভা পেত । কি এমন হলো, হঠাৎ  সেইসব উজ্জ্বল, রাস্তা আলো করা কাট আউট উধাও হয়ে গেল? আসলে সততার প্রতীকের আড়ালে যা কামানো, ঠকানো, সব ক্ষেত্রেই কাটমানি হজম করা ,তা প্রায় হয়ে গেছে।এখন আবার “দিদির সুরক্ষা কবচ” এর কর্মসূচি চলছে। রাস্তায় শোভা পাচ্ছে বড় বড় তোরণ, দিদির কাট আউট। দিদির সুরক্ষা কবচকে  মজবুত করতে দিদির দূতেরা গ্রামে গ্রামে যাচ্ছেন। এই দূতেরা সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গ্রামে যখন যাচ্ছেন বেশীর ভাগ গ্রামেই বিক্ষোভ অশান্তি লেগে যাচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনকে ছুটে যেতে হচ্ছে সেইসব জনবিক্ষোভকে সামাল দিতে। তাহলে এ কেমন সুরক্ষা কবচ ! জনসাধারণকে সুরক্ষার আড়ালে দিদিকে সুরক্ষার পরিকল্পনাতো  আসলে বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে ।ভাইয়েরা বলছেন,” এই কবচের মাহাত্ম্য নাই।”

এখন আবার খবরে প্রকাশ, দিদির অনুপ্রেরণায় ভাইপোর দুমাস ব্যাপী, কোটি কোটি টাকা খরচ করে”সংযোগযাত্রা” শুরু হতে চলেছে।পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে দিদি-ভাইপোর “মেন্টররা “নানান টোটকা দিয়ে যাচ্ছেন। কোনো টোটকাতেই আর  সেভাবে কাজ হচ্ছে না। উপরতলার দাদারা থেকে নিচের তলার ভাইয়েরা পর্যন্ত যা করে রেখেছে, তা কি আর পরিষ্কার করা যাবে? আর কত চাপা দেবেন আপনারা ? একটা চাপা দিতে গিয়ে আর একটা বেরিয়ে পড়ছে,–সত্য ক্রমশ প্রকাশিত হচ্ছে। দিদি ও ভাইপো সততা ও নৈতিকতার ভাষণ দেওয়ার অধিকার ক্রমশ হারাচ্ছেন না কি? রাজ্যে চলমান ঘটনাপ্রবাহ যা দৈনন্দিন ঘটে চলেছে তার দায় কি তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারেন? খোদ মুখ্যমন্ত্রী সহ মন্ত্রী, এমএলএ, এম পিরা তাঁরা কেউ কিছুই জানেন না বা জানতেন না –এ কথা কি মানুষ বিশ্বাস করবে?না। ইতিমধ্যেই মানুষের বিশ্বাসভঙ্গ হতে শুরু করেছে। বামপন্থীদের মিছিলে ও সমাবেশে মানুষের ভিড় বাড়ছে। চাকরি প্রার্থীদের, বকেয়া ডি এ প্রাপক কর্মচারীদের, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র যুবদের আন্দোলনের ঝাঁঝ ও তীব্রতা বাড়ছে। পুলিশ দিয়ে দমনপীড়ন চালিয়ে, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আন্দোলন ভাঙতে চাইছে। সে গুড়ে বালি। মতাদর্শ ও দাবিদাওয়া সহ অধিকার রক্ষার লড়াই। এ লড়াই ভাঙা খুব কঠিন। একদিকে বামপন্থীদের নাছোড়বান্দা লড়াই আর একদিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের নির্দেশ/আদেশে (চপেটাঘাত) রাজ্য সরকার একেবারেই ল্যাজে গোবরে। ফলে সরকারটাও দুর্বল হচ্ছে। এই সব কারনেই পঞ্চায়েতের ভোট কবে হবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলতে পারছেন না। এখনকার যে পঞ্চায়েত চলছে সেটা তো যথাযথভাবে নির্বাচিত পঞ্চয়েত ব্যবস্থা নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনীত চাপিয়ে দেওয়া পঞ্চায়েত। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে, আরামবাগ মহকুমা শাসকের কার্যালয়ের সামনে নমিনেশন করতে যাওয়া বাম মহিলা প্রার্থীর চুলের মুঠি ধরে কাছারে দেওয়া আমাদের মনে আছে, আমরা ভুলে যাইনি। বিরোধীপক্ষকে কোন প্রার্থী দিতে না দিয়ে জোর জুলুম করে পঞ্চায়েত দখল করেছিল। ২০২৩ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন আগেকার নির্বাচনের মতো হবে না, বামপন্থীরাও তৈরি হচ্ছে লড়াই করার জন্য। ফাঁকা ময়দান তারা আর ছেড়ে দেবে না। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই হবে তীব্র।

তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরের যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো ওদের দলের কেউ প্রার্থী হতে চাইছেন না। যার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের ঠিকাদাররা, জব কার্ডের সুপারভাইজার, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর একাংশ মেয়েদের মধ্যে প্রার্থী করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রার্থী নিয়ে এলাকায় এলাকায় গন্ডগোল শুরু হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের কার্য্যালয়ে তিন চারটে করে তালাও পড়ছে। ওদের গোষ্ঠীর লড়াইয়ে এলাকা রক্তাক্ত হচ্ছে,  খুনও হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ আজ  বিপন্ন। এলাকা দখলকে কেন্দ্র করে দু পক্ষের হাড় হিম করা  সন্ত্রাসও  হচ্ছে কোথাও কোথাও। এরকম অবস্থায় নিজেদের ঘর সামলাতে ব্যস্ত বলেই কি নির্ধারিত সময়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন করছে না! সময়ই বলবে সে কথা।

এখন সংবাদপত্র, টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে, বোমা -অস্ত্র উদ্ধার, অস্ত্র কারখানার হদিস পাওয়া, গাঁজা উদ্ধার, আর বস্তা বস্তা টাকার বান্ডিল উদ্ধার। ধর্ষণ, খুন বেড়েই চলেছে রাজ্যে। নৈরাজ্যের চরম অবস্থা। চোর,ডাকাত, খুনি যেমন ধরা পড়ছে, একইভাবে বেশি ধরা পড়ছে মন্ত্রী, এমএলএ, নেতা ও তার বান্ধবীরা। এক একটা সূত্র বের হচ্ছে, আর নতুন নতুন এম এল এদের বাড়িতে সিবিআই হানা দিচ্ছে এবং গ্রেফতার হচ্ছে। সাধারণত জনগণের তাড়া খেয়ে ছিঁচকে চোর দৌড় লাগায় কিংবা পাঁচিল টপকায়। আর এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি জনপ্রতিনিধি তথা গণ্যমান্য মানুষ এম এল এ-রা সি বি আই এর ভয়ে মোবাইল ফোন পুকুরে ছুঁড়ে ফেলছেন, পাঁচিল টপকাচ্ছেন। না জানি অদূর ভবিষ্যতে আরো কত এরকম থ্রিলারে ভরপুর নাটকের দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে। তবে এটা ঠিক যে, তদন্তকারী পুলিশের তাড়া খেয়ে পাঁচিল টপকানো কিংবা পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া কোন এম এল এ, নেতার নজির আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই।

পশ্চিমবঙ্গের গৌরব মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছে,আর সারা বিশ্বে বাঙালী হিসেবে আমাদের তথা জনগণের মুখ পুড়ছে —গরিমা ভুলন্ঠিত হচ্ছে। বিচার বিভাগের তদারকিতে মন্ত্রী, এমএলএ, তাদের বান্ধবীসহ – আমলা নিয়ে প্রায় তিন ডজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আজ জেলের অন্দরে অন্তরীণ –এই দৃশ্য এক সময়ে ছিল কল্পনারও অতীত, কিন্তু এই সরকার তথা তৃণমূল কংগ্রেস দলের বিদগ্ধ নেতৃত্ব তা কত দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছে তা যেমন উপভোগ করতে হয় তা করুন, আবার এর তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা করুন। বাহো। তারিফ করতে হয় এই সমস্ত কুলাঙ্গার বাঙালি নেতা ছাতার মাথাদের।  তা সত্ত্বেও এদের ন্যূনতম লজ্জাবোধ নেই, জোর গলায় বড় বড় কথা সমানে বলে চলেছেন দিদি– ভাইপো থেকে পাড়ার চুনোপুঁটি, চার আনা আট আনার নেতারা। এমনকি সারদা কাণ্ডের জেলখাটা আসামী কুনাল পুলিশ ভ্যান থেকে নামার সময়  আঙুল উঁচিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিশানা করেছিল। সেই কুনাল এখন দিদি ও ভাইপোকে তৈলমর্দন করে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে গলাবাজি করে দুর্নীতিকে চাপা দিতে চাইছেন। কেউ আবার মঞ্চে, দুর্নীতি প্রমাণিত হলে ফাঁসির দড়ি গলায় ঝোলানোর হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছেন। এসব শুনে আমজনতার “ঘোড়ায় হাসবো কত্তা”অবস্থা হওয়ার জোগাড়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস যা বলে গেছেন তা পশ্চিমবঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন,” এমন এক সময় আসবে যখন জ্ঞানীরা জ্ঞানী হবার কারণে অনুশোচনা করবে, মূর্খরা তাদের মূর্খতার জন্য গর্ব করবে, আর দুর্নীতিবাজেরা তাদের দুর্নীতির জন্য  উল্লাস করবে। “তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীরা খোদ মুখ্যমন্ত্রী সহ আজ তারা তাই করছেন।

২০১১ সালে “মা মাটি মানুষের “সরকার এলো– আর চিটফান্ডের রমরমাও শুরু হল। যার পরিণতি সারদা নারোদা কান্ড। চিটফান্ডওয়ালারা  রাজ্যের আম আদমীর পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা গায়েব করে দিল। সিবিআই  তদন্ত কবে শেষ হবে, তা কেউ জানে না। যাঁরা টাকা জমা দিয়েছিলেন, তাঁদের ” হালও  গেল ,হেলেও গেল”অবস্থা। ঠিক এই সময়েই বাংলার সবজান্তা মুখ্যমন্ত্রী বললেন,” যা গেছে, তা গেছে। শান্ত থাকুন, আমি আপনাদের পাহারাদার। “চিটফান্ডে সর্বহারাদের কোন সুরাহা না করে উনি পাহারা দিলেন সেই প্রতারক চিটফান্ড মালিকদের। কারনটাও খুব সহজ, কারণ আমরা দেখতে পেয়েছি সেই সময় তার সৃষ্টি করা দুর্বোধ্য কিছু ছবি কোটি কোটি টাকায় কিনছেন সেইসব মালিকরা। আর বাংলার বিনাশের শুরুটা তখন থেকেই সুচারুভাবে সৃষ্টি করলেন আমাদের প্রিয় দিদি তথা জনগণের ভোটে(?) জিতে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বেচারা সুদীপ্ত সেন! তাকে বোঝানো হয়েছিল বশংবদ রাজনীতির স্বার্থে স্তাবক সাংবাদিকতার সাম্রাজ্য গড়তে পারলে সেটাই হবে তার রক্ষা কবচ। দিদির অনুপ্রেরণায় সেই সময় চিটফান্ডের মিডিয়ারাজ তৈরি করেছিলেন সুদীপ্ত সেন। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকায় মোট তেরোটি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া চালাতো সুদীপ্ত সেন। ঐ মিডিয়ার মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের প্রচারের ঢ়েউ তুলেছিল তেমনি সি পি আই (এম) সহ বামপন্থীদের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন কুৎসা ও মিথ্যা রটনা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও রক্ষা কবচ কাজ করল না সুদীপ্ত সেনের। সুদীপ্ত সেন ও তাঁর সঙ্গিনী দেবযানি গ্রেপ্তার হলেন। এখন তাঁরা জেল বন্দি। তারপর এল ত্রিফলা আলোর দুর্নীতি কান্ড, ত্রিফলার ৬ কাহন এবং তার সঙ্গে যুক্ত হলো সারা রাজ্য নীল সাদা রঙে রাঙানোর নামে  ভাঁওতাবাজি ও লুঠের আরেক ব্যবস্থার বিপুল আয়োজন।

বেশ কিছুদিন ধরে এক এক করে নেতা-মন্ত্রীদের জেলে ঢোকার প্রতিযোগিতা শুরু হলেও তাদের দুর্নীতি শুরু জন্মকাল থেকেই।২০১১ সালে সরকার গঠনের পর থেকে দুর্নীতির গতি পেল এবং তা ধীরলয়ে প্রাতিষ্ঠানিক হতে হতে আজ Open to all হয়ে গেল,তা আজ  প্রমাণিত। শুধু পাপের ঘড়া ষোলকলা  পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল তারা। ২০১১ সাল থেকে একের পর এক হিমশৈলসম  দুর্নীতির সব কটা প্রমাণ হলেই জেলে ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই অবস্থা হবে। আর তা কেবল সময়ের অপেক্ষা বলেই রাজ্যের তথা দেশের মানুষ মনে করেন।আর

বিজেপি কেন্দ্রে বসে করছে দেশ বিক্রি, দেশের সম্পদ লুঠ। আমাদের দেশের ৫৭ জন কর্পোরেটের দখলে ৭০ শতাংশ দেশের সম্পদ। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ আজ চরম শোষনের শিকার এবং দারিদ্র্যতার কবলে। এই সীমাহীন বৈষম্য ও বঞ্চনার ফলে বেড়ে চলেছে দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারীর তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা, ছাঁটাই, সামাজিক অন্যায়, চিকিৎসার চরম সংকট। আর এস এস পরিচালিত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কর্পোরেটমুখী নীতির কারণে আজ এই দুরবস্থা। এখানে কর্পোরেটদের পাহারাদার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর এরা করছে রাজ্যের চাকরি বিক্রি, সঙ্গে রাজ্যের জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রাথমিক চাহিদা, তাদের অন্ন-বস্ত্র – বাসস্থানের শেষ সম্বলটুকুও শুষে নিয়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছে।

মানুষের সামনে আজকে সুযোগ, তাদের যথার্থ হিতাকাঙ্খীদের সঠিকভাবে চিনে নেওয়ার। বামপন্থীরাই যে তাদের শেষ ভরসাস্থল, তাদের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এই উপলব্ধি আজ সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এমনকি ২০১৯ এর নির্বাচনের পর যে সকল গরীব মানুষ বিজেপির দিকে চলে গিয়েছিল তারাও আস্তে আস্তে লাল ঝাণ্ডা মুখি হচ্ছে, মানুষের আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের এই আগ্রহকেই আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামপন্থীদের যথার্থভাবে কাজে লাগাতে হবে। বামপন্থীদেরকেই নিবিড়ভাবে গণসংযোগের মাধ্যমে বিকল্পের সন্ধান দিয়ে তাঁদের বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে হবে। মানুষকে সাথে নিয়েই ত‌ণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই গড়ে তুলতে পারলে তবেই দুর্নীতিমুক্ত পঞ্চায়েত তথা নিষ্কলুশ গণতান্ত্রিক পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।