রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে কারারুদ্ধ  বামপন্থী  অধ‍্যাপক ও লেখক জি এন সাইবাবা কারান্তরাল থেকেই যে বইটি  লিখেছেন তার নাম “Why Do You Fear My Way So Much?” শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে চলাফেরায় অক্ষম  সাইবাবাকে মুম্বাই হাইকোর্টের নাগপুর ডিভিশন বেঞ্চ জামিন দিলেও কেন্দ্রীয় সরকারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর চিন্তাধারা “রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক “- এই যুক্তিতে শীর্ষ আদালত সেই জামিন নাকচ করে দেয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে  বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কর্পোরেটের স্বার্থে বনভূমি কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করলেই তা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে।


 সরকারের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোন ব‍্যক্তি  প্রতিবাদ জানালেই তাঁকে “আরবান নকশাল” বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা প্রধানমন্ত্রী  নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য। এবার তাতে যুক্ত হয়েছে মাওবাদী মোকাবিলার তত্ত্ব। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি হরিয়ানার  সুরজকুণ্ডে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক  আয়োজিত দু দিন ব‍্যপী চিন্তনশিবিরে যেভাবে ” মাওবাদীদের মোকাবিলা”র পরামর্শ দিয়েছেন তাতে তথাকথিত  মাওবাদীদের  ব‍্যক্তিহত‍্যা ও বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাসের কর্মসূচির বিরোধিতা করা  বামপন্থীরাও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের চোখে  “দেশদ্রোহী” হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যেতেই পারেন! কৃষিজমি ও বনভূমি অধিগ্রহণ করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া, নগরায়ণের নামে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প,পরিষেবা এমনকি বীমা পর্যন্ত বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে সরকার মুনাফার বড়ো অঙ্ক নিশ্চিত করার জন‍্য। এর বিরুদ্ধে গরীব মানুষদের নিয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে তুললেই ” রাষ্ট্রদ্রোহী শহুরে নকশাল ” বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। কিছুদিন আগে এক টিভি চ‍্যানেলের সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, “সংসদীয় শক্তি নয়,আসলে বামপন্থীরা  বিপজ্জনক তাদের চিন্তাধারার কারণে। ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আয়োজনে চিন্তন শিবিরে তিনি বামপন্থীদের দমন করার ফ‍্যাসিস্ট পদ্ধতির ইঙ্গিত দিলেন “মাওবাদী” ” শহুরে নকশাল” তকমা দিয়ে আসলে তাঁদের  কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরে বাইরে থাকা বামপন্থীদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। বামপন্থীদের বড়ো অংশ ব‍্যক্তিহত‍্যার বিরোধিতা করলেও তাঁদের  গায়ে “হত‍্যা সন্ত্রাসের সংকীর্ণ রাজনীতি”র কলঙ্ক লাগিয়ে দিলে তাঁদের জনভিত্তিতে চিড় ধরার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে সরকার মনে করছেন। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম) কর্মীদের কাছে এই কায়দা নতুন নয়। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ব‍্যক্তি হত‍্যার রাজনীতিকে  বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী সন্ত্রাস তৈরি করতে ব‍্যবহার করে তৃণমূল নেত্রী  মমতা ব‍্যানার্জী বহু সিপিআইএম কর্মীকে হত‍্যা করিয়েছেন,ঘরছাড়া  করিয়েছেন। ২০১১ সালে বিধানসভা  ভোটে জিতে পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করার পরেই মাওবাদী নেতা  কিষেণজিকে হত‍্যা করান মমতা ব‍্যানার্জী। মাওবাদী নেতাদের একাংশকে  তৃণমূলে যুক্ত করানোর পর থেকেই মাওবাদীরা আসলে সিপিআইএম এই প্রচার শুরু করেন তিনি। কলকাতা পুরসভার অধিবেশনে সিপিআইএম কাউন্সিলরদের উদ্দেশ্য করে তৃণমূল পৌরবোর্ডের এক মেয়রপারিষদ স্পষ্টই বলেন “আপনারাই মাওবাদী “! কিন্তু নরেন্দ্র মোদির বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। প্রতিপক্ষ হিসাবে তিনি দেখেছেন,বামপন্থীদের  বিভিন্ন আন্দোলনের  প্রায়োগিক রূপরেখা নিয়ে পারস্পরিক  মতপার্থক‍্য থাকলেও   আদিবাসী জনজাতির অধিকার ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা, কর্পোরেটের হাতে প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষিজমির অধিগ্রহণ এবং মানবাধিকারের প্রশ্নে তাঁরা এক বিন্দুতেই অবস্থান করেন। তাই একই বন্ধনীতে, বামপন্থীদের রেখে আক্রমণ করার সহজ রাস্তাই নিয়েছেন তিনি। সুরজকুণ্ডে চিন্তন শিবিরে  নরেন্দ্র মোদির ব‍্যাখ‍্যার ভাষা অবশ‍্যই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন,” মাওবাদীরা শুধু বন্দুক নয় হাতে কলমও তুলে নিয়েছে। দেশের যুব সমাজকে লেখনী দিয়েই বিভ্রান্ত করতে চায় তারা। এই প্রবণতা রুখতেই হবে।” বোঝাই যাচ্ছে কৃষক আন্দোলনের ফলে পিছু হটে কর্পোরেটভোগ‍্য নয়া  কৃষি আইন স্থগিত রাখতে বাধ‍্য হওয়ার জ্বালা ভুলতে পারেন নি মোদি। তাই,  দ্রব‍্য মূল‍্যবৃদ্ধিসহ যাবতীয় সমস‍্যার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনবিক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন‍্য তিনি  ফ‍্যাসিস্ট সুলভ পদক্ষেপ নেওয়ার  প্রস্তুতি নিচ্ছেন।


বস্তুত কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে বিভাজনের রাজনীতি যেমন বিজেপি সরকারের বৈশিষ্ট্য তেমনি কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর ব‍্যাপক ব‍্যবহার করতেও পিছপা হয়নি তারা। ২০১৯ এর পর  হিন্দুত্ববাদের নামে অত‍্যাচার  মুসলমানদের ওপরই শুধু নয়,খ্রিষ্টান,আদিবাসী জনজাতি,দলিত মহিলা,ছাত্র বুদ্ধিজীবীদের ওপরেও নামিয়ে আনা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে লেখক শিল্পী মানবাধিকার কর্মীদের “আরবান নকশাল ” বলে চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে  আইনি ব‍্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাদ্রী স্ট‍্যান স্বামী কারাবন্দী অবস্থাতেই মারা গেলেন সরকারের অমানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার বিরোধী মনোভাবের কারণে। তিস্তা শীতলবাদ,সুধা ভরদ্বাজ,ভারভারা রাওদের জামিন দিতে বহু টালবাহানা করেছে সরকার। এখনো আনন্দ তেলতুম্বে, উমর খালিদরা জেলবন্দী। 


নরেন্দ্র মোদি যখন সুরজকুণ্ডে এই দমনপীড়নের সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছেন সেই দিনই  মুম্বাইয়ে   নিহত যুক্তিবাদী কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের নেতা নরেন্দ্র দাভোলকরের স্মৃতিতে আয়োজিত এক চিত্রপ্রদর্শনী উদ্বোধন করতে গিয়ে কিংবদন্তি অভিনেতা  নাসিরউদ্দিন শাহ  বলেছেন,আমার গর্ব হয় আমি এমন এক যুগে বাস করি যখন নরেন্দ্র দাভোলকর,এম এম কালবূর্গি,গৌরী লঙ্কেশ সহ প্রগতিশীলরা অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। সত‍্য বলার অপরাধে  বহু শিক্ষক সমাজকর্মী জেলে কাটাচ্ছেন। কতদিন তাঁদের জেলে কাটাতে হবে আমরা জানিনা। ” অর্থাৎ বিজেপি সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী  দমননীতির প্রকাশ যত উৎকটভাবে হচ্ছে ঠিক ততটাই তীব্রতায় প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন নাগরিক সমাজ। এক ধর্ম এক ভাষা নীতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদিকে চিন্তন শিবিরে দেখা গেল  এক দেশ এক পুলিশ নীতির পক্ষেও সওয়াল করতে। অর্থাৎ রাজ‍্যের হাত থেকে আইন শৃঙ্খলা সরিয়ে কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নতুন করে আঘাত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ‍্যে। আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্র রক্ষার জন‍্য আন্দোলনে  নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবে  বামপন্থীদের হাতেই থাকবে একথা জানেন বলেই  প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণের লক্ষ্য বামপন্থীরা।