মৃত্যুর পরে প্রিয় মানুষকে দেবতা বানানো এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক আবেগ। সদ্যপ্রয়াত আমাদের প্রিয় নেতা কমরেড মানব মুখার্জি কে নিয়ে সারা রাজ্যের বামপন্থী কর্মীদের মধ্যে, বিশেষ করে ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রাক্তন-বর্তমান কর্মীদের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর আবেগ কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। সেরকম একটা পরিস্থিতিতে এক লহমায় মানবদার অবিচুয়ারি লেখা সত্যিই কঠিন।

মানবদা দেবতা নয়,দোষে-গুনে মানুষ ছিলেন। সেই মানুষ কতটা বড়? মানুষ আসলে তার চেতনার সমান বড়। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। যোধপুর বয়েজ, সেন্টজেভিয়ার্স হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস এ্যডমিনিষ্ট্রেশনের উজ্জ্বল ছাত্র। সেটা একজন স্বপ্ন দেখা মানুষের খুব বড় পরিচয় নয়। বড় মাইনের চাকরির প্রলোভন ছেড়ে কমিউনিষ্ট পার্টির সর্বক্ষনের কর্মী হয়েছিলেন। না,ভবিষ্যতে কোনও দিন মন্ত্রী হতে পারেন, সেই সম্ভাবনার অঙ্কুর ও সেদিন ছিলনা, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। একটা আত্ম জিজ্ঞাসা সংবেদনশীল নব যৌবনকে আলোড়িত করে। সেটা হল” এ জীবন লইয়া আমি কি করিব”। যদি এই আর্ত জিঞ্জাসা আপনার রাতের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়, তবে আপনি বিপ্লবী ও নন, সৃজন কর্মের স্রষ্টা ও নন।

কমরেড, মানব মুখার্জি যখন তুখোড় ছাত্র নেতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সম্পাদক, যুবশক্তি পত্রিকার সম্পাদক, যুবফেডারশনে রাজ্য সম্পাদক সেই মানবদাকে বয়সের কারনেই কাছ থেকে দেখিনি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক হিসেবে চার/পাঁচ বছর তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল আমার। জেলা পার্টির তরফে তিনি দেখভাল করতেন আমাদের।

সদ্যযৌবনে পা দেওয়া নানা পরিবার থেকে আসা একদল ছাত্র, যারা অনেক জিঞ্জাসায় জর্জরিত, সেই প্রশ্নমুখর অমল,কমল,ইন্দ্রজিৎ দের মানবদা বড় আদর করে বোঝাতেন দ্বন্দ্বতত্ব, সমাজ সভ্যতার ক্রমবিকাশ, জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল বোঝাপড়া। একবারে জীবন থেকে উদাহরণ দিতেন,আপ্তবাক্য আওড়াতেন না যান্ত্রিকভাবে।

নতুন শিং ওঠা বাছুর যেমন দৃশ্যমান সব বস্তুকেই গুতোতে চায়,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোর লাগা যৌবনে দুনিয়ার যা কিছু নতুন নতুন ধারণা, তত্ব সেগুলোকে নির্বিচারে পড়ে পুরনোকে অস্বীকার করার একটা ঝোঁক এ বয়সের বৈশিষ্ট্য। পিতার আয়নায় ঢিল না ছুড়লে যৌবনের তৃপ্তি নেই। তাতে অনেক সময় ভুল মতাদর্শে ও ভেসে যায় কেউ কেউ। মানবদা নতুন প্রজন্মের এই বৈশিষ্ট্য কে মানবদা ভীষণ বুঝতেন। সেই মন পড়তে পারতেন আমাদের মানবদা।সেই কারনেই ছাত্র-যুবদের কাছে তিনি এতটা জনপ্রিয়।সেইসব পড়তে তিনি কখনও নিষেধ করতেন না। বলতেন ,লোকে বাজার থেকে মাটির হাড়ি বাজিয়ে কেনে। তোমরা বাজিয়ে নিতে ছাড়বে কেনো। কিন্তু মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে সেগুলোর তুল্যমূল্য তুলনামূলক আলোচনা করতে বলতেন। ধৈর্যের সঙ্গে বুঝিয়েছিলেন উত্তর আধুনিকতা আসলে আধুনিক যুগের ভাববাদ।

কৈশোর পেরোনো ছাত্র আন্দোলনেরএকটা প্রজন্মের কমিউনিষ্ট পার্টিতে আসার আগে একটা বাফার জোন থাকে। সেই বাফার জোনে মানবদা পশ্চিমবঙ্গে অন্যতম সেরা মার্কসবাদী শিক্ষক।

বলা,লেখা,পড়া,বাচনভঙ্গি ঈর্ষনীয়। একবার জানতে চেয়েছিলাম, লেখালিখির ব্যাপারে আপনি কাকে ঈর্ষা করেন? মানবদা অকপটে শ্যামল চক্রবর্তীর নাম বলেছিলেন।

রাজনীতিক না হয়ে শুধু লেখালিখি করলেও মানবদা স্বনামে পরিচিত হতে পারতেন। তাঁর রেখে যাওয়া দুটো উপন্যাস “কাঠের ঘোড়ার সওয়ার” ,”একটি অলৌকিক শহরের কাহিনী” যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

মন্ত্রী হিসেবে ও একজন সফল মন্ত্রী ছিলেন। একাধিক দপ্তর সামলেছেন। আজকের সেক্টর ফাইভ গড়ে তোলার পিছনে নিরলস পরিশ্রম করেছেন।

 

যুবকল্যান মন্ত্রী হিসেবেই গানমেলা,কবিতা উৎসব এসব মানবদার উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল।

মানবদার প্রথম উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যে কিনা সমাজবদলের স্বপ্ন দেখা একজন রাজনৈতিক কর্মী, মৃত্যুকালীন সময়ে মায়ের মুখে শোনা ইমন রাগ গেয়েছিল।আমাদের প্রিয় মানবদাকেও বিভিন্ন প্রজন্ম শিহরন জাগানো ইন্টারন্যাশনাল গাইতে গাইতে হাঁটলো তাঁদের প্রিয় পদাতিকের সাথে।ইয়ং ইন্টালেকচুয়াল তৈরির শিক্ষক কমরেড মানব মুখার্জি লাল সেলাম

https://youtu.be/7MNet4FPy_Q