আমার চেয়ে বছর দেড়েকের বড়। আমি মানবদা বলে ডাকতাম। আশির দশকের গোড়া থেকেই চিনি। আমি কাজ করতাম জেলায়।   মানবদা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক।এসএফআই কলকাতা জেলা কমিটির সভাপতি। রাজ্যেরও নেতা। ছাত্র আন্দোলন থেকে বিদায় নিয়ে যুব আন্দোলনে। প্রথমে কলকাতা জেলার নেতা। তারপর রাজ্যের নেতা। ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মুখপত্র যুবশক্তি-র সম্পাদক। যুবশক্তি-র পাতায় ঝলসে উঠতো তাঁর ক্ষুরধার লেখনী।যেমন যুব জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা, তেমনই বাজারি গণমাধ্যমের কুৎসিত আক্রমণের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ ও যুক্তিপূর্ণ জবাব। সহজ,সরল অথচ শানিত লেখা। সব মিলিয়ে যুবশক্তি তখন প্রকৃত অর্থেই যুব সংগ্রামের হাতিয়ার।১৯৯০ সাল, আমি যখন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন নদিয়া জেলা কমিটির সম্পাদক, তখন মানবদার সাথে সাংগঠনিক যোগাযোগ বাড়ে। বাড়ে ঘনিষ্ঠতাও। এই সময় নদিয়া জেলায় দু’দিনের রাজনৈতিক শিক্ষা শিবির হয়। জাতীয় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন মানবদা। সেদিনের আলোচনায় নতুন প্রজন্মের নতুন নেতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯১ সাল। অক্টোবরের ২ থেকে ৪ তারিখ পর্যন্ত সল্টলেক স্টেডিয়ামে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অষ্টম সম্মেলন। এই সম্মেলনেই মানবদা রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯৯৬সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে রাজ্য সংগঠনে মানবদার সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। রাজ্য সম্পাদক মন্ডলী, রাজ্য কমিটি, রাজ্য কাউন্সিল, কেন্দ্রীয় কর্মসূচি,বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি এবং কর্মসূচির ফাঁকে খোলামেলা আড্ডা; একসঙ্গে থাকার সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখা, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করা এবং ভাবনা-চিন্তার আদান প্রদানের বিস্তর সুযোগ হয়েছিল। আমরা সবাই জানি,ভারতের গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের মতো একটি অগ্রণী সংগঠন পরিচালিত হয় যৌথ নেতৃত্বে। খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের ভিত্তিতে তার যথাযথ রূপায়ণে পরিচালকের ভূমিকাটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য যুব সংগঠনের মুখ্য সংগঠক হিসেবে সে ভূমিকা পালন করেছেন অসামান্য মুন্সিয়ানায়।তখন সময়টা বেশ কঠিন। গোটা দুনিয়ায় বেশ বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। আক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ। গোটা বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে। যুব আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্ন। নয়া উদার অর্থনীতির অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে। আমাদের দেশেও চালু হয়েছে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি। দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান। আমাদের রাজ্যেও বিভেদপন্থী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি মাথা তুলেছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি। তথ্যপ্রযুক্তির জগতে বিপ্লব। উত্তর আধুনিকতার দর্শন। পরিচিতি সত্তার রাজনীতি। ভাঙছে বিশ্বাস। ভাঙছে মূল্যবোধ। কিন্তু গড়ছে না। টালমাটাল অবস্থা। এই সময় নতুন পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যগুলি যথাযথভাবে অনুধাবন করা এবং যুব আন্দোলনকে সঠিক দিশা দেখানো সংগঠনের সামনে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।মতাদর্শ,রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা, আলোচনা,বিশ্লেষণ। নতুন তথ্য ও নতুন যুক্তির সন্ধান। কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে, কোথায় কোন বই বেরোলো এসব নিয়ে জরুরি চর্চায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকতেন মানবদাই। কলকাতা বইমেলাতে যুবশক্তি-র স্টলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বই বিক্রি করতেন। কাকে কোন বইটা কিনতে হবে পরামর্শ দিতেন। এমনি একদিন আমাকে নিহাররঞ্জন রায়ের লেখা ‘বাঙ্গালির ইতিহাস আদি পর্ব’ বইটি কিনিয়েছিলেন। ভাল বই পেলে সংগ্রহ করতেন। নতুন বইয়ের সন্ধান, বই কেনা,বই পড়া,বই নিয়ে আলোচনা করা মানবদার পছন্দের কাজ ছিল। শুধু বাইরের লোকের সঙ্গে নয়, নিজেদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হতো বিস্তার। সব সময় যে মানবদার সঙ্গে সব ব্যাপারে একমত হতে পেরেছিলাম তা নয়। কোন কোন বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছি নিঃসংকোচে। মজার ব্যাপার হলো এই তর্কবিতর্ক ও ভিন্নতা সত্ত্বেও মানবদার সঙ্গে মেলামেশায়, আন্তরিকতায় কোন মালিন্য কখনও তৈরি হয়নি।সেসময়  দার্জিলিং ছিল সন্ত্রস্ত। পশ্চিমবঙ্গকে অখন্ড রাখার পক্ষে থাকায় বামপন্থীরা রক্তাক্ত। নীরজ রাই, নীরন প্রধান সহ বহু বামপন্থী নেতা ও কর্মীকে শহীদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। বামপন্থীদের পক্ষে দার্জিলিংয়ে সভা,সমাবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

এমনই এক পরিস্থিতিতে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ডাকে ১৯৯৩ সালের ৪এপ্রিল দার্জিলিংয়ের চক বাজারে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ হয়। ৪থেকে৬এপ্রিল তিন দিন ধরে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য  কাউন্সিল অধিবেশন হয় দার্জিলিংয়েই। এই সমাবেশ ও অধিবেশন থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষিত হয়। এখানেও মুখ্য সংগঠকের ভূমিকায় মানবদা।১৯৯৫ সালের ১৪-১৮ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের পঞ্চম সর্বভারতীয় সম্মেলন। ১৮ নভেম্বর ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঐতিহাসিক সমাবেশ। ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ আমাদেরই’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে সম্মেলনকে সফল করার জন্য রাজ্যজুড়ে বিস্তর কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি কর্মসূচি যুবদের বিপুল অংশগ্রহণে অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। এই সম্মেলন উপলক্ষে গঠিত অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন মানবদা।আমরা জানি, গণতন্ত্র সম্প্রসারণে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, কৃষি, শিল্প,শিক্ষা, স্বাস্থ্য,সংস্কৃতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সত্ত্বেও  পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষে বেকারি, দারিদ্র, বৈষম্যসহ যুব জীবনের মৌলিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ছিল না। একদিকে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করা, অন্যদিকে শোষণ মূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে যুবসমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করা বড় কঠিন কাজ হিসেবে সংগঠনের সামনে হাজির হয়। এই পরিস্থিতিতে  দু’টি ভ্রান্ত প্রবণতার জন্ম হয়। একটি প্রবনতা বামফ্রন্ট সরকার টিকে থাকল কি থাকল না তা দেখার দরকার নেই, জ্বলন্ত সমস্যাগুলি নিয়ে রাজ্যজুড়ে জঙ্গি আন্দোলন করে যেতে হবে। অন্যদিকে বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করাটাই একমাত্র কাজ, আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই। এই দুই ভ্রান্ত প্রবনতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি করে তোলার জন্য সংগঠনের অভ্যন্তরে বিস্তর আলাপ আলোচনার বন্দোবস্ত করা হয়।

ঠিক হয় বামফ্রন্ট সরকারকে রক্ষা করার প্রশ্নটি যেমন উপেক্ষা করা চলবে না, তেমনি জ্বলন্ত ইস্যুগুলি নিয়ে আন্দোলনকেও শিথিল করা যাবে না। তার জন্য যুব সমাজকে সচেতন করার অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা ও উপর থেকে নীচ পর্যন্ত গোটা সংগঠনকে স্ট্রিমলাইন করার কাজে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন মানবদা।গোটা দেশ জুড়ে চালু হয়েছে নয়া উদার অর্থনীতি। এই অর্থনীতির আওতায় পশ্চিমবঙ্গ। এখানে রাজ্য সরকার পরিচালনা করছে বামফ্রন্ট। নয়া  উদার অর্থনীতির কুফল রাজ্যের মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলছে। কাঠামোগত পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও নতুন পরিস্থিতিতে কীভাবে বিকল্প ভাবনা ও নীতি তুলে ধরা যায়, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কীভাবে কতটুকু তা কার্যকর করা যায়, সমাজের মৌলিক পরিবর্তনের জন্য কীভাবে যুব সমাজকে সচেতন করা যায় এটা ছিল যুব আন্দোলনের সামনে চর্চার অন্যতম বিষয়। মানবদা ছিলেন একদিকে বামফ্রন্টের বিধায়ক, বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী, সরকার পরিচালনায় প্রত্যক্ষ অংশীদার, আবার অন্যদিকে রাজ্যের যুব আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক। কোন সন্দেহ নেই,সমস্ত আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের নির্যাসকে সংহত করে দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে যুব আন্দোলন পরিচালনা করতে পেরেছেন। এটা বলাই বাহুল্য যে, মানবদা পাঁচবারের বামফ্রন্টের বিধায়ক এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে। এই সময় যুব সংগঠনের পক্ষ থেকে নানা নতুন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে তার সবটা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এ কথা সকলেই জানেন, যুবদের সংবেদনশীলতা, গ্রহণ ক্ষমতা, নতুনের প্রতি আকর্ষণবোধ, সততা, সাহস ও ত্যাগের মানসিকতা অন্য বয়সের মানুষের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি। আর এই যুবদের আকর্ষণ করবার মতো অনেকগুলি গুণের অধিকারী ছিলেন মানবদা। মানবদা ভাল লিখতে পারতেন। নানা বিষয়ে লিখেছেন। আর লেখা নিবন্ধ, বই খুবই সমাদৃত হয়েছে। খুব ভাল বলতে পারতেন। সভা সমাবেশে যেমন, তেমনি আড্ডাতেও। যে কোনও আড্ডাতে মধ্যমণি হয়ে উঠতে পারতেন অনায়াসে। বলাতে যেমন, লেখাতেও তেমন একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল যা যুবদের খুবই আকর্ষণ করত। তাঁর বলায়, লেখায়, ভাবনায় খুঁজে পাওয়া যেত উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার উপাদান। মানবদার রসবোধ ছিল গভীর এবং তীক্ষ্ণ। ব্যবহার অত্যন্ত মধুর। যুব আন্দোলন থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরও  যুবদের মধ্যে সংযোগ ছিল নিবিড়। বহু সংগ্রামে, কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। ছাত্র ও আন্দোলন যুব আন্দোলন থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পর গণআন্দোলনেরও নির্ভরযোগ্য নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতি বড় শূন্যতা তৈরি করে গেল। তবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম-সংগঠনে যে মানুষটিকে দেখেছি এবং তিনি যে ছাপ রেখে গেছেন তা কখনও মলিন হবার নয়।