“দাদা এই নিয়ে তো দুটো হয়ে গেলো আধঘন্টার মধ‍্যে!” মন্তব্য শুনে তাঁর ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটোতে দুষ্টু হাসির ঝিলিক খেলেছিল,”নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে কথা বলতে নেই! ” তিনি মানবদা। সবে পালাবদল ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। “বদলা নয় বদল চাই”- প্রতিশ্রুতি ভুলে মমতা ব‍্যানার্জীর সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আঘাত হানছে বামপন্থীদের ওপরে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘরছাড়া সিপিআইএম কর্মীরা যাতে বাড়িতে ফিরতে না পারে তা নিশ্চিত করার জন‍্য সদ‍্য ক্ষমতায় আসা তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা কর্মীরা হুমকি দিচ্ছে পরিবারের লোকজনকে। পার্টির ডাকে প্রতিবাদের একটি কর্মসূচিতে জমায়েত ধর্মতলার লেনিন মূর্তির সামনে। আমরা কয়েকজন একটু আগেই পৌঁছেছি মানবদা বেশ জমিয়ে বসেছেন চায়ের দোকানের বেঞ্চে। বিমান বসু না পৌঁছালে মিছিল শুরু হবে না। চা খাওয়ার আগে আর পরে একটা করে সিগারেট ধরানোর সময় প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর পাওয়ার সময় বুঝেছিলাম নীচুতলার কমরেডদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ‍্য কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর তখনকার সদস্য মানব মুখার্জী রসবোধ হারাতেন না। রসবোধ মানে শিক্ষিত বাঙালির মার্জিত রুচিসম্মত রসিকতা করার রিফ্লেক্স যা আজকাল সোশ‍্যাল মিডিয়ার কল‍্যাণে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এহেন কমরেড মানব মুখার্জী মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে অর্ধ অচেতন, প্রায় শারীরিক অক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন মেনে নিতে মন চাইতো না। আমাদের আশঙ্কা সত‍্যি করে চিকিৎসকরা যা ভয় পাচ্ছিলেন তা ই হল। ২৯শে নভেম্বর বেলা এগারোটার কিছু পরে পর পর দুটো স্ট্রোক হাসপাতালে নেওয়ার পথেই সব শেষ। মাত্র সাতষট্টি বছর বয়সে থমকে গেলেন কমরেড মানবদা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাম ছাত্র যুব আন্দোলনের অন‍্যতম প্রধান মুখ। আমরা মিছিলে রবীনদা, গৌতমদা নেপালদা, ছাড়া মানবদা, নীলুদা, সুজনদা দের দেখে, উদ্দীপ্ত হতাম। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মানবদাকে হারানো মেনে নিতে মন চাইছে না।

ভাঙড়ের কৃষক পরিবারের সন্তানের হত‍্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আমাদের সঙ্গে কান্তি গাঙ্গুলি,সুজন চক্রবর্তী, অনাদি সাহু, গার্গী চ‍্যাটার্জী, দীপু দাস মধুজা সেন রায়, দেবজ‍্যোতি দাসদের মত লালবাজার সেন্ট্রাল লক আপে রাত কাটিয়েছিলেন মানব মুখার্জীও। সেই সময় পার্টির যে নেতানেত্রীরা আমাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় রাজনৈতিক আলোচনায় সময় কাটিয়েছিলেন ঘড়ির কাঁটা ভুলিয়ে দিয়ে, মানবদা তাঁদের একজন। সেদিন প্রায় একটার সময় আমাদের লক আপ থেকে বার করে আলিপুরের পুলিশ কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়,তার আগে পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া ছাত্র যুব কমরেডদের যেভাবে সুজনদা,মানবদারা উদ্দীপিত করছিলেন তা অবশ্যই উদাহরণযোগ‍্য। এই মানব মুখার্জীই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা দপ্তরে ঘন্টা দেড়েক ধরে কোন কাগজের টুকরো না দেখেই কমিউনিস্ট ম‍্যানিফেস্টো নিয়ে দুর্দান্ত আলোচনা করার সময় বিশাল হল উপচে পড়া ভিড় এক ইঞ্চি নড়ে নি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপুটে ছাত্রনেতা কিন্তু কথা বলতেন গলা না তুলেই কিন্তু আশ্চর্য দৃঢ়তার সঙ্গে। বিতর্কে প্রতিপক্ষকে যুক্তিতে পর্যূদস্ত করার সময়ও একটা মুচকি হাসি লেগেই থাকত। বক্তৃতা দিতেন যখন, তখনও খুব উঁচুতে উঠত না।পরিবর্তনের পরে গণ আন্দোলনের ময়দানে যখন নিয়মিত দেখতাম তথন বক্তৃতায় লেখায় সমান দক্ষ মানবদাকে পুলিশের হুমকিকে চোখে চোখ রেখে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে দেখেছি। বছর তিরিশ আগে প্রথম দেখা মানবদার দাড়িতে তিন দশকের ব‍্যবধানে তখন বেশ ভালোই পাক ধরেছে। তবুও ব‍্যক্তিত্ব একইরকম আকর্ষণীয়। অনেকে মানবদার আচার ব‍্যবহারে ঔদ্ধত‍্য দম্ভ খুঁজে পেলেও ভালো কেরিয়ারের প্রলোভন সরিয়ে সিপিআইএমের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে আসা মানুষটির প্রথম কথা উচ্চারণেই বোঝা যেত তাঁর মেধা ও মনন। হয়ত একটু বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন নিয়মিত রাজনৈতিক পড়াশুনা ও অর্থনীতি ইতিহাস চর্চার মধ‍্যে থাকা কমরেডদের সঙ্গে আড্ডায়,কিন্তু ভুলব কেমন করে ২০১১সালে যাদবপুর এইট বি স্ট‍্যাণ্ডের মিটিংয়ে এক কলেজপড়ুয়া ছাত্র কমরেডের ওপর টিএমসিপির ভয়ংকর আক্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে মানবদার গলা আবেগে কেঁপে যাচ্ছে!

টেলিভিশন চ‍্যানেলে বিতর্কে অংশগ্রহণ করতেন মানবদা। তাঁর বাচনভঙ্গি, যুক্তিবিন‍্যাস আজও বামপন্থী মুখপাত্রদের কাছে উদাহরণস্বরূপ। শেষ বোধহয় বছর দুয়েক আগে কোন একটি বড়ো চ‍্যানেলের বিতর্কসভায় এসেছিলেন। সেখানেও গলা এতটুকু হাঁকডাক না করে ব‍্যক্তিগত আক্রমণ নিখুঁত ডজ করে যেভাবে নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ওপরচালাক সাংবাদিক সঞ্চালক কিঞ্চিৎ বেকায়দায় পড়েছিলেন নিশ্চয়ই নয়ত সেই বিতর্কসভার পর আর কখনো কমরেড মানব মুখার্জীকে ডাকা হয়নি কেন!

আজ এক টেলিভিশন চ‍্যানেলের পদস্থ সাংবাদিক স্মৃতিচারণ করছিলেন ছোকরা বয়সে অ‍্যাসাইনমেন্টে গিয়ে বামফ্রন্ট সরকারের যুবকল‍্যাণ মন্ত্রী মানব মুখার্জীর ভাষণ শুনতে শুনতে হাততালি দিয়ে ফেলে সরকারি কর্মসূচির সভাস্থলে উপস্থিত তাঁর পত্রিকা সম্পাদকের কাছে বেজায় ধমক খেয়েছিলেন। আজ সেই মাঝবয়সী সাংবাদিকের স্বীকারোক্তি ” ওরকম বক্তৃতা শুনে আবেগ সামলানো যায় না দাদা।”
আর আমার মনে পড়ছে লালবাজার সেন্ট্রাল লক আপে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার লাইনে আমার পরে মানবদা,”রেশনিং চালু থাক চয়ন। ষাট অবধি দিয়ে তারপর আমায় চার্জ দিতে দিও। “
এই সব ঘটনাকে স্মৃতির পর্যায়ে ফেলে রেখে আপনি এত তাড়াতাড়ি কোথায় চলে গেলেন মানবদা?

কমরেড মানব মুখার্জী লাল সেলাম! কমরেড মানব মুখার্জী অমর রহে।