এক

কত ঘটনা যে ঘটছে প্রতিদিন, তার বিবরণ মনে রাখাই মুশকিল।

কত কয়েক মাসের বিষয়গুলিই ধরুন না! শিক্ষক নিয়োগে বেলাগাম বেপরোয়া দুর্নীতি করে শিক্ষামন্ত্রী তার প্রমিকা সহ গোটা দপ্তরের জেল বাস, কুন্তল ও তার মতন কয়েকজন আড়কাঠির জেলবাস, কুন্তলের প্রেমিকার নামও বাতাসে জোর ভাসছে।  বালি, কয়লা চুরি  আর গরু পাচার করে বীরভূমের বেতাজ বাদশা অনুব্রত’র জেলবাস।

যাঁদের চাকুরি চুরি হয়ে গিয়েছে ৭০০ দিন অতিক্রান্ত হলেও তাদের অবস্থান চলছে, তাঁদের ওপর রাতের আঁধারে পুলিশি তাণ্ডব, ডি এ’র দাবিতে সরকারী কর্মী, শিক্ষক, পেনসনার্সদের অবস্থান, তাঁদের ওপর পুলিশি তাণ্ডব।  আশা কর্মীদের ন্যূনতম বেতনের দাবিতে বিক্ষোভে পুলিশি তাণ্ডব – আরও কত কত দুষ্কাণ্ড! গরিবের ঘর নিয়ে এমন দুর্নীতি করেছে যে, বিভিন্ন জায়গায় তৃণ নেতাদের মার পর্যন্ত খেতে হচ্ছে।

মাস কয়েক আগে তো দেখেছেন মানুষ, এখনও প্রতিদিন এতো বিপুল টাকা উদ্ধার হচ্ছে যে, তা দেখে সবার চক্ষু চরকগাছ ! তৃণমূল বাংলায় এই নতুন ব্রাণ্ডের দুর্নীতির আমদানিকারক।

আনিস হত্যা, বগটুই গণহত্যা, হাঁসখালিতে কুমারী ধর্ষণ ও হত্যা – এরকম কত কত অপকাণ্ড!

আদানি মোদীর মানসপুত্র, দিদির মানস ভ্রাতা। ব্যাঙ্ক আর এল আই সি’কে বেবাক লুট করে নিল। দিল্লিতে মোদী গলা ফাটাচ্ছে, কিন্তু আদানি ব্যাপারে স্পিকটি নট। দিদিও তার মানস ভ্রাতার নাম নিচ্ছেন না। সব বিরোধী দল যখন পার্লামেণ্টের উভয় কক্ষ কাঁপিয়ে দিচ্ছেন প্রতিবাদে, তখন দিদির  তৃণমূল তাদের সঙ্গে ফারাক রেখেছেন। কেনো তা সবাই জেনে গিয়েছে। ওর পাহাড়াদারদের আশকারায় আদানি সুপ্রীম কোর্টে কেস করেছে, তার দুর্নীতি নিয়ে আলোচনায় নাকি দেশের অসম্মান হচ্ছে! বোঝ কাণ্ড!

প্রথম থেকেই বিজেপি-দিদি একাকার, দিদি–মোদী ভাই ভাই।  তৃণমূল পার্টি হিসাবে সৃষ্টি হবার আগে থেকেই। সেই বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় থেকেই। গুজরাটে সংখ্যালঘুদের গণহারে হত্যাও দিদির মনে কোনো বিকার সৃষ্টি করে নি। বার বার বিজেপি মন্ত্রীসভায় অধিষ্ঠিতা হতেও নয়। কয়েক বছর ধরে তো নিজেকে আর ভাইপো-তার পত্নি-শ্যালিকাকে বাঁচানোর জন্য বারে বারে মোদীর সঙ্গে একান্ত আলোচনা চলছে আর চলছে। তাই সি বি আই – ইডিকে,  বিরক্ত হাইকোর্ট আরও তৎপর হয়ে কাজ করতে শুধু নির্দেশই দেয় নি, তাদের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে, তদন্তকারী অফিসারদের সম্পত্তির হলফনামা পর্যন্ত জমা দিতে বলেছে।

আদানি ইত্যাদি লম্পট পুঁজিপতিগুলো যেমন মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বসিয়েছে, তেমনই দার্জিলিংয়ের ডেলোর মিটিং অন্তে দিদিকে চিটফাণ্ডের মালিকরা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বসিয়েছে।

মোদীরা যেমন ওদের কথায় চলে, টাকার বিনিময়ে সব বরাত আদানি অয়ন্ড কোম্পানিকে দেয়, দিদিও দেওচা –পাঁচামী আর তাজপুর সমুদ্রবন্দর নির্মানের দায়িত্ব দিয়েছে ঐ আদানিকেই। দুই শাসকই কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে। দিদি আগে যেমন বেলাগাম মানুষ ঠাকানোর সর্তে চিট ফাণ্ডওয়ালাদের কাছ থেকে কোটি কোটি কোটি টাকা নিতেন, তেমনই পরে নিচ্ছেন আদানির কাছ থেকে। আমাদের নেতা সেলিম তো দেওচা-পাঁচামী নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কই, এই চ্যালেঞ্জ নেবার হিম্মত তো দেখাতে পারছেন না মমতা!

এর মধ্যেই আবার মোদীজীরা মানুষ মারা বাজেট করে ফেললেন।

মোদী তার সঙ্গে চালাচ্ছেন, স্বৈরাচারী কূপমণ্ডুক হিন্দুত্ব। বাংলায় চলছে দিদির মদতে প্রতিযোগীতামূলক সাম্প্রদায়িকতা।  দিদিভাই – মোদীভাই এক হ্যায় – এই কথাটা বুঝতে ইদানিং মানুষের আর বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। এই দুটো দল যে পাপের রাজত্ব কায়েম করেছে, তা বুঝতেও খুব সমস্যা হচ্ছে না মানুষের।

জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, ক্ষুধাতুর – গৃহহীন- জলের কষ্টে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গরিবদের নাম বিপিএল তালিকা থেকে কেটে দেওয়ায়, তাঁদের কেউ কেউ যে বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ পেতো, তার লাইন কাটা পরেছে। এখন তাঁদের মোমবাতি ভরসা। বেড়েই চলেছে  বেকার সংখ্যা।  

চাষিরা ধান –আলুর- সরষে-গমের দাম পায় না। এবারও, গম সরষে বোনার সময় কালো বাজারে অনেক বেশি দামে সার আর বীজ কিনতে হলো। সেচ দেবার জন্য মেসিন চালাতে গিয়ে অনেক বেশি দামে ডিজেল-মবিল কিনতে হচ্ছে। নারীদের কোনো কাজের সংস্থান নেই। বাম আমলের স্বসহায়ক গ্রুপ গুলো উঠে গিয়েছে। পঞ্চায়েতে বসে আছে চোর জোচ্চররা। কোথায় উড়ে গিয়েছে গ্রাম সংসদ, কোথায় সহভাগী পরিকল্পনা! শুধু কাটমানির শলা-পরামর্শে মশগুল হয়ে থাকছে পঞ্চায়েত অফিসগুলো।

যা আলোচনা এতোক্ষণ করা হলো, তা ঘটমান বর্তমানের কিঞ্চিত কণা মাত্র। মানুষ তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতায় এর থেকে ঢের বেশি জানেন।

এবং তাই মিটিং, মিছিলে মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে অনেক বেশি পরিমানে।

দুই

এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল, আমাদের মধ্যে। কালিয়াগঞ্জের বর্ষীয়ান কৃষক নেতাই কথা উঠালেন। বললেন –  বামেদের কর্মসূচী যা হচ্ছে তা আনুষ্ঠানিক, মানুষের মন ও মগজ কতটা ছুঁতে পারছে, তার মূল্যায়ণ করা দরকার।

আমরা বললাম – না,দাদা, ইদানিং কিন্তু আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এসে জনসভাগুলো মানুষের মনকে ছুঁতে পারছে। গঞ্জের পথ সভা, বিক্ষোভ মিছিলের দ্বারাও তাই ই হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তো কোটি কোটি, তাঁদের সবার মধ্যে জাগরণ তৈরি করার জন্য, আরও অনেক অনেক অনেকগুণ বেশি নিবিড় প্রচার চাই। 

দিলীপ দা বললেন, আগের মতো পাড়া  বৈঠক, পাড়াকে আরও ছোট করে নিয়ে বৈঠক করতে হবে হাজার হাজার।

আমরা বলি, একথা ঠিক বলেছেন।

দিলীপ দা বলেন – আর ঐ বৈঠক বুড়ি ছোঁয়া করে করলে হবে না। একটু সময় নিয়ে বসে, পাড়ার লোকদের সঙ্গে গল্পগাছা করে, তারপর বিষয়গুলো সাদা কথায় জানাতে হবে।  একটা পাড়ায় গেলেন। প্রথম দিন বৈঠকটা জমলো না। পরে আবার যেতে হবে। রাতে থাকতে পারলে সব থেকে ভালো। মোটকথা, পাড়ার মানুষের সঙ্গে লেপটে থাকতে হবে।

তখন দিনেশ বলল। বুঝেছি তোমার কথা। তাহলে আমার একটা গল্প শোন – গাঁয়ের কুটুম।

সে এক দিন-সময় ছিল, যখন জমিতে হত মূলত একটা ফসল। যাকে বলত আমন বা হেমত ধান। কত তার নাম !   তখন গরিবদের লেগে থাকত নিত্য অভাব। ঐ আমন ধান উঠবার সময়, একটু যা খেতে পেত। অগ্রাণ পৌষ মাসে নয়ানজুলি, খাল, ডোবায় ছেলে –ছেলে- মেয়ে-বৌ-বেটি- সবাই মিলে ছোটো ছোটো মাছগুলো পোলই,  চালুন, জাকোই, খৈচালা, কড়াই করা থালা নিয়ে ধরতে যেতো। যে যেমন পারে ! কাদা মেখে একসা হয়ে মাছ নিয়ে কিম্ভূত কিমাকার হয়ে সবাই বাড়িতে ফিরত বেলা গড়িয়ে গেলে।

এক গাঁয়ে এক জোড়া নতুন স্বামী স্ত্রী। পান্তা ভাত আর মাছের ভর্তা খেয়ে নাহিড়ি বেলায় দুজনে দুটো পান খেল। তারপর খলই, পোলই নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দশোয়ালি মাছ মারার ধুম চলছে সেখানে যাবার জন্য।

ও মা!  বর আর বৌটা দেখছে, ওদেরই বাড়ির দিকেই যেন তিন/চার জন মানুষ আসছে। একটু কাছে এলে নিশ্চিত হল, তাই বটে।

স্বামীটার দশ-বার মাইল দূরের   কাকা, কাকাতো ভাই আর তার বোনের বর, আর ওর সম্বন্ধি।

কী আর করা যাবে! অনেক দিন পরে এসেছে। মাছ মারা মাথায় উঠল। সবাই মিলে বাড়িতে এল। 

নিকানো বারান্দায় একটা ধোকড়া পেতে দেবারও সময় দিল না বৌটাকে। হেঁটে আসায় সবাই ক্লান্ত। কাকার ব্যাটা আড়া থেকে একটা ধোকড়া টেনে নামিয়ে বারান্দার কোণা থেকে বারুণটা নিয়ে নিজেই ঝাঁট দিয়ে বসার জায়গা করে,  হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। সকলেই বসলো ধোকড়ায়।

বৌটাও কিছু খাবার জোগাড় করতে লেগে গেল। কাজ করতে করতে বলল- ও হে দেওরা, বাড়ি থাকি সবাই খেয়ে এসেছো তো!

 –কিছু খেয়ে তো আসতেই হবে। কিন্তু এত হাঁটার পরে সেগুলো কি পেটে আছে আর!  তা এই কথা আবার কেউ জিজ্ঞাসা করে! দাও কিছু খেতে দাও।

নতুন ঢেঁকিতে কোটা চিড়া একটু লবন আর সরষের তেল দিয়ে  মেখে, তার উপর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বৌটা খুঁচিতে করে সবার সামনে সামনে রেখে গেল। ঘটিতে করে দিয়ে গেল জল। চার কুটুমের মধ্যে তিনজনই বৌটার ঠাট্টার সম্পর্কের। ওদের সামনে খুঁচিগুলো রাখবার সময় বলল – নাও হে জব্দ করে খাও। নন্দাইটা চিড়া চিবাতে চিবাতে বলল –খুব শক্ত চিঁড়া দিয়েছেন বৌদি। যাক, আমাদের দাঁত আছে। কোন অসুবিধা হবে না।

বৌটা মনে করল, কুটুমরা হয়ত হাটে যাবে। যাবার পথে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার রওয়ানা দেবে।  এরা গেলেই না হয় মাছ ধরতে যাওয়া যাবে।

না কুটুমদের মধ্যে সেই রকম লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। ওদিকে বেলাও বাড়ছে।

নন্দাই বলে উঠল – কী বৌদি দুপুরের খাবার দিবেন না?

বৌটা আর কী করে। খড়ি –পাতাড়ি দিয়ে উনান ধরিয়ে অনিচ্ছা সত্বেও রান্নার জোগাড় করতে শুরু করল।  সময় নিচ্ছে। যাতে ওরা বিরক্ত হয়ে চলে যায়। সেজন্য নানা ফন্দি ফিকিরও করছে।

বউটা বলছে – শুনে থাক ভাইয়েরা – আইজ হামার নাই উষা শুখা/ আজ খালে আলো। – মানে আজকে সেদ্ধ চালের ভাত হবে না। খেতে হবে আতব চালের ভাত।

ওদিক থেকে দেওর উত্তর দিল – মাঝে মাঝে ঐ মতনে ভালো। – মানে মাঝে মাঝে এরমই ভালো।

বৌটা এবার বলছে – আইজ  হামার নাই তোরকারি/আজ খালে সানা। – মানে, আজকে কোন তরকারি নাই, আজকে খেতে হবে ভাতের সঙ্গে কেবল কিছু সেদ্ধ।

এবার ননদাই উত্তর দিল – তাহে বা ছাড়ে কোন কানা! – মানে, তাই বা   ছাড়ে কে!

বৌটা দেখল এরা মহা লেপটানিয়া কুটুম। এবার বলল – শুনি থাকেন ভাই। আজ হবি হামার আন্দন বাড়ন /কাল সি না হামার খাওয়া! – মানে, আজ হবে রান্না বান্না – কালকে কিন্তু হবে খাওয়া দাওয়া।

দেওর জবাব দিল – দূর বাপু, আইজ কাইল তো হামার যাবি দেখিতে শুনিতে/ উদিন না হামার যাওয়া। – মানে – আরে আজ  আর আগামী কাল তো আমাদের এই গ্রামটা দেখতেই লেগে যাবে। পরসু দিন তো আমরা যাব!

বৌটা আর ওর স্বামীটা দেখল – এই কুটুমরা ছাড়ানিয়া কুটুম নয়। ওরা দুপুরের খাবার খাবেই, থাকবেই।

তখন বৌটা হেসে ফেলল। স্বামীও।  সেই হাসি সবার মধ্যে সঞ্চারিত হল।

বৌটা এবার সত্যিকারের রান্না শুরু করল।

এই গল্পটা করে দিনেশ বলল – গ্রামীণ মানুষের বাড়িতে যখন তুমি যাবে রাজনীতির কথাবার্তা বলতে, তখন তোমাকে এই গাঁয়ের কুটুমের মত নিজেই বসার জায়গা-টায়গা করে নিয়ে, প্রয়োজনে  নাছোড়বান্দা হয়ে, তাঁদের আত্মীয় হয়ে উঠতে হবে। তবে তো তুমি স্থান পাবে আর তাদের মন পাবে।

সঙ্গে এই যে সামনে পঞ্চেয়েত ইলেকশনে  গুণ্ডামী হবে – তা ঠেকানোর ডাণ্ডাও পাবে, পাবে নতুন নতুন কর্মীও।

সিন্ধান্ত –  হ্যাঁ হ্যাঁ এভাবেই আমারা কাজ  করবো।