১১ ই অক্টোবর ই ডি র গ্রেফতার হলেন হাইকোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্য এবং তারপরেই আবার জানা গেল বিপুল টাকার বিনিময়ে অসংখ্য শিক্ষক পদ বিক্রির খবর ছিল মুখ‍্যমন্ত্রীর কাছে। শিক্ষক পদে চাকরির বিনিময়ে কোন নেতা কতটাকা নিচ্ছেন মুখ‍্যমন্ত্রী সবই নাকি জানতেন বলে ই ডি র হাতে আসা একটি চিঠিতে লেখা রয়েছে। গত ২২শে জুলাই অর্থাৎ যেদিন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ‍্যাটার্জী গ্রেফতার হয়েছিলেন সেদিনই মানিক ভট্টাচার্যের বাড়ি থেকে ঐ চিঠি উদ্ধার করে ই ডি। যে চিঠির একটি কপি মুখ‍্যমন্ত্রীর বাড়িতে পাঠানো হয়। সেই চিঠি আসলে একটি অভিযোগপত্র। যাতে লেখা হয়েছে ৪৪জন অযোগ্য প্রার্থীর কাছ থেকে ৭ লক্ষ টাকা করে মোট ৩ কোটি ৮ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছে শিক্ষক পদে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন‍্য।

বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না, কেন মানিক ভট্টাচার্যই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির একমাত্র অভিযুক্ত যাঁর জন‍্য লুক আউট নোটিশ জারি করতে হয়েছিল তদন্তকারী সংস্থাকে কারণ নানা অজুহাতে তিনি সিবিআই ও ইডির জেরা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। যদিও কোনও অজানা কারণে লুক আউট নোটিশ জারি করার পরেও টিভি চ‍্যানেলে বিধানসভায় এবং দিল্লির বঙ্গভবনে মানিক ভট্টাচার্যকে দেখা গেছে। কল‍্যাণময় গাঙ্গুলির গ্রেফতারির পর যখন তাঁর গ্রেফতারি প্রায় নিশ্চিত তখন মানিক ভট্টাচার্য বিপুল অর্থব‍্যয় করে বিখ্যাত আইনজীবী মুকুল রোহতগীকে নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্ট থেকে সিবিআই তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করার শর্তে ১০ই অক্টোবর পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করতে পারবে না কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এই মর্মে রক্ষাকবচ নেন। কিন্তু শেষরক্ষা হল না প্রধানত আর্থিক দুর্নীতির তদন্তের জন‍্য এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টোরেটের তৎপরতার কারণে। আদালতে ই ডি মানিক ভট্টাচার্যকে তোলার সময় যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে এনেছে, তার মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য, সরাসরি তিনি অবৈধ আর্থিক লেনদেনে যুক্ত ছিলেন,তাঁর ছেলে শৌভিক ভট্টাচার্যের সংস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ জমা হয়েছে এবং তিনি তদন্তে অসহযোগিতা করেছেন।

সিবিআই আপাতত না ছুঁলেও মানিক ভট্টাচার্যকে চৌদ্দদিন ইডির হেফাজতে থাকতে হবে কোর্টের নির্দেশে। নিয়োগ না পেয়ে টেট উত্তীর্ণ যে যোগ‍্য চাকরি প্রার্থীরা অবস্থানে বসে আছেন কলকাতার ধর্মতলায় তাঁরা অবশ‍্য এই গ্রেফতারে আর উচ্ছ্বসিত হতে পারছেন না। কারণ তাঁরা জেনে গেছেন, তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ২০১২,২০১৪ এবং ২০১৭ এই তিন বছরের টেট পরীক্ষাতেই ব‍্যপক দুর্নীতি হয়েছে। নিয়োগ করা হবে এই মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে ঠিকই কিন্তু কিভাবে নিয়োগ করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোন স্বচ্ছ নীতি ঘোষণা করা হচ্ছে না। নিযুক্ত অযোগ্য প্রার্থীদের সরিয়ে যোগ‍্য প্রার্থীদের নিয়োগ করা হবে সে কথাও বলা হচ্ছে না। সন্দেহ করা হচ্ছে অবৈধভাবে নিযুক্ত মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের চাকরি চলে গেলে তারা যদি আবার টাকা ফেরত চায় তাহলে শাসকদলের অনেক রাঘববোয়াল বিপদে পড়ে যাবেন। অন‍্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান গৌতম পাল নিয়োগপত্র না পাওয়া উত্তীর্ণ যোগ‍্য সমস্ত প্রার্থীকে আলাদা করে আবার ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হয়ে নিয়োগ নিশ্চিত করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা তা মানতে নারাজ। আদালতের নির্দেশে বাগ কমিটির মত কোন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হয়নি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন যোগ‍্য বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীর মামলার ফলে অনেক অবৈধ নিয়োগের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ফলে মানিক ভট্টাচার্য কোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পরেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ আদালতকে জানায় প্রায় তেরোলক্ষের কাছাকাছি পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

সুতরাং মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারের পরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রথমত ২০১১ থেকে ২০২২ পর্যন্ত শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য তথা মমতা ব‍্যানার্জীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জন‍্যই কি ইনি প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসাবে আসীন ছিলেন? আজ অবৈধ আর্থিক লেনদেনের যেসব অভিযোগ আসছে সেই অভিযোগ তো নেহাতই আচমকা উঠে আসা নয়। মানিক ভট্টাচার্য তৃণমূলের এতই বিশ্বস্ত সৈনিক যে ২০১১ তে বিধানসভা নির্বাচনে পলাশীপাড়ায় হেরে যাওয়ার পরেও তাঁকে ২০১৬ সালে একই কেন্দ্রে আবার প্রার্থী করে জিতিয়ে আনা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ভোটে দাঁড়িয়ে বিধানসভায় জিতে কার স্বার্থ রক্ষা করেছিলেন? দ্বিতীয়ত লুক আউট নোটিশ এড়িয়ে অনায়াসে কলকাতা দিল্লী যাতায়াত করতে পেরেছিলেন কাদের বরাভয়ে? সুপ্রিম কোর্টে মুকুল রোহতগীর মত দুঁদে আইনজীবীর ফি যোগালো কি সেই অভয়দাতারা? তৃতীয় ও শেষ প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গের পুরো সরকারি ব‍্যবস্থায় এক পা নড়ালেও যাঁর আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা প্রয়োজন তিনি কিছুই জানতেন না শিক্ষক নিয়োগের নামে লাখ লাখ টাকায় এই চাকরি বিক্রির খবর,এ কথা পার্থ চ‍্যাটার্জীর গ্রেফতারির পর থেকেই কট্টর তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদেরও অনেকেই বিশ্বাস করছেন না। প্রশ্ন এটাই মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারি কি সেই সরকারের সেই সর্বোচ্চ পদে আসীনদের কাছে কি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে পৌঁছে দিতে পারবে?