এদেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি জারি করতে মোদি ও তার দলবলের এত আগ্রহ কেন?

মণিপুর জ্বলছে।পদকপ্রাপ্ত মহিলা কুস্তিগিরদের পুলিশ রাস্তায় পেটাচ্ছে। মোদির মুখে কথাটি নেই। নারীর অধিকাররক্ষায় তার সেই এক নিদানঃ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। সেটাও কেবল ‘আমার মুসলিম কন্যাদের জন্য’। এই উন্মাদ একাগ্রতার উদ্দেশ্য কী?

বিজেপির রাজনৈতিক এজেণ্ডায় অবশ্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা অনেক দিন ধরেই আছে। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরেই মোদি ২০১৬ সালে এবিষয়ে ২১তম ল’ কমিশনের মতামত নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। কমিশন বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করে এবং ৭৫০০০এর বেশি নাগরিকের মতামত সংগ্রহ করে অবশেষে জানায় যে বর্তমানে এদেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি জরুরিও নয়, অভিপ্রেতও নয়। তারা মন্তব্য করে যে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পত্তির অধিকার এবং অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইনে বিশেষত মেয়েদের প্রতি যে অসমতার চলন রয়েছে তার কারণ সম্প্রদায়গুলির পারস্পরিক বিভিন্নতা নয়, তার কারণ তাদের মধ্যেকার লিঙ্গ-পক্ষপাতিত্ব। বিভিন্নতা মানেই অসাম্য নয়, অভিন্ন বিধি চালু হলেই তা দূর হবে না, চালচলন আচারআচরণের বৈচিত্র্য বরং একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই সূচক। এছাড়াও ঐ কমিশন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করেছিল প্রতিটি পারিবারিক আইনের মধ্যে কোথায় কোথায় মেয়েদের প্রতি অবিচার ঘটে এবং কীভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গ না তুলেও প্রতিটি আইনের মধ্যে তার সংশোধন ও প্রতিকার করা যেতে পারে।

এতৎসত্ত্বেও দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মোদি-সরকার ২২তম ল’ কমিশনকে পুনরায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে চাপ দিতে থাকে এবং সেই চাপের মুখে কমিশন সব কেঁচে গণ্ডুষ করে নতুন করে নাগরিকদের কাছ থেকে এবিষয়ে মতামত গ্রহণ করা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে মোদি ও অন্যান্য বিজেপি নেতারা ঢাক পিটিয়ে বলে যাচ্ছে যে অতিশীঘ্র এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সংসদে পাশ করানো হবে। এমনকী, জাতীয় মহিলা কমিশনকে দিয়ে এক আলোচনাসভা পর্যন্ত করানো হয়েছে, তার আলোচ্য বস্তু অবশ্য শুধুই শরিয়তি আইন। অভিন্ন বিধির আকারপ্রকার কী হবে তা এখনো কিছুই ঠিক হয়নি, কিন্তু এনিয়ে শাসকদলের এই লাগাতার প্রচার এটা স্পষ্ট করছে যে এর আসল উদ্দেশ্য লিঙ্গসাম্য নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সমাজব্যবস্থা; বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর এবং ষষ্ঠ তপশীলের অন্তর্ভুক্ত আদিবাসীদের ওপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার একটি হাতিয়ার হিসাবেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে এত কথা। দমনমূলক অগণতান্ত্রিক এই জমানার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহাওয়াকেই তা আরো জোরদার করবে।

সংবিধানে কী আছে আর মোদিরা সামাজিক বিভাজন ও দমনের উদ্দেশ্যে কী চাইছে

কিছু কিছু প্রগতিশীলদের মনেও এই ধন্দ জায়গা করে নিচ্ছে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা তো সংবিধানের ৪৪ নম্বর ধারায় দিক্‌নির্দেশমূলক নীতিসমূহের কথা বলতে গিয়েই এসেছে। তাহলে কি মোদি সংবিধানের নির্দেশই পালন করছে না? প্রকৃতপক্ষে এই ধন্দ তৈরি করাটাও উদ্দেশ্যমূলক। ৪৪ নম্বর ধারা বলছেঃ রাষ্ট্রের প্রচেষ্টা থাকবে সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার। কিন্তু সেখানে কোনো সময়সীমা রাখা হয়নি; এমনটাও বলা হয়নি যে অভিন্ন বিধি এলে পারিবারিক সবরকম আইন উঠে যাবে। তাহলে এই ধারাটির উদ্দেশ্য কী? বস্তুত বিজেপির চিন্তায় অভিন্ন আইন যেভাবে এসেছে মনে হয় সংবিধান-প্রণেতাদের সেবিষয়ে ভাবনা একেবারেই আলাদা ছিল।  

তাঁরা অবহিত ছিলেন যে দীর্ঘদিনের প্রথাভিত্তিক সব পারিবারিক আইনের মধ্যেই সমতা ও সুবিচারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থী নানাবিধ উপাদান রয়ে গেছে। তাও সেগুলিকে রাখা হয়েছিল ২৯(১) ধারাটিতে সাংস্কৃতিক বহুত্বের যে স্বীকৃতি রয়েছে তাকে মান্য করেই। কিন্তু একলপ্তে হঠাৎ করে না হলেও এগুলির সংশোধন করতে হবে এবং তার পাশাপাশি সমতার লক্ষ্যে ধর্মনির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নানা নতুন আইন আনতে হবে। এই প্রয়োজনের ইঙ্গিতই তাঁরা ৪৪ নম্বর ধারায় রেখে গেছেন; সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির পারিবারিক রীতিনীতিগুলিকে নির্বিশেষে তুলে দিতে হবে একথা বলা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না।

মোদি ও তাঁর দলবল প্রমাণ করতে চাইছেন যে এধরনের অসাম্য স্ত্রীপুরুষের মধ্যে শুধু মুসলিমদের পারিবারিক আইনেই আছে। তাঁরা একবারও বলছেন না যে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পারিবারিক আইনেও মেয়েদের সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন, এখনো অভিভাবকত্ব আইনে সন্তানের মায়ের অধিকার পিতার অধিকারের সমতুল্য নয়। এখনো বিবাহোত্তর অর্জিত সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার নেই। এই সম্পত্তির ব্যাপারে স্ত্রীর কোনো কথা খাটবে না, স্ত্রীর নিজস্ব আয় না থাকলে স্বামীপরিত্যক্ত অবস্থায় সে একান্ত অসহায়। এইসব পরম্পরায় চলিত প্রথা নিশ্চয়ই অসাংবিধানিক এবং তাদেরও সংশোধন দরকার।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তন না করে কি এইসব অসাম্যমূলক প্রথার সংশোধন হতে পারে?   

মোদিরা গোয়াতে প্রচলিত যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নজির কথায় কথায় তোলে তা পর্তুগিজ আমলের আইন এবং সেখানে অভিন্ন বিধি তৈরি হয়েছে বিভিন্ন পারিবারিক আইনের কিছু কিছু অংশ নিয়ে একটি জগাখিচুড়ি বানিয়ে। অভিন্নতা প্রতিষ্ঠা করলেই যে লিঙ্গসমতা আসে না, গোয়ার আইন বরং তারই একটি নিদর্শন হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে। অন্যদিকে বিগত সত্তর বছরে ভারতীয় আইনে লিঙ্গসমতা আনার জন্য যে নানাবিধ উদ্যোগ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্র ধরে উঠে এসেছে তার মধ্যেই রয়েছে সমতার দিকে পদক্ষেপের নিদর্শন। দ্বিবিধ পথ ধরে এইসব পরিবর্তন ঘটেছে।

প্রথমত সামগ্রিক জন-আন্দোলনের ও নারী-আন্দোলনের সূত্র ধরে এসেছে স্পেশ্যাল ম্যারেজ আইন, পণপ্রথা বিরোধী আইন, পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীসুরক্ষা আইন ইত্যাদি। এইসব আইন ধর্মনির্বিশেষে সব নারীর জন্য সমতা ও সুবিচারের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে, এবং যেকোনো সম্প্রদায়ের নারীকেই পারিবারিক আইনের অবিচার থেকে কিছুটা সুরক্ষা দেওয়াতেই  এদের প্রাসঙ্গিকতা।  দ্বিতীয়ত বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা গেছে যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রগতিশীল নারী ও পুরুষদের সক্রিয়তা কোনো কোনো পারিবারিক আইনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে পেরেছে, সম্প্রদায়ের নিজস্ব উদ্যোগেই কিছু সংশোধন হয়েছে। এর উদাহরণ রয়েছে হিন্দু পারিবারিক সম্পত্তি আইনের সংশোধনে, ক্রিশ্চানদের বিবাহবিচ্ছেদ আইনের কিছু পরিবর্তনে, এবং তাৎক্ষণিক তিন তালাকের অমানবিক প্রথা বাতিল হওয়ার বিষয়টিতে।

এই শেষ উদাহরণটির কৃতিত্ব নেবার চেষ্টায় আছে মোদি; কিন্তু সত্যটা এই যে সম্প্রদায়ের মধ্যেই কিছু প্রগতিশীল সংগঠন, কিছু নারীসংগঠন এটা বাতিল করার চেষ্টা বেশকিছুদিন ধরেই চালাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের আবেদনেই সুপ্রিম কোর্ট এই প্রথাটি রদ করে দেন। ২১তম ল’ কমিশনের সুপারিশ মেনে এই পদ্ধতিতে তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের ভরণপোষণের কার্যকরী ব্যবস্থা করার বদলে মোদি বরং তড়িঘড়ি এক ফৌজদারি আইন চালু করেছে স্ত্রীপরিত্যাগকারী মুসলিম পুরুষদের জেলে ভরার অজুহাত তৈরি করতে। যদিও দেশে স্ত্রীর ওপর অত্যাচার বা স্ত্রীপরিত্যাগের প্রতিকারে ধর্মনির্বিশেষ আইন রয়েছে। ঠিক শাহবানু মামলার সময়ে যেমন মুসলিম মেয়েদের বিশেষ সুবিধা দেবার নামে রাজীব গান্ধীর সরকার তাঁদের সাধারণ ভরণপোষণ আইনের আশ্রয় নেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল, তেমনই মোদি সরকার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের সুবিধা দেবার নাম করে মুসলিম সমাজকে সাধারণ আইনের চৌহদ্দির বাইরে রেখে পিছু হাঁটতে চাইছে।  

উপরে উল্লিখিত নানাবিধ আইনি সংশোধন ঘটেছে সম্প্রদায়ের মধ্যেকার আগুয়ান চেতনার সদর্থক উদ্যোগে। সরকার যেখানে তার সহযোগিতা করেছে সমতার দিকে এগোনো সম্ভব হয়েছে। আর সরকার যেখানে শাসকের স্বার্থে উল্টোদিকে হেঁটেছে সেখানে সমাজের ভিতরের পশ্চাৎপদ প্রবণতাগুলি জোরালো হয়েছে। মোদি অভিন্ন বিধির জন্য যে অসুস্থ অতিসক্রিয়তা দেখাচ্ছে তার ফলে সব সম্প্রদায়ের ভিতরের আগুয়ান অংশ বরং কোণঠাসাই হয়ে পড়বে, বিভাজন বাড়বে, সংখ্যালঘুর মুছে যাওয়ার আতংককে ব্যবহার করে সেই সমাজের কট্টরপন্থীরা শক্তিশালী হবে, যে প্রবণতা আমরা দেখেছি বিজেপি-শাসিত কর্ণাটকে ছাত্রীদের ‘হিজাব’ নিষিদ্ধ করার বিষয় নিয়ে।

সত্যিই যদি মোদির লিঙ্গসমতার নীতিতে বিশ্বাস থাকত তাহলে এই সরকার কী করতে পারত?

আজ অনেক বছর ধরে মেয়েরা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষেরা জোরদার আওয়াজ তুলছে বেশকিছু আইনি সংশোধনের বা নতুন আইন লাগু করার দাবি নিয়ে। গণতন্ত্র ও লিঙ্গসাম্য নিয়ে মোদির কোনো মাথাব্যথা থাকলে এগুলো নিয়ে সে তৎপর হতে পারত। কয়েকটি উদাহরণঃ মেয়েদের বিবাহোত্তর সম্পত্তিতে আইনি সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা হোক!  শক্তিশালী খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশে পারিবারিক সম্মানের নামে যেসব অপরাধ মেয়েদের ওপর সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে কড়া আইন হোক! ধর্ষণসংক্রান্ত আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে যে ছাড় দেওয়া হয়েছে তা রদ করা হোক! পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে সমলিঙ্গ বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হোক! এসব বিষয়ে মোদি নীরব কেন? নাগা জনগোষ্ঠীর মেয়েদের দীর্ঘদিনের দাবি স্থানীয় কাউন্সিলগুলিতে তাদের জন্য সংরক্ষণ করে তাদের নির্বাচিত হবার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তা নিয়ে মোদি রা কাড়ে না কেন?

আর দেশে নারীদের সুরক্ষায় যেসব সাধারণ আইন রয়েছে সেগুলি কার্যকরী করার জন্য কী উদ্যোগ নিচ্ছে মোদীর সরকার? শাসকদলের বাহুবলীদের রক্ষার্থে ছাড়া কি সেগুলি প্রযুক্ত হবে না? এমন আইনও দেশে আছে যেগুলির যথাযথ ব্যবহার হলে মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের ঘরেবাইরে ক্রমবর্ধমান বিপন্নতার অনেক সুরাহা হত। শাসককুলের দুশমনদের দাপট কমত। মেয়েদের জন্য সুবিচারের স্বার্থে যাকিছু করার ক্ষমতা সরকার রাখে, সেসবকে চাপা দিতেই কি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে আস্ফালন? কিন্তু এ আস্ফালন শুধু মেয়েদের বা সংখ্যালঘুদেরই বিপদ সৃষ্টি করছে একথা ভেবে বাকিরা যদি নীরব হয়ে থাকেন সেটা বিষম ভুল হবে। আমাদের যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুত্ব আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে এটা তারই ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ। এই চতুর রণকৌশলে সবচেয়ে বিপন্ন হবে দেশের সংহতি।     

Sources: Brinda Karat, ‘Uniformity versus Equal Rights’, People’s Democracy, 3-9July, 2023. All India Democratic Women’s Association Memorandum to Law Commission, People’s Democracy, 10-16 July, 2023]